নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
জহুর আহমদ চৌধুরী একজন ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ। এমন নেতা গন্ডায় গন্ডায় জন্মায় না। কালেভদ্রে তাঁরা জন্মগ্রহণ করেন এবং কালকে অতিক্রম করে কালোত্তীর্ণ হয়ে যান। তাঁরা যুগস্রষ্টা পরমপুরুষ, স্বীয় জীবনকালেই তাঁরা কিংবদন্তী হয়ে যান এবং ব্যক্তি জীবনের গন্ডি ছাপিয়ে ইনস্টিটিউশন বা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হন।
৪৭-এর দেশভাগ-উত্তর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে আমরা যেসব প্রতিষ্ঠিত ও প্রতিষ্ঠাবান নেতার সাক্ষাৎ পাই, তাঁদের মধ্যে খান সাহেব আবদুল হক দোভাষ, শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী, খান বাহাদুর ফরিদ আহমদ চৌধুরী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ব্যারিস্টার সানাউল্লাহ, অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, এমএ আজিজ, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবুল খায়ের সিদ্দিকী, আজিজুল রহমান (গোরা আজিজ) নুরুল আনোয়ার চৌধুরী, শেখ মোজাফফর আহমদ, আমীর হোসেন দোভাষ, সুধাংশু বিমল দত্ত, নেলী সেনগুপ্তা, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, চৌধুরী হারুনুর রশিদের নাম উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানের তেইশ বছরের চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাসকে পর্যালোচনা করে উপর্যুক্ত নেতাদের মধ্যে ৭০ সালে মাত্র দু’জনকেই নেতৃত্বের স্বর্ণ সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখা যায়। তাঁরা হলেন আওয়ামী লীগের এমএ আজিজ ও জহুর আহমদ চৌধুরী। তখন মুসলিম লীগের সমস্ত নেতা স্বর্গচ্যুত হয়ে ধূলিশয্যা নিয়েছেন। যাঁরা প্রবীণ তাঁরা পরলোকবাসী; জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবল জোয়ারে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টির আন্তর্জাতিক রাজনীতি খড়কুটোর মত ভেসে গেছে।
এমএ আজিজ ৭১-এর ১১ জানুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে জহুর আহমদ চৌধুরী একাই তখন চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা। জহুর আহমদ চৌধুরী ইতিহাস গড়লেন। তাঁর সামনে আরো ইতিহাসের হাতছানি। জহুর আহমদ চৌধুরী তাতে সাড়া দিতে ভুল করলেন না। নব নব ইতিহাস সৃষ্টি করে তিনি নিজেও ইতিহাস হয়ে গেলেন। বাংলাদেশে তখন একে একে অনেক ঘটনা ঘটে যায়। পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা আর ধ্বংসের তান্ডব চালানো শুরু করে;, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সে ঘোষণা করে কাছে পাঠাবেন প্রচারের জন্য, সে চিন্তা করতে গিয়ে মনে পড়লো চট্টগ্রামে তাঁর দলের শীর্ষনেতা এবং পুরোনো বন্ধু জহুর আহমদ চৌধুরীর কথা।
মুহূর্তের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠিয়ে দিলেন চট্টগ্রামে জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে। জহুর আহমদ চৌধুরী সম্ভব সব পন্থায় সে ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করলেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করে জহুর আহমদ চৌধুরী দৌঁড়ালেন সীমান্তের উদ্দেশ্যে। তিনি এমআর সিদ্দিকী ও আবদুল্লাহ আল হারুনকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে পৌঁছে গেলেন সবার আগে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের মাধ্যমে দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পৌঁছে দিলেন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর। তখনো তাজউদ্দিন ভারতে যান নি। ম্যাডাম গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করার জন্য এম আর সিদ্দিকীকে পাঠিয়ে দিলেন দিল্লিতে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীই নিয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁরা যখন দিল্লির সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পৌঁছলেন ২ এপ্রিল, তখন সেখানে তাজউদ্দিন এবং ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামও পৌঁছে গেছেন। এম আর সিদ্দিকী যখন সেটা জানতে পারলেন, তখন তিনি ভাবলেন, দলের সাধারণ সম্পাদক যখন এসেছেন, তখন তাঁরই ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক আলোচনায় বসা সঙ্গত। সেকথা মুখে বলে তিনি চলে এলেন আগরতলায়।
