ডেইজী মউদুদ
আমাদের চট্টগ্রামের প্রাণ কর্ণফুলী নদী। সেই কবে এই নদী লুসাই পাহাড় থেকে নেমে এসে নানা পথ পরিক্রমায় এসে মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। আর এই নদীর কারণেই সাগরসংগমের বিশাল মোহনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বন্দর এর সৃষ্টি। ভারতের মিজোরাম এর লুসাই পাহাড় থেকে নেমে এলেও এই নদীর নামকরণ নিয়ে রয়েছে অনেক কিংবদন্তি, কল্পকাহিনী। কর্ণফুলী নদী, বঙ্গোপসাগর আর চট্টগ্রাম বন্দর এই তিনের মেলবন্ধনে সারাবিশ্বে পরিচিত আমাদের চট্টগ্রাম। গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে নৌবাহিনী চট্টগ্রাম সদর দপ্তরের আমন্ত্রণে সমুদ্র অভিযান নামের একটি জাহাজ পরিদর্শনের সুযোগ হয়। দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর কর্তৃপক্ষ নৌ বাহিনী পরিবার পরিজনের জন্য এমন জাহাজ পরিদর্শনের আয়োজন করে থাকেন। এই এলাকা সংরক্ষিত বিধায় এখানে আম জনতার প্রবেশ নিষেধ। আমরা সাংবাদিক হিসেবেই আমন্ত্রিত হয়েই গিয়েছিলাম।
বিশাল সংবাদকর্মীর বহরকে অতি আন্তরিকতায় বরণ করে নিয়ে যাচ্ছিলেন মোমিন ভাই। অপেক্ষাকৃত তরুণ, নিঃসন্দেহে প্রাণবন্ত আর চমতকার ব্যক্তি। ভিড়বাট্টা এড়াতে বন্দরের ভেতর দিয়েই খুব কম সময়ে পৌঁছে গেলাম নৌ বাহিনীর এলাকায়। সংগত কারণেই কড়া ডিসিপ্লিন আর নিয়ম শৃংখলা এখানেই বেশি। তারা যেদিকে নির্দেশ করবেন, সেদিকেই যেতে হবে। জাহাজগুলি কর্ণফুলীতে দন্ডায়মান সারিবদ্ধভাবে। আলাদা আলাদা প্রবেশদ্বার। ১ নম্বর, ২ নম্বর ৩ নম্বর এভাবে আমাদের ২ নম্বর গেট দিয়ে নেয়া হলো। সুসজ্জিত জাহাজ সমুদ্র অভিযান এ। জাহাজের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন মো. আরিফ হোসেন সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে অনুষ্ঠানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। এ উপলক্ষে দিনব্যাপী নানান কর্মসূচি পালিত হয়। নৌবাহিনী পরিবারের সদস্যরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে আসেন জাহাজ পরিদর্শনে। এক বাস দেখে ফিরছেন তো আরেক বাস থেকে নামছেন শিশু কিশোর আবাল বৃদ্ধ বণিতা। আমি এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই কর্ণফুলীর ঘোলাজলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। নদীর জল ঢেউয়ে টলমল। নদীর ওপারে বসতি আর শিল্প কারখানা দেখা যাচ্ছে। আমার চোখ নদীতে। অদূরে ডিংগী নৌকা। ছোট ছোট জাহাজ ভাসছে। কেউবা নোংগরে জেটিতে ভেড়ার অপেক্ষায়। সিগ ন্যাল পেলেই পণ্য খালাস করবে বন্দরে। হেমন্তের কড়া রোদ মাথার উপরে। নদীর জলে তার আলোক রশ্মি চিক চিক করছিল। আমার হঠাৎ করে ছোকানু আর তার ভাই খোকার কথা মনে পড়লো, সে নদী পাড়ি দিতে মাঝিকে বলেছিল : ‘কোথায় চলেছো, এদিকে এসোনা, দুটু কথা শোন দিকি/ এই নাও এই চকচকে নূতন রূপোর সিকি/ ছোকানুর কাছে আরো দুটি আছে তোমারে দেব গো তাও/ আমাদের যদি তোমার সংগে নৌকায় তুলে নাও…’ আমি জাহাজ পরিদর্শন বহুবার করেছি। কিন্তু সেদিনের জাহাজ সমুদ্র অভিযান এ গিয়ে আমি তাদের আনুষ্ঠানিকতা উপভোগ করেছি বটে, কিন্তু আমার মনে ছোকানু, আমিনা, কুবের, কপিলা মালারা এসেই ভর করে। মনে হচ্ছিল, অদূরেই বুঝি হোসেন মিয়ার ময়না দ্বীপ। অথচ এখন তো কত কত দ্বীপ জেগেছে এই সাগর মালাকে ঘিরেই।কিছুদিন আগেই হাতিয়া আর নিঝুম দ্বীপে গিয়ে দেখে এসেছিলাম তাদের জীবনচিত্র। জাহাজে দাঁড়িয়েই নদীর প্রবহমানতা দেখছিলাম। দেখতে না দেখতেই সূর্য ও হেলে পড়ছিল, যেন ভাবছিল কখন সে পাটে গিয়ে টুপ করে ডুব দেবে! পড়ন্ত বিকেল টা ক্লান্ত শরীরে ও যেন আচমকা মনোরম হয়ে উঠলো। রোদের তেজ কমে গিয়ে আকাশে তখন মিঠেল আমেজ। চারিদিকে অবারিত সবুজের মূর্ছণায় মুগ্ধতার শেষ ছিল না। তবে অতি অল্প সময়ে এখানে উপভোগের রেশ থেকেই যায়, তদুপরি কড়া নিরাপত্তার চাদরে মোড়া এই সংরক্ষিত অঙ্গনে সাংবাদিকদের কেবল পেশাগত কাজেই আমন্ত্রণ জানানো হয়।কাজ শেষ তো আবার হুড়মুড় করে গাড়িতে উঠেই প্রত্যাবর্তন যার যার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে। এক ঝাঁক ত রুণ সাংবাদিক, ইলেক্ট্রনিক্স দের হাতে ভারী ভারী ক্যামেরা, মাইক্রোফোন যন্ত্রপাতি, কেউ লাইভ দিলেন, কেউ ফুটেজ নিলেন, কেউ নোট করলেন। ফিরতেই গল্প চলছিল। আমি আর লিপি শ্রোতা। গল্প শুনতেই শুনতেই নগরে প্রবেশ। পেছনে রেখে এলাম কিংবদন্তি নদী কর্ণফুলীকে। মনে পড়ে গেলো কবি নজরুলের কর্ণফুলী কবিতা। কবি চট্টগ্রাম ভ্রমণে এসে এই নদীতে নৌ বিহার শেষে লিখেছিলেন: ‘ওগো ও কর্ণফুলী / উজাড় করিয়া দিনু তব জলে আমার অশ্রুগুলি/ যে লোনা জলের সিন্ধু সিকতে নিতি তব আনাগোনা / আমার অশ্রæ লাগিবেনা সখী তার চেয়ে বেশী লোনা/ তুমি শুধু জল করো টলোমল; নাই তব প্রয়োজন/ আমার দু ফোটা অশ্রæজলের এ গোপন আবেদন….’।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক