সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
ইসলাম পরিপূর্ণ এক জীবন ব্যবস্থার নাম। এতে মানবজীবনের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমÐলের যাবতীয় বিষয়ের সমাধান বিদ্যমান। ইসলাম মানুষের জন্য যা কল্যাণকর ও হিতকর সে বিষয় বৈধ করত: সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং যাবতীয় অকল্যাণ ও ক্ষতিকর বিষয় হতে মানবজাতিকে সর্তক করেছে। আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশিত ও অনুমোদিত পথে যে আয়-রোযগার করা হয় তাকে হালাল উপার্জন বলে। আর অবৈধভাবে অন্যের মাল হস্তগত ও উপভোগ করাকে হারাম উপার্জন বলে।
ইসলামের দিক-নির্দেশনা হ’ল হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করতে হবে এবং উপার্জনের পন্থাও অবশ্যই শরীয়ত নির্ধারিত পন্থায় হতে হবে। এমন উপার্জনকে ইসলাম অবৈধ ঘোষনা করেছে; যাতে প্রতারনা, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, অকল্যাণ ও জুলুম রয়েছে। তাই সূদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, জুয়া, মিথ্যাচার ইত্যাদি অসামাজিক অনাচারে লিপ্ত হয়ে জীবিকা উপার্জন করা ইসলাম সমর্থন করেনা।
বস্তুতঃ ইসলামে হারামের পরিধি অত্যন্ত সংকীর্ণ এবং হালালের ক্ষেত্র সুবিস্তীর্ণ ও সুপ্রশস্ত। দুনিয়ার জীবনে অবৈধ পন্থায় উপার্জন করে সুখ-সাচ্ছন্দ লাভ করলেও পরকালীন জীবনে রয়েছে এর জন্য জবাবদিহিতা ও সুবিচার। সে লক্ষে ইসলাম হালাল উপার্জনের অপরিসীম গুরুত্ব প্রদান করেছে।
ইসলামে হালাল উপার্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :
জীবিকা নির্বাহের জন্য উপার্জনের গুরুত্ব ইসলামে যেমনি রয়েছে, ঠিক তেমনি হালাল উপার্জনের গুরুত্বও অত্যাধিক। ইসলাম মানুষের জন্য যাবতীয় জীবনোপকরণকে সহজসাধ্য, সুস্পষ্ট ও পবিত্র করার নিমিত্বে সঠিক ও বৈজ্ঞানিক নির্দেশনা দিয়েছে। অতএব নির্দেশনা বহির্ভূত যাবতীয় উপার্জনই হারাম বা অবৈধ হিসেবে বিবেচিত।
হালাল উপার্জন ইসলামী জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মহান আল্লাহ তা‘আলা তাঁর নির্ধারিত ফরয ইবাদত (যেমন নামায) সম্পন্ন করার পর জীবিকা অন্বেষনে জমীনে ছড়িয়ে পড়তে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, “অতঃপর যখন নামায সমাপ্ত হবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় আর আল্লাহর অনুগ্রহ হতে অনুসন্ধান কর এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফল হতে পার।’’ [সুরা আল-জুমু‘আ: ৬২:১০।]
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি হালাল উপার্জিত খাবার খায় ও সুন্নাতের উপর আমল করে এবং মানুষ তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’’। [তিরমীযি-২৫২০]
তিনি আরও এরশাদ করেন, ‘নিজের উপার্জিত আহার সর্বোত্তম। তোমাদের সন্তানও নিজ উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত’।(ইবনু মাজাহ হা/১৭৩৮)