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে জহুর আহমদ চৌধুরী ত্রিপুরায় মুক্তিযোদ্ধা ও শারণার্থীদের আশ্রয়, ট্রেনিং ও অস্ত্র শস্ত্র প্রদানের জন্য যে বন্দোবস্ত করেছিলেন, তারই ফলে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরের মধ্যে অন্তত ৬টির হেডকোয়ার্টার ত্রিপুরায় স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিলো। ত্রিপুরায় বসে চট্টগ্রাম, নোয়াখালী ও কুমিল্লার এমএনএ ও এমপিএরা ভোটাভুটি করে জহুর আহমদ চৌধুরীকে ইস্টার্ন লিবারেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী অধিকৃত দেশ থেকে যেমন প্রথম ভারতে গিয়েছিলেন, তেমনি মুক্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনও সবার আগেই করেছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর কসবা থানায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন জহুর আহমদ চৌধুরী এবং মুক্তিবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন এমএনএ ও এমপিএ-ও ছিলেন।
১০ ডিসেম্বর বিকেলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কাছারী প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অসামরিক প্রশাসন চালু করেন। পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং উপস্থিত দশ হাজার জনতার এক সমাবেশে সংক্ষিপ্ত ভাষণে সমস্যাসঙ্কুল আগামী দিনগুলিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের পাশে দাঁড়াবার আহবান জানান। অনুষ্ঠানে আলী আজম, আব্দুল জামান উপস্থিত ছিলেন। (সুকুমার বিশ্বাস : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে আগরতলা ত্রিপুরা দলিলপত্র-পৃ. ৮৪০)
জহুর আহমদ চৌধুরী ১৫ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে কুমিল্লা থেকে ঢাকা যান, কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে তাঁর হেলিকপ্টার ঢাকায় নামতে দেওয়া হয়নি। তিনি ঢাকার উপকণ্ঠে অবস্থান করে ১৬ তারিখে বীরদর্পে ঢাকায় ঢুকে যান। এবং ঢাকা বেতার চালু করে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে দেশ স্বাধীন হওয়ার ঘোষণা দেন। ঢাকাও তাঁর প্রশাসনিক জোনের অন্তর্গত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে জহুর আহমদ চৌধুরীর কোরবানী সর্বাধিক। তাঁর প্রাণাধিক জ্যেষ্ঠপুত্র ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং ভারতে যাওয়ার পথে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাহাড়তলী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সামনে পাকিস্তানি সৈন্যদের এম্বুশে পড়ে যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদাত বরণ করেন। তাঁর দামপাড়া পল্টন রোডের বাড়িটি ছিলো শহরের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সে বাড়ি থেকেই শহরে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাÐ পরিচালিত হতো। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাও পাঠিয়েছিলেন সেই বাড়ির টেলিফোনে। এসব কারণে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী বাড়িটির ওপর খড়্গহস্ত ছিলো। তাই ক্র্যাকডাউনের পর প্রথম চোটেই ক্রুদ্ধ পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর বাসভবনটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ও পরে গুঁড়িয়ে দেয়।
