মইনুদ্দিন জামাল চিশতী
নিখিল বিশ্বের মহান রব তার বান্দাগণকে সিরাতুল মুস্তাকিমের পথের উপর অটল থেকে উভয় জগতে সাফল্যমন্ডিত হওয়ার মহান সুযোগ গ্রহনের নিমিত্তে যুগে যুগে বহু নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। সর্বশেষ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর আগমনের মাধ্যমে নবুয়তী ধারা বন্ধ হলেও বহমান রয়েছে বেলায়তের ধারা। আর এই বেলায়তের ধারক মহান সত্যবাদীগনের অনুসৃত পথে অনুসারী হওয়ার জন্য মহান আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআন মাজীদের সুরা তাওবা’র ১১৯ নং আয়াতে বলেন, ‘হে মু’মিনগণ আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গ অবলম্বন করো।’
সত্যবাদী সেসব মহান সত্ত¡া, যারা মহান আল্লাহ্ পাক ও তার প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রেমে নিজেকে বিসর্জন দিয়ে ইসলাম তথা কোরআন-সুন্নাহ’র ঈমানী বার্তা যুগের পর যুগ দেশ হতে দেশান্তরে পৌছে দিচ্ছেন। ১৪০০ বছর আগের ইসলাম আজ সারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে প্রতিষ্ঠিত মহান আল্লাহ্ পাক ও প্রিয় রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর প্রেরিত সূফী-সাধক, পীর, বুজুর্গ, ফকির, দরবেশদের মাধ্যমে।
রাসূলুল্লাহ (দ) এর প্রদত্ত ইসলামের বাণীকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার মিশনে পাক-ভারত উপমহাদেশ তথা সমগ্র হিন্দুস্তান জুড়ে আতায়ে রাসূল, খাজা গরীবে নেওয়াজ হযরত মইনুদ্দিন চিশতী হাসান আজমেরী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)’র আগমন, বাংলার এ প্রদেশে হযরত শাহ জালাল ইয়ামেনী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) থেকে শুরু করে বহু মহান আউলিয়া কেরাম, আউলাদে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও বিজ্ঞ আলেম-ওলামাদের আগমনে ইসলামের আলো নিয়ে সিরাতুল মুস্তাকিমের সুধা পান করিয়েছেন। বার আউলিয়ার স্মৃতিধন্য পূণ্যভূমি চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলা অনেক আল্লাহর ওলীর পদধূলিতে ধন্য হয়েছে। রাউজানের অন্যতম একটি প্রসিদ্ধ এলাকার নাম পশ্চিম রাউজান-ফকির তকিয়া গ্রাম। আমাদের গ্রাম যেন একখÐ শান্তির নীড়। এখানেই আমাদের জন্ম, এই গ্রামের আকাশে বাতাসে এক মোহময় সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। রাউজান পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত আমাদের এই এলাকাটি গ্রাম হলেও শহরের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। সবুজের সমারোহে এই এলাকার হৃদয়কাড়া সৌন্দর্য সকলকে মায়ার জালে জড়িয়ে রাখে। মহান আল্লাহ্ পাকের অপার অনুগ্রহে এ অঞ্চলে দিকহারা মানুষকে সঠিক পথের দিশা দিতে আগমন হয়েছে একজন মহান তাপসের, যার সান্নিধ্যে এসে দিশেহারা মানুষ পেয়েছে ঈমানের স্বাদ, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সুন্নাতে মোস্তফা (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর চর্চা। আর তিনি হলেন মহান রবের মাহবুব, বিখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক, ফকির তকিয়া দরগাহ শরীফের আধ্যাত্মিক শরাফতের মহান প্রবক্তা হযরত মাওলানা হাফেজ ক্বারী শাহ সূফী হযরত গফুর আলী বোস্তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি)।
ধারণা করা হয় তিনি ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে পারস্য তথা ইরানের বোস্তাম নগরী হতে ইসলামের আলোর বার্তা নিয়ে এসেছিলেন আমাদের এই বাংলাদেশে। তিনি বাংলাদেশে আগমন করার পর সফর করতে থাকেন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। একসময় তিনি মহান আল্লাহ্ পাকের প্রেমে বিভোর হয়ে কঠিন ধ্যান সাধনায় মগ্ন হওয়ার জন্য মনোনিবেশ করেন। এরপর নিরিবিলি, নির্জন ও জনবিচ্ছিন্ন এলাকায় সফর করতে থাকেন। আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সফর করতে করতে একদিন এসে পৌঁছেন আমাদের গ্রামে। তিনি পছন্দ করেছিলেন ফকির তকিয়ার এই পবিত্র মাটি, এই এলাকার মানুষ কতই না ভাগ্যবান এমন মহান আধ্যাত্মিক সাধকের পদধূলি পেয়ে!
ফকির তকিয়া এলাকাটি সেকালে কিছুই ছিল না, এমনকি কোন জনবসতির চিহ্ন পর্যন্ত ছিল না। ছিল শুধু ঘন বন আর জঙ্গল। যেখানে বাঘ, হরিণ, হাতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আশ্রয় ছিল। এমন জনমানবহীন গহীন অরণ্যে মহান আল্লাহ পাকের ইবাদত ও কঠোর রিয়াজতে ধ্যানমগ্ন ছিলেন হযরত গফুর আলী বোস্তামী (রহ.)। একাধারে দীর্ঘদিন ধ্যানমগ্ন থাকা অবস্থায় একদিন কিছু লোক দল বেধে সেই পথে বিভিন্ন গাছ-বাঁশ সংগ্রহ ও বিভিন্ন প্রাণী শিকার করতে যায়। যেতে যেতে তারা সেই ঘন বনজঙ্গলের একেবারে গভীরে পৌছে যায়। হঠাৎ তারা একটি দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। তারা দেখতে পায় একজন সুন্দর নূরানি ছুরতের দরবেশ একাকী চোখ বন্ধ অবস্থায় মহান আল্লাহ্ পাকের জিকিরে ইলাহীতে বিভোর হয়ে আছেন। এমন একটি জনমানবহীন নির্জন পরিবেশে একজন মহান ফকির-দরবেশকে ধ্যান করতে দেখে তারা অবাক হয়ে যায়। তারা ভেবে ক‚লকিনারা পাচ্ছে না, কিভাবে একা একজন মানুষ এখানে আসলেন! তিনি খাবার-পানি ছাড়া এখানে কিভাবে দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন। এরপর তারা হযরত গফুর আলী বোস্তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর নিকট এসে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের মধ্যে কয়েকজন পবিত্র ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
এরপর থেকে এই মহান আধ্যাত্মিক সাধকের পরিচিতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। দলে দলে লোকজন আসতে থাকে হুজুরকে এক নজর দেখার জন্য। কথিত আছে, বন-জঙ্গলের হিংগ্র প্রাণীরা পর্যন্ত সন্ধ্যা নামলে ফকির তকিয়া দরগাহ শরীফে হযরত মাওলানা গফুর আলী বোস্তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর দরবারে হাজিরা দিতে আসতো। অনেক উচুঁ মাপের এই মহান আল্লাহর ওলীর বহু কারামত প্রকাশ পেয়েছে। স্থানীয় লোকমুখে এমন অনেক কারামতের কথা শুনতে পাওয়া যায়। তিনি কাশফ (আল্লাহ্ প্রদত্ত বিশেষ অলৌকিক শক্তি) ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন এবং একই সাথে কয়েকটি স্থানে হযরত গফুর আলী বোস্তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) কে অনেকে দেখতে পেয়েছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।
আমাদের এলাকায় সেই সুদূর ইরানের বোস্তাম নগরী থেকে এসে ইসলামের যে আলো তিনি জ্বালিয়েছিলেন, সে আলোয় আজ চারিদিক আলোকিত হয়েছে। এই মহান অলিয়ে কামেলের পবিত্র মাজার শরীফ কে ঘিরে আজ এখানে গড়ে উঠেছে একটি বিশাল জামে মসজিদ। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি মাদ্রাসা, হেফজখানা ও এতিমখানা। তাছাড়াও এই মহান আধ্যাত্মিক সাধকের দরগাহ শরীফ সংলগ্ন এককালের বন-জঙ্গল বেষ্টিত এলাকাটি এখন জ্ঞানীগুণী ও বুজুর্গ আলেম-ওলামাদের পদচারণায় একটি সুন্দর জনপদে পরিণত হয়েছে। যদি হযরত গফুর আলী বোস্তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) আমাদের এলাকায় শুভাগমন না করতেন, তবে আজকের এতসব পরিবর্তন কিছুই হয়তো সম্ভব হতো না। এখান থেকে ইসলামের শান্তির সুবাতাস বইছে সমগ্র এলাকায়। এছাড়াও, ১৯৫৪ সনে এই এলাকায় কদম রেখে ধন্য করেছিলেন পাকিস্তান সিরিকোট দরবার শরীফের মহান প্রতিষ্ঠাতা, আওলাদে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), হযরত আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), ১৯৬৭ সনে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ সংস্কারক, জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (দ) এর প্রতিষ্ঠাতা হযরত আল্লামা আলহাজ্ব সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি), গাউসে জামান হযরত আল্লামা আলহাজ্ব সৈয়্যদ মুহাম্মদ তাহের শাহ (মাদ্দাজিল্লুহুল আলী) ও পীরে বাঙ্গাল আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ সাবের শাহ (মাদ্দাজিল্লুহুল আলী)।
সবচেয়ে বড় সৌভাগ্যের কথা হল, আমাদের এখানেই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন মহান রবের একজন শ্রেষ্ঠ মাহবুব, যিনি এখন আমাদের আত্মার আত্মীয়, মুক্তির দিশারী, আলোর প্রগ্রবণ। আমাদের এলাকার কোন মানুষ যখন সমস্যায় থাকে কিংবা বিপদগ্রস্ত হয় তখন সবার আগে ছুঁটে যায় ফকির তকিয়া দরগাহ শরীফে। অন্যায়-অবিচারে যখন মজলুম মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে, তখন মনের আকুতি দিয়ে আল্লাহ্র দরবারে আর্জি জানায় অলি-আল্লাহ্দের মাধ্যমে। আর তাই এখনো পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এসে শ্রদ্ধা, সম্মান ও হৃদয়ের সকল ভালবাসা উজাড় করে দেয় ফকির তকিয়া দরগাহ শরীফে এসে।
প্রতি বছর চৈত্র মাসের প্রথম তারিখ (১৫ মার্চ) হযরত গফুর আলী বোস্তামী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর বার্ষিক ওরশ শরীফ রাউজান ফকির তকিয়া দরগাহ প্রাঙ্গনে শরিয়ত সম্মতভাবে পালন করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ভক্তবৃন্দ। খতমে কোরআন, খতমে বুখারী শরীফ, খতমে গাউসিয়া শরীফ, মিলাদ-মাহফিল সহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয় বার্ষিক ওরশ মোবারক। শত বৎসর ধরে পালন করা হচ্ছে এই ওরশ শরীফকে ঘিরে পুরো এলাকাজুড়ে তৈরী হয় একটি পবিত্র পরিবেশ। এবছর ওরশ শরীফ আয়োজন হচ্ছে পবিত্র রমজান মাসে, এজন্য সকল ভক্ত-জায়েরীনদের জন্য সেহেরির ব্যবস্থা করা হয়েছে দরগাহ পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে। পরিশেষে বিশ্ববিখ্যাত সূফি মহাগ্রন্থ মসনবী শরীফের রচয়িতা, মাওলানা জালালুদ্দীন রুমী (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি) এর রচিত একটি পঙক্তি উল্লেখ করছি, ‘এক জামানা ছোহবতে বা আউলিয়া,
বেহতর আজ ছদ ছা’লা তা’আত বেরিয়া।’
অর্থাৎ- ‘কিছুক্ষণ আল্লাহ্র অলীদের সান্নিধ্যে বসা, শত বৎসরের নিখাদ ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।’ মহান আল্লাহ্ পাক আমাদেরকে সবসময় তার প্রিয় রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ও গাউস, কুতুব, সূফী, সাধক, ফকির, দরবেশ, আলেম-ওলামাদের পথে তথা সত্যিকারের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত এর উপর আমৃত্যু অটল থেকে উভয় জগতে নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান হওয়ার তৌফিক দান করুক-আমিন।
লেখক : সূফী গবেষক