তিনি আরও এরশাদ করেন, “কিয়ামতের দিন আদম সন্তানকে পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও স্বস্থান হতে নড়তে দেওয়া হবে না। ১. তার জীবনকাল কিভাবে অতিবাহিত করেছে, ২. যৌবনের সময়টা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৩. ধন সম্পদ কিভাবে উপার্জন করেছে, ৪. তা কিভাবে ব্যয় করেছে, ৫. সে দ্বীনের যতটুকু জ্ঞান অর্জন করেছে সেই অনুযায়ী আমল করেছে কিনা।’’ (তিরমিযী-২৪১৬ )
হালাল উপার্জনের মূলনীতি :
ইসলামে উপার্জনের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় মূলনীতি রয়েছে। এ নীতিগুলো অনুসরণ না করলে উপার্জন হালাল হবে না। যা নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো :
১. উপার্জেয় বস্তুটি হালাল হওয়া।
২. উপার্জেয় বস্তুটি পবিত্র হওয়া।
৩. উপার্জনের মাধ্যমটি বৈধ হওয়া।
শুধুমাত্র উপার্জেয় বস্তটি হালাল ও পবিত্র হলে যথেষ্ট নয়, বরং উপার্জনের মাধ্যমটিও বৈধ হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন, “হে যারা ঈমান এনেছ, তোমরা পরস্পরের মধ্যে তোমাদের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে খেয়ো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসার মাধ্যমে হলে ভিন্ন কথা।’’[সূরা আন-নিসা: ৪:২৯।]
হালাল উপার্জনের ক্ষেত্রে যা আবশ্যক :
সততা ও আমানতদারিতা :
উপার্জন হালাল করার ক্ষেত্রে সততা ও আমানতদারিতা থাকতে হবে। উপার্জেয় বস্তু হালাল এবং পদ্ধতিগতভাবে হালাল হলেও সততা ও আমানতদারিতা না থাকলে উপার্জন হালাল হবে না। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “সৎ ও আমানতদার ব্যবসায়ী (কিয়ামতের দিন) নবীগণ, সিদ্দিকগণ ও শহীদগণের সাথে থাকবে।” [তিরমিযী: ১২০৯।]
তিনি আরও এরশাদ করেন, “চারটি জিনিস যখন তোমার মধ্যে পাওয়া যাবে তখন দুনিয়ার অন্য সব কিছু না হলেও কিছু যায় আসে না। তা হলো, আমানতের সংরক্ষণ, সত্য কথা বলা, সুন্দর চরিত্র, হালাল উপার্জনে খাদ্যগ্রহণ’’ [মুসনাদ আহমদ: ৬৬৫২।]
ওয়াদা পালন করা :
চাকরি বা ব্যবসায় যেসব ওয়াদা করা হবে তা অবশ্যই পালন করতে হবে। ওয়াদাপূরণ জান্নাতে যাওয়ারও একটি ওসীলাহ। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘তোমরা আমাকে ছয়টি বিষয়ের নিশ্চয়তা দাও, আমি তোমদেরকে জান্নাতে নিয়ে যাবার দায়িত্ব নেব। যখন কথা বলবে সত্য বলবে, যখন ওয়াদা করবে তা পূরণ করবে, যখন আমানত গ্রহণ করবে তখন তা আদায় করবে, তোমাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করবে, তোমাদের চক্ষুগুলো নীচু করে রাখবে এবং হাতগুলো নিয়ন্ত্রনে রাখবে’।[সহীহ ইবন হিব্বান-২৭১]
হারাম উপার্জনের ক্ষতিকর দিকসমূহ :
ক. আল্লাহর নির্দেশ অবজ্ঞা করার শামিল : যারা হালাল ও হারামের প্রশ্নে সতর্কতা অবলম্বন করে না, তাদের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করে বলেন, “মানুষের নিকট এমন একটি সময় আসবে, যখন ব্যক্তি কোনো উৎস থেকে সম্পদ আহরণ করছে, তা হালাল না হারাম, সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করবে না।’[বুখারী-২০৫৯।]
খ. জাহান্নামে যাওয়ার কারণ : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে ওঠে তার জন্য দোযখের আগুনই উত্তম’’।[জামিউস সাগীর-৮৬৪৮।]