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভা কলকাতা থেকে ঢাকায় আসে ২২ ডিসেম্বর ’৭১। ১৯৭১ সালের ২৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা গঠনের পর মুক্ত স্বদেশে এই প্রথম মন্ত্রিসভা স¤প্রসারণ করা হয়। বঙ্গভবনে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান বাংলায় পরিচালনা করেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব হোসেন তওফিক ইমাম। সেই স¤প্রসারিত মন্ত্রিসভায় জহুর আহমদ চৌধুরী ছাড়া আর মাত্র তিনজন অন্তর্ভুক্ত হন, তাঁরা হলেন : ফনীভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী অব, খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এএইচএম কামরুজ্জামান। মন্ত্রিসভায় সদস্যদের দফতর বন্টন করা হয় ২৯ ডিসেম্বর বিকেলে। জহুর আহমদ চৌধুরী চারটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান- স্বাস্থ্য, শ্রম, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। (ফারুক চৌধুরী : দেশ দেশান্তর-ঢাকা; মীরা প্রকাশ- পৃ. ৮২)
মাত্র যে দেশটি স্বাধীন হয়েছে, চারিদিকে ধ্বংসলীলার স্বাক্ষর আর সর্বস্বহারা মানুষের আহাজারি; সেই দেশটিকে নতুন করে গড়ে তোলার কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে দ্বিধা করলেন না যুদ্ধজয়ী জহুর আহমদ চৌধুরী। একটু জিরোবার সুযোগও পেলেন না; আরেক যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। শ্রম, সমাজকল্যাণ, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা, চারটি মন্ত্রণালয়ই গুরুত্বপূর্ণ; যুদ্ধের ক্ষত কোথায় নেই। এখন ভাঙ্গাচোরা, বিধ্বস্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সারিয়ে তুলে সেখানে আবার স্বাভাবিক কর্মপ্রবাহ ফিরিয়ে আনতে দিনরাত পরিশ্রম করে যেতে লাগলেন। তাঁর স্বাস্থ্য কোন সময়ই ভালো ছিলো না; সেই ভঙ্গুর স্বাস্থ্য যুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর দেশ পুনর্গঠনে আরো ক্ষয়ে গেল এবং অবশেষে তার দম ফুরিয়ে এলো। ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই ঢাকায় পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মহা প্রস্থান করলেন মহাপ্রাণ জহুর আহমদ চৌধুরী।
মৃত্যুতেও জহুর আহমদ চৌধুরী কত মহান। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে একমাত্র তিনিই বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় সম্মান পেয়েছেন। তাঁর জানাজায় সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে নিয়ে অংশগ্রহণ করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু। তিনি প্যারেড ময়দান থেকে খাটিয়া কাঁধে করে বহন করে দামপাড়া পল্টন রোডে নিয়ে আসেন। এবং দাফন অনুষ্ঠান তদারক করেন। জিয়াউর রহমান গার্ড অব অনার অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এবং কবরে নেমে মাটি দেন।
জহুর আহমদ চৌধুরীর মৃত্যুর পর সংসদে আনীত শোক প্রস্তাবের উপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করে সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন-
“তাঁর একটা গুনের ইতিহাস আছে। তিনি যা কিছু উপার্জন করতেন না গরীবদের খাইয়ে দিতেন। আজকাল এটা একটা ‘ফ্যাশন হয়ে গেছে, মন্ত্রী হলেই তাঁর উপর বদনামী এসে যায়। আজ এটা প্রমাণ হয়ে যাক। দেখুন বাঙলাদেশের মানুষ যে, মন্ত্রী হলেই তাঁর বদনাম হয় না। জহুর আহমদ চৌধুরী দিকে চেয়ে দেখুক। তাঁর চাওয়া পাওয়ার কিছুই নাই। তারা খোঁজ করে দেখুক জহুর আহমদ চৌধুরীর ছেলেপিলের খাওয়ার পয়সা পর্যন্ত নাই। এটা আজকাল আমাদের দেশের একটা ‘ফ্যাশন’ যে, আমরা নিজেদের সমালোচনা করে নিজেদের সর্বনাশ করি। দেখুন তার ছেলেপিলের দিকে তাকিয়ে। কি করে যে তারা বাঁচবে, সে চিন্তা করতে আমার ভয় হয়। কারণ, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর সর্বস্ব লুষ্ঠিত হয় এবং তাঁর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর বাড়িতে তাঁর যে কর্মঠ ছেলে ছিল সাইফুদ্দিন খালেদ চৌধুরী, তাকে নিমর্মভাবে হত্যা করা হয় রাঙ্গুনিয়াতে। কারণ সে তখন আমার মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের খাবার ‘সাপ্লাই’ করছিল। সে জন্য সে সময় তাকে রাস্তায় হত্যা করা হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আগরতলায় একটা স্কুল ঘরে বসে এই অঞ্চলের বার তিনি গ্রহণ করেন এবং সেখানে বসে তিনি তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালনা করেন”।
জহুর আহমদ চৌধুরী যথার্থ অর্থে একজন পাবলিক লিডার ছিলেন। তাঁর রাজনীতির উৎস ছিলো জনগণ, গন্তব্যও ছিলো জনগণ। এমনই জনপ্রিয় ছিলেন যে, জীবনে কোন নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। একবার শুধু ্আইয়ুবের আশি হাজার ফেরেশতার বিডি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তিনি জয়লাভ করতে পারেননি। সে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাই তাঁর ভুল হয়েছিলো। কারণ সেটা তো নির্বাচন নয়, ছিলো প্রহসন।
১৯৫২ সালে জহুর আহমদ চৌধুরী জীবনে প্রথম নির্বাচনে অবতীর্ণ হন এবং তাতে বিজয় লাভ করেন। সেটি ছিলো চট্টগ্রাম পৌরসভার নির্বাচন, জহুর আহমদ চৌধুরী কমিশনার নির্বাচিত হন। তিনি চেয়ারম্যান পদেও নির্বাচন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর জয়ের সম্ভাবনা থাকায় নির্বাচনের প্রাক্কালে ষড়যন্ত্র করে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। ফলে তিনি আর নির্বাচন করতে পারেননি।
১৯৫৪ সালে ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জহুর আহমদ চৌধুরী এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে শহরের মূল আসন কোতোয়ালী থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে তাঁর বিজয় ছিলো একটি চমকপ্রদ ঘটনা। কারণ যাঁর সাথে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিলো, তিনি ছিলেন একজন হেভিওয়েট প্রার্থী-তৎকালীন চট্টগ্রামের শ্রেষ্ঠ ধনী ও অভিজাত পুরুষ রেয়াজউদ্দিন বাজারের মালিক শেখ রফিউদ্দিন সিদ্দিকী। তিনি শুধু চট্টগ্রামের সামাজিক নেতা বা স্থানীয় মুসলিম লীগের শীর্ষ নেতা ছিলেন না, মুসলিম লীগের প্রদেশ ও কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিলো, এমনকি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহরও তিনি প্রিয়পাত্র ছিলেন। জহুর আহমদ চৌধুরীও তখন বড় নেতা, কিন্তু রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর মাপে ছোট। তাই উভয়ের নির্বাচনী লড়াইটা ছিলো অসম এবং রফিউদ্দিন সিদ্দিকীর বিজয় সম্পর্কে সবাই একরূপ নিশ্চিত ছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে জহুর আহমদ চৌধুরীই জয়লাভ করলেন। এই নির্বাচনী ফলাফলের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে কলকাতার স্টেটসম্যান পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখে তাতে মন্তব্য করেছিলো “মক্ষিকার কাছে হস্তির পরাজয়”।
আইন সভার সদস্য (এম.এল.এ-মেম্বার অব দি লেজিসলেটিভ এসেম্বিং) হয়ে জহুর আহমদ চৌধুরী নিজেকে সফল পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। আইন সভায় তিনি চট্টগ্রামকে যথাযথভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন। জীবনে আরো দু’বার ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ’৭৩ সালে ছিল তার শেষ নির্বাচন, একবছর পর ১৯৭৪ সালের ১ জুলাই তিনি পরলোকগমন করেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা-সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। এমএ আজিজসহ চট্টগ্রাম থেকে মোট ১১জন ডেলিগেট রোজ গার্ডেন সম্মেলনে যোগদান করেন। পুরানো ঢাকার টিকাটুলীর কে এম দাশ লেনে কাজী মোহাম্মদ বশীর হুমায়ুনের বাসভবন রোজ গার্ডেন-এর হল রুমে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। উক্ত ১১জন ডেলিগেট ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ফিরে এসে এখানেও আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। সালারে জিলা শহীদ শেখ মোজাফফর আহমদ ও এমএ আজিজকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং আমীর হোসেন দোভাষ ও জহুর আহমদ চৌধুরীকে যথাক্রমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে চট্টগ্রাম শহর আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটি গঠন করা হয়।
শ্রমিক রাজনীতিতে জহুর আহমদ চৌধুরী একটি কিংবদন্তী নাম। তাঁকে চট্টগ্রামের শ্রমিক রাজনীতির পিতা, এমনকি পূর্ব পাকিস্তানেও প্রথম ট্রেড ইউনিয়নের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। ট্রেড ইউনিয়ন দিয়েই তিনি রাজনীতি শুরু করেন এবং ট্রেড ইউনিয়নই হয়তো তাঁর সারাজীবনের মৌলিক কাজ। তিনি বহু ট্রেড ইউনিয়নের জন্ম দেন এবং আজীবন সেসব ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরীর শ্রমিক রাজনীতি ছিলো স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। শ্রমিক রাজনীতিকে তিনি ট্রেড ইউনিয়ন অর্থাৎ অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন। ট্রেড ইউনিয়ন দিয়ে রাজনীতি করতে চাননি। কিংবা রাজনীতির মধ্যে ট্রেড ইউনিয়নকে টেনে আনতে চান নি। তাঁর ট্রেড ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকরা হয়তো তাঁর রাজনীতির সহায়ক হয়েছে, যেমন চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তনে তাঁর অনুসারী শ্রমিক কর্মচারীরা বিরাট অবদান রেখেছিলো। কিন্তু তিনি নিজে সচতনভাবে ট্রেড ইউনিয়নকে রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত করতে চান নি। তাঁর ট্রেড ইউনিয়ন ঐ সিবিএ পর্যন্ত, শ্রমিক-কর্মচারীদের রুটি-রুজি, জীবনমান উন্নয়নের আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিলো। এ কারণে ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে শ্রমিক লীগ প্রতিষ্ঠা করা হলে জহুর আহমদ চৌধুরী এই সংগঠনে যোগদান করতে অস্বীকার করেন। তাঁকে এই সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো কিন্তু তাতেও তাঁর অবস্থান থেকে তাঁকে টলানো যায় নি। এমন কি, বঙ্গবন্ধুর অনুরোধও রাখতে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত জাতীয় গণতান্ত্রিক শ্রমিক ফেডারেশন নিয়েই ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন চালিয়ে যান। তিনি ছিলেন জাতীয় গণতান্ত্রিক শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আর জামশেদ আহমদ চৌধুরী ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। তিনিও একজন খ্যাতিমান শ্রমিক নেতা ছিলেন।
জহুর আহমদ চৌধুরী রাজনীতির পাকা জহুরী ছিলেন। তিনি রাজনীতি বুঝতেন, জানতেন; তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন রাজনীতিতে, রাজনীতিও তাঁকে উজাড় করে দিয়েছিলো। তাঁর কোন পিছুটান ছিলো না। যেমন পকেট হাতড়ে দেখতেন টাকা-পয়সা আছে কিনা। থাকলে সে টাকা কিভাবে অন্যকে দিয়ে পকেট খালি করে ফেলবেন সেজন্য ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। রাজনীতিও যখন করতেন, সামনেটাই দেখতেন, পেছনটা দেখতেন না, কারণ পেছনে তো তাঁর কিছু নেই। না কোন বন্ধন, না কোন সঞ্চয়। তিনি বর্তমানপন্থী ছিলেন, ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন না। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে উদ্বেগাকুল হতেন না। তাই ভবিষ্যতের জন্য কিছু সঞ্চিত রাখতেন না। পিজি হাসপাতালের কেবিনে যখন তাঁর বুকের খাঁচা থেকে শেষ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গিয়েছিলো, তখন তাঁর পদতলে বসা মহিউদ্দিন চৌধুরী (সাবেক মেয়র ও চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি আলহাজ এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী) বুকফাটা আর্তনাদ আর কান্নাকাটির পর যে পুরাতন ব্রিফকেসটি সেখানে পেয়েছিলেন, তাতে একশ বা দুইশ টাকা ছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চার চারটি মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালী মন্ত্রী জহুর আহমদ চৌধুরীর আর কোন টাকা-পয়সা বা ধন সম্পদ ছিলো না। ঢাকা-চট্টগ্রামেও কোথাও পাওয়া যায় নি। তাঁর নিজের বাড়িও ছিলো না, বাড়িভিটাও ছিলা না। চট্টগ্রামে দামপাড়া পল্টন রোডে যে বাড়িতে থাকতেন, সেটি তাঁর স্ত্রীকে প্রদত্ত তাঁর শ্বশুরের উপহার। তাঁর মতো এমন নিষ্কাম, নির্মোহ, সর্বস্বত্যাগী যোগী গৃহী মানুষের মধ্যে একান্তই দুর্লভ।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক