‘পর্যটন শান্তির সোপান’ শীর্ষক প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই দেশব্যাপী পালন করা হয়েছে পর্যটন দিবস। গতকাল ২৭ সেপ্টেম্বর ছিল আন্তর্জাতিক পর্যটন দিবস। পর্যটন মন্ত্রণালয় অন্যন্য দেশের মত বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসুচির মাধ্যমে পালন করেছে। প্রতিবছর দিবসটি পালন করা হলেও পর্যটন শিল্পে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা তেমন আশা ব্যাঞ্জক নয়। অথচ ভূ-প্রাকৃতিক দিক দিয়ে সুজলা সুফলা শস্য-শ্যামল বাংলাদেশ, যেখানে সাগর, নদী, খাল-বিল, পাহাড় ও সবুজ প্রকৃতিতে ভরা; যার প্রতিটি জেলা-উপজেলা পর্যটন সম্ভাবনার। কিন্তু সেই অর্থে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের উন্নয়ন হয়নি। এখাতের উন্নয়ন হলে একদিকে যেমন দেশের রাজস্ব খাত সমৃদ্ধ হতো, বিদেশি পর্যটকরা আসা যাওয়া করতো, অপরদিকে ব্যাপক হাওে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেত। পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশের কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৪১ শতাংশ বা প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে পর্যটন খাতে। এ শিল্পের মাধ্যমে দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ দশমিক ৫৬ শতাংশ বা মূল্য সংযোজন হচ্ছে ১৬ হাজার ৪০৯ কোটি টাকা। বিভিন্ন পরিসংখ্যানের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে জানা গেছে, পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত হোটেল ব্যবসা, রেস্তোরাঁ ব্যবসা, পরিবহনসহ বিনোদন খাত থেকে এ আয় হচ্ছে। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন থেকে প্রতি বছর ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ ৫১ দেশের পর্যটক বাংলাদেশে আসবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার বিভিন্ন মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ দরকার। আমরা জানি, এ শিল্পের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে অনেক শিল্প নির্ভর করে। পর্যটন একটি বহুমাত্রিক ও শ্রমঘন শিল্প। সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বৃহৎ বাণিজ্যিক কর্মকান্ড হিসেবে এ শিল্প বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় পর্যটন খাত থেকে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন সেক্টর, যেমনÑ পরিবহন, হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ, রিসোর্ট, এয়ারলাইনস ও অন্যান্য যোগাযোগের মাধ্যম থেকে পৃথিবীর অনেক দেশ প্রতি বছর প্রচুর রাজস্ব আয় করে, যা অন্য যেকোনো বড় শিল্প থেকে পাওয়া আয়ের চেয়ে বেশি। আমাদের সম্ভাবনাও প্রচুর রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। বিদেশি পর্যটক যে দেশে যত বেশি, সে দেশের পর্যটন থেকে আয় ততই বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স বা ইউরোপে বিদেশিদের আনাগোনা অনেক বেশি। তাই এসব দেশে পর্যটন থেকে আয়ের পরিমাণও বেশি। এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ডে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণও কিন্তু বিদেশি পর্যটক। ভারত ও শ্রীলঙ্কায় আমাদের চেয়ে পর্যটন খাতে আয় বেশি। কারণ এ খাতে তাদের পরিকল্পিত চিন্তাভাবনা ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
পর্যটন হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম আয়ের খাত। অনেক উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম আয়ের খাত হচ্ছে পর্যটন। পর্যটনশিল্প অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্য খরভব ইষড়ড়ফ হিসেবে কাজ করে ওইসব দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে। অধিকন্তু পর্যটন কর্মকান্ড মানুষের জন্য আনন্দের জোগান দেয়, দৈনন্দিন জীবনে কিছু সময়ের জন্য হলেও স্বস্তি আনয়ন করে এবং অবকাশ যাপনের সুযোগ সৃষ্টি করে। পর্যটনের মাধ্যমে মানুষ একে অপরকে জানতে পারে, দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে পর্যটকরা অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে এবং অন্যান্য মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে রাজনৈতিক-সামাজিক সৌহার্দ ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করতে পারে। ফলে প্রতিটি পর্যটন-গন্তব্যের সরকার এবং পর্যটন ব্যবসায়ীরা এ শিল্পকে বিশেষ গুরুত্ব দান করে তার উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ৯০ কোটি, ধরা হচ্ছে ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬০ কোটি। পর্যটন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৩ শতাংশ ভ্রমণ করবে এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজার ধরতে পারে, তা হলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। পর্যটনশিল্পে বাংলাদেশের রয়েছে অপার সম্ভাবনা।
ওয়ার্ল্ড ট্রেড অ্যান্ড ট্যুরিজম করপোরেশনের তথ্যমতে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশের জিডিপিতে পর্যটন খাতের অবদান ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৯ ভাগ। ২০২০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ বেড়ে ৪ দশমিক ১ ভাগ হবে বলে তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আবার বাংলাদেশ বর্তমানে এ খাত থেকে যেখানে প্রায় ৭৬ দশমিক ১৯ মিলিয়ন ডলার বার্ষিক আয় করে; সেখানে সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতে পর্যটন খাত থেকে আয়ের পরিমাণ ১০,৭২৯ মিলিয়ন ডলার, মালদ্বীপে ৬০২ মিলিয়ন ডলার, শ্রীলঙ্কায় ৩৮৫ মিলিয়ন ডলার, পাকিস্তানে ২৭৬ মিলিয়ন ডলার এবং নেপালে এর পরিমাণ ১৯৮ মিলিয়ন ডলার। সুতরাং সার্কভুক্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। পর্যটনশিল্পের সবটুকু সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আদর্শ হতে পারে।
আমরা মনে করি, সময় নষ্ট না করে সরকারকে এ খাতে গভীর নজর দেয়া জরুরি। বাংলাদেশে পর্যটনশিল্পের উন্নয়নে জাতীয় পরিকল্পনায় পর্যটনশিল্পকে আগ্রাধিকার প্রদান, জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ রাখা, ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, পর্যটন পুলিশ গড়ে তোলা, পরিকল্পিত প্রচারণা চালানো, দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং পরিকল্পিত বিনিয়োগ প্রয়োজন।