গ. জান্নাতে যাওয়ার প্রতিবন্ধক : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “হে কা‘ব ইবন উজরাহ, যে দেহ হারাম খাদ্য দ্বারা গড়ে উঠে তা জান্নাতে যাবে না’’।[দারেমী, আস-সুনান, হাদীস নং ২৮১৮]
ঙ. হারাম উপার্জনের দান আল্লাহ গ্রহণ করেন না : নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “আল্লাহ তা‘আলা পবিত্রতা ছাড়া কোনো নামায কবুল করেন না, আর হারাম উপার্জনের দানও আল্লাহ তা‘আলা কবুল করেন না।’’[সহীহ ইবন খুযাইমাহ- ১০।]
হালাল উপার্জন ইবাদত ও দুআ কবুলের পূর্বশর্ত :
ইবাদতের জন্য মানবদেহে শক্তি প্রয়োজন, আর শক্তির প্রধান উৎস হলো খাদ্য। কিন্তু এ উপকরণ ক্রয়ের অর্থ যদি অবৈধ উপায়ে উপার্জিত হয় তখন তা তার শরীরের রক্তে ও মাংসে সংমিশ্রন ঘটে। যা দ্বারা যত ইবাদতই করা হোক না তা গ্রহনযোগ্য হতে পারে না। কেননা আল্লাহ অপবিত্র কোন কিছুই গ্রহণ করে না। সালাত, যাকাত ও হজ্জ ইত্যাদি ফরয ইবাদতসমূহ কবুল হওয়ার জন্য অবশ্যই বৈধ পন্থায় উপার্জন করতে হবে।
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি একমাত্র পবিত্র বস্তুকেই কবুল করেন। আল্লাহ রাসূলগণকে যে আদেশ করেছেন, মুমিনগণকেও সেই আদেশ করেছেন। অতঃপর তিনি বলেন, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা হালাল পবিত্র খাদ্য ভক্ষণ কর এবং সৎ আমল কর’। তিনি আরো বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার দেওয়া হালাল পবিত্র রিযিক হ’তে খাও’। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উল্লেখ করেন, ‘কোন ব্যক্তি দূর-দূরান্তে সফর করছে, তার মাথার চুল এলোমেলো, শরীরে ধুলা-বালি লেগে আছে। এমতাবস্থায় ঐ ব্যক্তি উভয় হাত আসমানের দিকে তুলে কাতর স্বরে হে প্রভু! হে প্রভু! বলে ডাকছে। অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম, পরিধেয় বস্ত্র হারাম এবং সে হারামই খেয়ে থাকে। এই ব্যক্তির দো‘আ কিভাবে কবুল হবে’? (মুসলিম, হা-২৭৬০)
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একদা এ আয়াতটি তেলাওয়াত করা হল। “হে মানবমন্ডলী! পৃথিরীর হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী ভক্ষন কর।’’ তখন সাদ ইবন আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আল্লহর কাছে দু’আ করুন যেন আমার দু’আ কবুল হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হে সা‘দ, তোমার পানাহারকে হালাল কর, তবে তোমার দু’আ কবুল হবে।’’[মু‘জামুল আওসাত: ৬/৩১০]
উপসংহার :
পরিষেশে বলা যায়, প্রকৃত মুসলমান হিসাবে জীবন যাপন করতে হ’লে হালাল রূযীর কোন বিকল্প নেই। কারণ হালাল উপার্জন ছাড়া দুআ-ইবাদত কবুল হয়না। পাশাপাশি, হালাল পথে উপার্জিত রূযী ভক্ষণে মানুষের স্বভাব-চরিত্র সুন্দর হয়, সুকুমার বৃত্তিসমূহের বিকাশ ঘটে এবং সত্যানুরাগী হ’তে সতায়তা করে। অন্যদিকে হারাম রূযী মানুষের দেহ-মনের উপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে, নৈতিক অধঃপতনের প্রেরণা যোগায় এবং বিপথগামী হ’তে সহায়তা করে।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