এইচএসসি, আলিম ও সমমানের পরীক্ষা ২০২৪ এর ফল প্রকাশিত হয়েছে। সাধারণ শিক্ষা বোর্ড-এ পাসের হার ৭৭.৭৮ শতাংশ। অপরদিকে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এ পাশের হার ৯৩.৪০ শতাংশ ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এ পাশের হার ৮৮.০৯ শতাংশ। গতকাল মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বেলা ১১টায় স্ব স্ব বোর্ডের ওয়েবসাইট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একযাগে এ ফল প্রকাশ করা হয়। সবগুলো শিক্ষা বোর্ড মিলে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে এক লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ শিক্ষার্থী। গত ৩০ জুন থেকে সারা দেশে একযোগে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়। ১১ বোর্ড মিলে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে, ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৭৯০ জন। বৈষম্য বিরোধি ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতার কারণে গত ১৮, ২১, ২৩ ও ২৫, ২৮ জুলাই ও ১ ও ৪ আগস্টের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। সবশেষে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন সূচিতে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নতুন করে আর পরীক্ষা না নিয়ে যেগুলো হয়েছে সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে এইচএসসির ফলাফল প্রকাশের দাবি নিয়ে শত শত পরীক্ষার্থী নজিরবিহীনভাবে ২০ আগস্ট দুপুরে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে। পরে তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় অবশিষ্ট পরীক্ষা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়। কীভাবে ফলাফল প্রকাশ হবে, তা নিয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠিত বিষয়গুলো পূর্ণ মানে এবং বাতিল হওয়া পরীক্ষাগুলোর ক্ষেত্রে শুধু পরীক্ষার্থীদের এসএসসিতে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে সাবজেক্ট ম্যাপিং করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। গতকাল অনলাইনে প্রকাশিত খবওে জানা গেছে, এবার সাধারণ শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম পাশ করেছে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড এ। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় পাসের হার ৭০ দশমিক ৩২ শতাংশ। পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ১ লাখ ৬ হাজার ২৯৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে পাস করেছেন ৭৪ হাজার ১২৫ জন। জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১০ হাজার ২৬৯ জন। গতবার পাসের হার ছিল ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ। গেলবারের তুলনায় এবার পাসের হার ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ কম। চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড এর এসএসসি ও এইচএসসি ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে একধরণের হতাশা নেমে আসে। অন্য শিক্ষা বোর্ড যেখানে ভালো ফল কওে সেখানে আমরা পিছিয়ে কেন ? শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষও এসব বিষয়ে নিয়মিত ব্রিফ করেন। এবং চট্টগ্রামের ভু-প্রাকৃতিক অবস্থা যেমন পার্বত্য জেলা ও কক্সবাজার জেলার দর্গম এলাকার উদহারণ দিয়ে দায় শেষ করেন। বাস্তবতা হলো উচ্চ শিক্ষার জন্য যত অবকোঠামোই তৈর করা হোক না কেন, শিক্ষার যারা কারিগর তাদের অবস্থান তৃনমূলে নেই বললেই চলে। শিক্ষক সংকট এক্ষেত্রে বড় বাঁধা। চট্টগ্রামের পার্বত্য জেলাসহ রিমোর্ট এলাকায় শিক্ষক সংকট দূর করতে পারলে ফলাফলেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে-আশা করা যায়। এছাড়া শিক্ষার মান নিয়ে হতাশাও দিনদিন বেড়ে চলছে। এমন একটি সময় ছিল যখন এলাকায় একজন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেলে তাকে সবাই দেখতে আসত। সংবাদপত্র টেলিভিশন সাংবাদিকরা আসত সাক্ষাৎকার নিতে। কীভাবে সে পড়ল, তার এত দূর আসার অনুপ্রেরণা কে। আরো কত কি প্রশ্ন। পত্রিকা ও টেলিভিশনে বড় করে হেডলাইনে জিপিএ-৫ ধারীদের ছবি ছাপা হতো। এগুলো আমার দেখা নয়, বাপ-দাদাদের থেকে শোনা কথা হলেও বাস্তবসম্মত একটি সত্যি ঘটনা। কালের বিবর্তনে আজ জিপিএ-৫ ধারীর সংখ্যা লাখ লাখ। তাই আজ আর কেউ জিপিএ-৫ পেলে তার বাসায় সাংবাদিক আসে না। তাকে টিভি কিংবা পত্রিকায়ও ছাপায় না। যদি সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সবাই জিপিএ-৫ পায় তাহলে আমরা গর্ব করতে পারতাম। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এমন অনেক জিপিএ-৫ ধারী রয়েছে জিপিএ-এর পূর্ণরূপ জানে না। প্রকৃতপক্ষে অনেক জিপিএ-৫ ধারী জিপিএ-৫ পাওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কিন্তু করোনা কিংবা বিভিন্ন কারণবশত তাকে জিপিএ-৫ পাওয়ার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে এসে এই এ প্লাসধারী কতটুকু যোগ্যতার সাক্ষ্য রাখতে পারছে? স¤প্রতি প্রকাশিত হলো ২০২৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার ফল। এবার এইচএসসিতে গড় পাসের হার প্রায় ৭৮ শতাংশ। যদিও পাসের হার কমেছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ভালো ফলাফল পাওয়ায় আনন্দ-উল্লাসে ভাসছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তবে তাদের আকাশে চিন্তার মেঘও জমতে শুরু করেছে। কেননা কিছুদিন পরই শুরু হবে ভর্তিযুদ্ধ। আর এতে জিপিএ-৫ পেয়েও অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সা¤প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায়, স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার। ওই প্রতিষ্ঠানের মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পান এবং মাত্র ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছেন। দুই বছর আগেও বিশ্বব্যাংক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর জরিপ করেছিল। তাতেও দেখা গেছে, স্নাতক পাস করা শিক্ষার্থীদের ৪৬ শতাংশ বেকার, যারা ৩ বছর ধরে চাকরি খুঁজছেন। সরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের গবেষণায় দেশে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী তরুণদের এক-তৃতীয়াংশ পুরোপুরি বেকার বলে যে তথ্য উঠে এসেছে, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ বেকারত্ব কমাতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের চিত্র অনেকটাই বিপরীত। এ দেশে শিক্ষিতের বেকার হওয়ার আশঙ্কা অশিক্ষিতদের তুলনায় বেশি। কারণ অশিক্ষিত বেকার জনগোষ্ঠী যে কোনো কাজ করতে সক্ষম। কিন্তু শিক্ষিত একজন তরুণ চাইলেই যে কোনো কাজ করতে পারেন না। তাই শিক্ষিত জনশক্তির জন্য কর্মসংস্থান বর্তমান একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখনই সময় শিক্ষাব্যবস্থায় লাগাম টানার। পাস কিংবা জিপিএ মুখ্য নয়, বরং প্রতিটি শিক্ষার্থী যেন প্রকৃত শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হয়ে উঠতে পারে সেটি আমাদের বড় লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন।
সবর্শেষ এইচ.এস.সি পরীক্ষায় ২০২৪-এ যারা উত্তীর্ণ হয়েছে তাদেরকে আন্তরিক অভিনন্দন।