ঊর্ধ্বমুখী চালের বাজারে নিম্ন-মধ্যবিত্তের নাভিশ্বাস

26

লকডাউনে বেশিরভাগ চাপ পড়েছে খেটে খাওয়া মানুষের উপর। কোন কাজ নেই তাদের। অথচ জীবন ধারণের সব জিনিসপত্রের দাম আকাশচুম্বী। চাল তার মধ্যে অন্যতম। আগে থেকেই অস্থির চালের বাজারে গত এক সাপ্তাহ ধরে নতুন করে মূল্য অস্থিরতা ভর করেছে। শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি পর্যায়ে আমদানি শুরুর পর কিছুটা কমে এসেছিল চালের বাজার। কিন্তু কাঙ্খিত দাম না কমায় চালের শুল্ক আরও কমিয়ে ১০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছিল। এরপরও দমেনি চালের দাম। তবে পর্যাপ্ত আমদানি না হওয়া, বৈশ্বিক বাজারে দাম বৃদ্ধি এ জন্য দায়ী অনেকখানি। সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধিতে দেশব্যাপী লকডাউন এবং সর্বশেষ ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক সাধারণ ছুটি ঘোষণায় অস্থির হয়ে উঠে চালের বাজার। এরমধ্যে গেল সাত দিনের ব্যবধানে চালের পাইকারি ও খুচরায় দাম বেড়েছে বস্তাপ্রতি প্রায় ২০০ টাকা। মূলত অল্প সময়ে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি চাহিদা, পর্যাপ্ত মজুদের অভাব, সরবরাহ লাইনে ঘাটতির কারণে পণ্যটির দাম বেড়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন আড়তে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ গত ৫ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। এরপর থেকে সারাদেশের পাইকারি ও খুচরা বাজারে চালের সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। মূলত ব্যবসায়িকভাবে পাইকারিতে চালসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম নির্ধারিত হয় সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, বাকিতে পণ্য বিক্রি কিংবা চেকের বিপরীতে সরবরাহ চুক্তির মাধ্যমে। স্বাভাবিক সময়ে চালের বড় মোকামগুলোতে একটি বা দুটি লেনদেন বাকিতেই পরিচালিত হয়। পণ্য ক্রয়ের পর সেটি মোকামে আসলে বিক্রি সাপেক্ষে কিস্তিতে চেক নগদায়নের মাধ্যমে লেনদেন এগিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু লকডাউন ঘোষণার পর মোকাম থেকেই বাকিতে পণ্য বিক্রি কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া হঠাৎ করেই বাড়তি চাহিদা ছাড়াও ব্যাংকিং লেনদেনের সময়সীমা কমে যাওয়ায় দেশের ভোগ্যপণ্য বাজারে নগদ অর্থের সাময়িক সংকট দেখা দিয়েছে। যার কারণে মিল পর্যায় থেকে পাইকারি বাজার এমনকি খুচরা বাজারেও বাকিতে নিত্যপণ্য বিক্রির পরিমাণ কমে গেছে। যার প্রভাবে চালের বাজার ঊর্ধ্বমুখী বলে মনে করছেন বাজার সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে খাতুনগঞ্জ এলাকার পাইকারি চাল ব্যবসায়ী ওমর আজম জানান, ১৪ এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের আগে প্রায় প্রতি বস্তা চালের দাম বেড়েছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। নতুন আমদানিকৃত চালের পাশাপাশি আমন মৌসুমের উৎপাদিত নতুন চালের দামও বর্ধিত দামে বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে। পাইকারি বাজারে বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারে পাইকারি বর্ধিত দামের চেয়েও বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। যার প্রভাবে লকডাউনের আগে চাল ক্রয়ে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের। এ অবস্থায় বাড়তি এ দামকে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য মরার উপর খাড়ার ঘা বলে উল্লেখ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাজার থেকে পাওয়া তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে জিরা সিদ্ধ চালের দাম বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) ১৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ১৫০ টাকায়, পারি সিদ্ধ (নতুন) ৫০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৩৫০ টাকায়, পারি সিদ্ধ (পুরাতন) ৫০ থেকে ৭০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৪৭০ টাকায়, স্বর্ণা সিদ্ধ প্রায় ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ২৯০ টাকায়, মিনিকেট সিদ্ধ ১৬০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ৫৬০ টাকায়, কাটারি সিদ্ধ (২৫ কেজির বস্তা) ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ৭০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আর আতপ চালের মধ্যে বেতি আতপ (পুরাতন) বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৭০০ টাকায়, নতুন বেতি আতপ বিক্রি হচ্ছে মানভেদে ২ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার ৬০০ টাকায়, মিনিকেট আতপ ১৫০ টাকা বেড়ে ৩ হাজার ১০০ টাকায়, ইরি আতপ ১৬০ টাকা বেড়ে ২ হাজার ১৫০ টাকায়। তাছাড়া ভারত থেকে আমদানি হওয়া বেতির কস্টিং মূল্য কম হলেও বর্তমানে পাইকারি বাজারে এই মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৩৫০ টাকায়। অন্যদিকে ভারত থেকে আমদানি হওয়া নাজির সিদ্ধ চালের ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৪৭০ থেকে ১ হাজার ৪৮০ টাকায়। কয়েকদিন আগেও ভারতীয় এই চালটির ২৫ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৩৫০ টাকা দরে। মূলত লকডাউন শুরু হলে দেশের উত্তারঞ্চল থেকে চাল সরবরাহ কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে সারাদেশের পাইকারি বাজারগুলোতে প্রতিদিনই চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খাদ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৭ নভেম্বর থেকে আমন সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয়। চলতি বছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত ৭০ হাজার ১৩৬ টন আমন সিদ্ধ চাল, ৪ হাজার ৮৬৩ টন আতপ চাল এবং ১২ হাজার ৩৪২ টন আমন ধান সংগ্রহ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সরকারি পর্যায়ে চাল সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৮৩ হাজার ২০২ টন। সরকারি পর্যায়ে গত কয়েক মৌসুম ধরে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। ২০২০ সালের বোরো মৌসুমে সরকার ১৮ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সরকার ১০ লাখ টনের বেশি চাল সংগ্রহ করতে পারেনি। এর মধ্যে সরকারি চালের মজুদ ৫ লাখ টনের নিচে নেমে আসলে বেসরকারিভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে চাল আমদানির সুযোগ দেয় সরকার।
এ বিষয়ে চকবাজার এলাকার বাসিন্দা আনু মিয়া জানান, গত ছয় মাস আগে শঙ্খ মার্কা বাসমতি চাল কিনেছি (৫০ কেজি বস্তা) ২২০০ টাকায়। ছয়মাসের ব্যবধানে একই চাল এখন ৩১৮০ টাকা। যা দুই মাস আগেও ২৮০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ ছয়মাসের ব্যবধানে প্রতিবস্তা চালের দাম ১০০০ টাকা বেড়ে গেছে। গত এক সপ্তাহে দাম বৃদ্ধি হয়েছে উল্লেখ করার মতো।