একটি ঘৃণিত, নিন্দনীয় ও ভয়াবহ অপরাধ

1

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

সবচেয়ে ঘৃণিত, নিন্দনীয় ও ভয়াবহ অপরাধগুলোর অন্যতম হলো গীবত তথা পরনিন্দা বা অন্যের দোষ চর্চা করা। এটি অন্যতম একটি সামাজিক ব্যাধি; যার অসভ্য গ্রাস থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত নয়।আমাদের এমন কোনো আলোচনা, সভা-সমাবেশ বা মজলিস খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যেখানে এই জঘন্য পাপের চর্চা থেকে মুক্ত থাকে। যে গীবতকে ব্যভিচারের চেয়েও ভয়ানক পাপ হিসাবে হাদীস শরীফে আখ্যায়িত করা হয়েছে এবং যা মানুষের সওয়াবের ভান্ডারকে শূন্য করে দেয় ও পরকালে ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন করে। এই পাপের মাধ্যমে হাক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক নষ্ট হয়। কারণ গীবত বা পরনিন্দার মাধ্যমে অন্যের সম্মান হানি করা হয় এবং তার মর্যাদার ওপর চরমভাবে আঘাত করা হয়, যা আল্লাহ প্রত্যেক মুসলিমের উপর হারাম করে দিয়েছেন। তাই পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ গীবতকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা অধিক ধারণা হ’তে বিরত থাক। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ধারণা পাপ। আর তোমরা ছিদ্রান্বেষণ কর না এবং পরস্পরের পিছনে গীবত কর না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করে? বস্তুতঃ তোমরা সেটি অপছন্দ করে থাক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু’ (হুজুরাত ৪৯/১২)।
অপর ভাইয়ের সম্মান রক্ষা করা কর্তব্য এবং করো সম্মান নষ্ট করা হারাম। আর গীবত অন্য মুসলমানের সম্মানহানির অন্যতম মাধ্যম। এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, ‘সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলিম কে?’ জবাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, যার হাত ও যবান থেকে অপর মুসলিম নিরাপদ থাকে (সে-ই সর্বশ্রেষ্ট মুসলিম)’। [তিরমিযী হা/২৫০৪]
গীবত কী?
‘গীবত’ আরবী শব্দ। যার আভিধানিক অর্থ হ’ল- পরনিন্দা করা, দোষচর্চা করা, কুৎসা রটনা, পেছনে সমালোচনা করা, দোষারোপ করা, কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষগুলো অন্যের সামনে তুলে ধরা।
গীবতের পারিভাষিক অর্থ যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীস শরীফে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন: “তোমরা কি জানো গীবত কাকে বলা হয়? সাহাবারা বললেন: আল্লাহ্ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই এ সম্পর্কে ভালো জানেন। তখন তিনি এরশাদ করেন: তোমার মুসলিম ভাই অপছন্দ করে এমন কোন কথা তার পেছনে বলা। জনৈক সাহাবী বললেন: আমি যা বলছি তা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যেই থাকে তাও কি গীবত হবে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি যা বলছো তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে তা হলেই তো গীবত। আর যদি তার মধ্যে তা না পাওয়া যায় তা হলে তা বুহ্তান তথা মিথ্যা অপবাদ।” (মুসলিম ২৫৮৯; আবূ দাউদ ৪৮৭৪; তিরমিযী ১৯৩৪)
তাই গীবত হচ্ছে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করা। চাই সেই দোষ-ত্রুটির সম্পর্ক তার দেহ-সৌষ্ঠব, দ্বীনদারিতা, দুনিয়া, মানসিকতা, আকৃতি, চরিত্র, ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, পিতামাতা, স্ত্রী, চাকর-বাকর, পাগড়ি, পোষাক, চলাফেরা, ওঠা-বসা, আনন্দ-ফুর্তি, চরিত্রহীনতা, রূঢ়তা, প্রফুল্লতা-স্বেচ্ছাচারিতা বা অন্য যেকোন কিছুর সাথেই হোক না কেন। তা মুখে বলে, লিখে, আকার-ইঙ্গিতে, চোখের ইশারায়, হাত দিয়ে, মাথা দুলিয়ে বা অন্য যেকোন উপায়েই করুন না কেন, তা গীবত’। হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন, আমি একবার ছাফিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহার দিকে ইশারা করে বললাম, ‘সে তো বেঁটে মহিলা’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তুমি তো তার গীবত করলে’।[ আহমাদ হা/২৫৭০৮]
অপর বর্ণনায় এসেছে তিনি বললেন, ‘তুমি এমন একটি কথা বলেছ, যদি তা সমুদ্রে মিশিয়ে দেওয়া হয়, তবে (এর দুর্গন্ধ ও জঘন্যতা) সমুদ্রের পানিকেও (রং, স্বাদ ও গন্ধ) পাল্টে দেবে’।[ আবূদাঊদ হা/৪৮৭৫; তিরমিযী হা/২৫০২]

কবরে গীবতের শাস্তি : ‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একদা দু’টি কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এ সময় তিনি বললেন, এদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে কোন গুরুতর অপরাধের জন্য তাদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না। তাদের একজন মূত্রত্যাগের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতো না। আর অপরজন গীবত ও চোগলখুরী করে বেড়াত। তারপর তিনি একখানি কাঁচা খেজুরের ডাল নিয়ে দু’ভাগ করে প্রত্যেক কবরের উপর একটা করে পুঁতে দিলেন। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কেন এমন করলেন? তিনি বললেন, আশা করা যায় এই দু’টি ডাল শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত যিকর করবে, যার ফলে) তাদের কবরের আযাব হালকা করা হবে’।[ বুখারী হা/২১৮]

গীবত দুনিয়া ও আখেরাতে অপমানিত হবার অন্যতম কারণ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসলমানদেরকে পরনিন্দা থেকে সাবধান করে এরশাদ করেন, ‘ওহে যারা কেবল মুখেই ঈমান এনেছে কিন্তু ঈমান অন্তরে প্রবেশ করেনি! তোমরা মুসলমানদের গীবত করো না এবং তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়িয়ো না। কারণ যে ব্যক্তি তাদের দোষ-ত্রুটি খুঁজে বেড়াবে আল্লাহও তার দোষ-ত্রুটি খুঁজবেন। আর আল্লাহ কারো দোষ-ত্রুটি খুঁজলে তাকে তার ঘরের মধ্যেই অপদস্থ করে ছাড়বেন’।[(আবূ দাউদ ৪৮৮০)]

গীবতকারী জন্য পরকালে সাওয়াব বা প্রতিদানশূন্য হয়ে দোযখে যাবার হুশিয়ারী : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘তোমরা কি বলতে পার, নিঃস্ব কে? ছাহবীরা বললেন, আমাদের মধ্যে যার টাকা-পয়সা ও আসবাপত্র নেই সেই তো নিঃস্ব। তখন তিনি বললেন,‘আমার উম্মাতের মধ্যে সেই প্রকৃত নিঃস্ব, যে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন ছালাত, ছিয়াম ও যাকাতের আমল নিয়ে উপস্থিত হবে; অথচ সে এই অবস্থায় আসবে যে, একে গালি দিয়েছে, একে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, একে হত্যা করেছে ও একে মেরেছে। এরপর একে তার নেক আমল থেকে দেওয়া হবে, ওকে নেক আমল থেকে দেওয়া হবে। এরপর তার কাছে (পাওনাদারের) প্রাপ্য তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না গেলে তাদের পাপের একাংশ তার প্রতি নিক্ষেপ করা হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[ মুসলিম হা/২৫৮১]
গীবতকারীর পরকালীন শাস্তির ধরণ : হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যখন আমাকে মে’রাজে নিয়ে যাওয়া হলো তখন আমি সেখানে এমন লোকেদের কাছ দিয়ে অতিক্রম করলাম, যাদের নখ ছিল তামা দিয়ে তৈরি। তারা সেসব নখ দিয়ে তাদের মুখমন্ডল ও বক্ষ খোঁচাচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরীল! এরা কারা? জিবরীল আলাইহিস সালাম বললেন, এরা সেসব লোক, যারা (গীবত করার মাধ্যমে) মানুষের গোশত খায় এবং মানুষের মান-সম্মানে আঘাত হানে’। [আবূদাঊদ হা/৪৮৭৮]
যে সব ক্ষেত্রে গীবত করা যায় বা যা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয় : যদি নিন্দা করার পিছনে যুক্তিসঙ্গত বা শরী‘আত সম্মত কোন কারণ থাকে, তবে সেই ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয। কিছু এমন অবস্থা আছে যেখানে গীবত করা যায়, আবার কখনও তা আবশ্যকও হয়ে পড়ে। যেমন মানুষকে সতর্ক ও সাবধান করার জন্য দোষ-ত্রæটি বর্ণনা করা ক্ষেত্রবিশেষে অবশ্যক। হাদিস শরীফের মান নির্নয়ের ক্ষেত্রে রাবী বা বর্ণনাকারীর অবস্থার বিবরণ তুলে ধরা, বিবাহ-শাদীর ক্ষেত্রে বর ও কনে নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তাদের সম্পর্কে সত্য ও সুস্পষ্ট তথ্য দেওয়া আবশ্যক।আনুরূপভাবে আমানতের খিয়ানতকারী ও অসৎ লোকের সাথে লেন-দেন, ব্যবসা-বানিজ্য করা থেকে সাবধান করা অপরিহার্য। এভাবে আরো কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে দোষ বর্ণনা করা হারাম নয়; বরং তখন দোষ বর্ণনা করা অপরিহার্য হয়ে যায়। যেমন- বিচারকের কাছে চোর, ডাকাত ও যালিমের বিরুদ্ধে নালিশ করা। অনুরূপভাবে আলেম বা মুফতীর কাছে কোন বিষয়ে ফতওয়া জানার জন্য সে বিষয়ে বিশদ বর্ণনা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
গীবত করাও যেমন হারাম অনুরূপ গীবত শোনাও হারাম : গীবত করা যেমন মহাপাপ তেমনি খুশি মনে পরনিন্দা শোনাও পাপ। মহান আল্লাহ মুমিনদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেন, ‘তারা যখন অসার বাক্য শ্রবণ করে তখন যেন তা উপেক্ষা করে’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৫)। তাই গীবতকারী এবং গীবত শ্রবণকারী উভয়ই সমান পাপী’।

গীবতের অপরাধ থেকে দ্বায়মুক্তির উপায় কী ?
আমরা জানি, গীবত, চোগলখুরী, চুরি-ডাকাতি, যুলুম, আত্মসাৎ ইত্যাদি যেহেতু বান্দার অধিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট পাপ, তাই সে সকল পাপের দায়বদ্বতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বান্দার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে অথবা তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে দায়মুক্ত হতে হবে এবং ওই ব্যক্তির জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে অধিকহারে দুআ করতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহর কাছেও ক্ষমাপ্রার্থনা ও তওবা-ইস্তিগফার করতে হয়।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