লিটন দাশ গুপ্ত
গত ১১ মার্চের কথা। এইদিন চট্টগ্রামের সমাজ সেবক, দানবীর হায়দার আলী চৌধুরী সাহেব কর্তৃক আয়োজিত এক ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অন্যান্যদের মধ্যে আমিও আমন্ত্রিত ছিলাম। ঐ দিন যথাসময়ে চেরাগী পাহাড় মোড়ে আজাদী টাওয়ারের সাত তলায় চলে গেলাম। আজাদী টাওয়ারের সাত তলায় ‘হায়দার আলী চৌধুরী মিলনায়তন’ নামে হায়দার ভাইয়ের একটি হলরুম আছে। সেখানেই অনুষ্ঠিত হল হায়দার ভাইয়ের উদ্যোগে এক অসাম্প্রদায়িক ইফতার মাহফিল। এখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে হিন্দু ও মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের মানুষ। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে দাওয়াত ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন প্রবর্তক স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ মনোজ কুমার দেব। মনোজ দাদাকে দায়িত্ব নেবার কারণ হচ্ছে তাঁর একটা নিজস্ব গ্রæপ রয়েছে, যেখানে প্রায় একশ এর মত সদস্য আছে। যারা অধিকাংশই চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষক, আইনজীবী ও সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। একইসাথে রয়েছে বাংলাদেশ বেতার টেলিভিশনের কিছু স্বনামধন্য শিল্পী ও বেশ কিছু সাংস্কৃতিক কর্মী। এরা সকলে মিলে বিভিন্ন সময় ধর্মীয় আলোচনা সভার আয়োজন, জাতীয় উৎসবসমূহ পালন, দর্শনীয় স্থানে আনন্দভ্রমণ, বিভিন্ন মনীষীর জীবনভিত্তিক আলোচনা ইত্যাদি উদযাপন করে থাকেন। বলতে গেলে প্রগতিশীল উচ্চমার্গীয় চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বদের নিয়ে এটি একটি টিম। এই টিম পরিচালনায় সবসময় সক্রিয় থাকেন শ্যামল বিশ্বাস, অজিত শীল, শ্যামল বৈদ্য, বিজয়শঙ্কর চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
যাইহোক যে কথা বলছিলাম, সেই ইফতার মাহফিলের কথায় আসি। বলছিলাম ইফতারের উদ্যোক্তা হলেন হায়দার ভাই। জানতে পেরেছি বৃটিশ আমল থেকে হায়দার ভাইয়ের পরিবার সমৃদ্ধ। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১ নং দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে (ফতেয়াবাদ) নাকি হাজার একর জমি রয়েছে! শুনেছি যা তিনি লক্ষাধিক ভুমিহীন পরিবারকে বিনামূল্যে দিয়ে দিবেন। লক্ষ পরিবারকে ভুমিদান করার কথা শুনে আমি অবাক হয়েছি। কৌতুহল হয়ে বিস্তারিত জানার জন্যে হায়দার ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। তিনি বলেছেন তাঁর পিতা মোজাহেরুল হক চৌধুরী সাহেব ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের খ্যাতিসম্পন্ন ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর আপন জ্যাঠা নুরুল হক চৌধুরীও নাকি পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রম ও সংখ্যালঘু মন্ত্রী ছিলেন। কাট্টলি ও ফতেয়াবাদে তাঁর পিতার খরিদাসূত্রে অনেক জায়গা জমি রয়েছে। তিনি এক লক্ষ ভুমিহীন মানুষকে বিনামূল্যে দান করার পরিকল্পনা করছেন জানিয়েছেন।
যাই হোক, হায়দার ভাইয়ের এমন মহতী উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাচ্ছি। বলছিলাম অনুষ্ঠিত উক্ত ইফতার মাহফিলে পূর্ব ঘোষিত সময়ে আমরা বিকাল ৫ টায় যথাসময়ে যথাস্থানে উপস্থিত হলাম। ইফতার মাহফিলে দেখলাম অনেক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে শুরু হয় ধর্মীয় আলোচনা সভা। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মের মূলতত্ত¡ উপস্থাপনে উভয় উভয়ের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ সহশীলতা মমত্তবোধ ভ্রাতৃত্ববোধ দেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে কেবল অভিভূত হলাম তা নয়, রীতিমত বিস্মিতও হলাম। অনেক বক্তা স্মরণ করেন আগেকার দিনে ঈদে বা পূজায় এক সম্প্রদায়ের মানুষ অন্য সম্প্রদায়ের উৎসবে কিভাবে সম্পৃক্ত হত। কিভাবে মুসলমান মাজার বা পিরের সমাধিতে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ আসা যাওয়া করত, ধুপ মোমবাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করা মানত করা হত; অন্যদিকে সনাতন ধর্মাবলম্বীর ঘরে অশ্বিনী কুমার ব্রতের ভাত খাওয়া কিংবা দুর্গাপূজা বা চৈত্র-সংক্রান্তিতে মুসলিম ভাইবোনেরা আসা যাওয়া ইত্যাদি ছিল তখনকার সমাজে অসাম্প্রদায়িক চেতনার নিদর্শন। বক্তারা উল্লেখ করেন, সুন্দরবনের সঙ্গে জীবন জীবিকা জড়িয়ে আছে এমন অনেক হিন্দু মুসলমান বাওয়ালি কাঠুরে জেলে মৌয়ালি। এখনো তারা বনের রক্ষাকর্ত্রী দেবী কল্পনায় বনবিবি আর বনদূর্গা এবং ব্যাঘ্র দেবতা গাজীর নামে শিরনি দিয়ে থাকে, মহাদেবের নাম স্মরণ করেন। এখনো অনেক জায়গা আছে, যেখানে পাশাপাশি দুই সম্প্রদায়ের মানুষ একে অপরের শ্রদ্ধা আদর, স্নেহ ভালোবাসা পেয়ে থাকে এবং পরস্পরকে দূর সম্পর্কীয় বা অন্য সম্প্রদায়ের কেউ মনেই করেনা। এখনো বিভিন্ন জায়গায় দুই সম্প্রদায়ের ছোট ছোট শিশু কিশোর আছে, যারা আনন্দের সাথে হাতের করগুনে, সমানভাবে দেখে ঈদ কিংবা পূজার বাকী আর কয়দিন! এই বিষয়ে বিশিষ্ট ধর্মতত্ত্ববিদ অধ্যাপক স্বদেশ চক্রবর্তী দাদা তাঁর বক্তৃতায় বলেন এখনো মেধস আশ্রম, বায়োজিদ বোস্তামী মাজার, চন্দ্রনাথ ধাম, মাইজভান্ডার, আদিনাথ, মোহছেন আউলিয়া ইত্যাদিতে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। স্বদেশ দাদা আরো উলেখ করেন, বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমি বীর চট্টলার মানুষ অসাম্প্রদায়িক যা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। বিভিন্ন উৎসবে অনুষ্ঠানে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আর এসব বাস্তবতাই হচ্ছে এদেশের দীর্ঘকাল ধরে লালিত সংস্কৃতির সংমিশ্রণের ফল।
এরই মধ্যে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এল। আজানের আগপর্যন্ত হুজুর হাদিসে বর্ণিত দোয়াগুলো গুরুত্বসহকারে পড়েন। অতঃপর আজান দেবার সাথে সাথে শুরু হয় নানা রকম বাহারি ইফতার গ্রহণের আয়োজন। ইফতার শেষে প্রথম অধিবেশন সমাপ্তি ঘোষণা করা হল। এইদিকে প্রথম অধিবেশন শেষ হবার আগে একযোগে সকলের কন্ঠে পরিবেশিত হয় কাজী নজরুল ইসলামের গান ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এল খুশির ঈদ, তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানী তাগিদ…।’
এর কিছুসময় বিরতি পর শুরু আবার হল দ্বিতীয় অধিবেশন। যেখানে বিভিন্ন আলোচনার পাশাপাশি অধ্যাপক স্বদেশ চক্রবর্তী দাদা চন্ডীতীর্থ মেধস আশ্রমের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় এবং মনোজ কুমার দেব দাদা প্রবর্তক কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হওয়ায় দুইজনকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। পুরো অনুষ্ঠানে বক্তব্যের মাঝখানে মাঝখানে পরিবেশন করা হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নানান গান। এই ভাবে রাত সাড়ে দশটা পার হয়ে যায়। অবশেষে আয়োজক পক্ষ কর্তৃক রাতের ডিনার বা নৈশভোজের ব্যবস্থা করা হয়। এইভাবে হায়দার ভাই প্রমাণ করেছেন, চট্টগ্রামের মানুষ অসাম্প্রদায়িক। তারা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সর্বদাই শ্রদ্ধাশীল, সহনশীল। বাংলাদেশের মূল শক্তিই হলো বাঙালি জাতিসত্তা। জাতি হিসেবে আমরা বাঙালি। আমাদের ভাষা হচ্ছে বাংলা। নাগরিক হিসাবে আমরা বাংলাদেশী। এই অঞ্চলে প্রত্যেক ধর্মের মানুষ স্ব-স্ব ধর্ম পালন করলেও উৎসবের আনন্দ সব ধর্মের মানুষ একসঙ্গে উপভোগ করে, অনুভব করে। তাই সেই উক্তি এই অঞ্চলে যথার্থ মনে হয়- ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার।’ আর এই রকম ধর্ম যার যার উৎসব সবার হবার কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত রয়েছে এই চট্টগ্রাম অঞ্চলে। এইভাবে সাড়া দেশে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচিত হোক এটাই সকলের কাম্য। পরিশেষে কাজী নজরুলের দুটি চরণ দিয়ে লেখা শেষ করতে চাই-
মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান
মুসলিম তার নয়ন মণি হিন্দু তাহার প্রাণ।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট