অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্
গৌরচন্দ্রিকা : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছোট-বড় অসংখ্য নদী রয়েছে এদেশে আর এদেশের দক্ষিণে রয়েছে বঙ্গোপসাগর। তাই এদেশে রয়েছে অনেক উপক‚লীয় অঞ্চল বা এলাকা যেগুলোর মাছ, চিংড়ি ও লবণ দেশের জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছে। এছাড়াও, উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর কৃষি ও বনায়ন কার্যক্রমের উপর এদেশের উন্নতি ও সমৃদ্ধি অনেকাংশে নির্ভরশীল। এক কথায়, উপক‚লীয় অঞ্চল মানেই অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমুহ। এই এলাকাগুলোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদানপূর্বক সরকার ও জনগণ উভয়েরই উপকূলের সকল সমস্যা সমাধানপূর্বক কাক্সিক্ষত মান অর্জনের মাধ্যমে সার্বিক বিকাশ সাধন করতে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হওয়া উচিত। এতে করে খুব অল্প সময়েই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে এবং জাতি উত্তরোত্তর বৃহত্তর সাফল্যের দিকে এগিয়ে যাবে।
উপকূলীয় অঞ্চলের পরিধি ও গুরুত্ব : বাংলাদেশ বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল। বাংলাদেশের উপকূলের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৭১০ কিলোমিটার। মোট ১৯টি উপকূলীয় জেলা ও ১৪৭টি উপজেলার মধ্যে ১২টি জেলার ৪৮টি উপজেলা সমুদ্রের মুখোমুখি অবস্থিত। অবশিষ্ট ৯৯টি উপজেলা ভৌগোলিকভাবে অভ্যন্তরীণ উপকূলের অংশ হিসেবে বিরাজমান যেখানে উপক‚লীয় ভৌত পরিবেশ দৃশ্যমান। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করে উপকূলীয় অঞ্চলে যাদের জীবন-জীবিকা প্রাথমিকভাবে নির্ভর করে চাষ, মৎস্য, বন, স্থানীয় পরিবহন, লবণ চাষ ইত্যাদির উপর। তাই উপকূলবাসীকে রক্ষার জন্য যথাযথ ও সময়োচিত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সমৃদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসকারী প্রায় তিন কোটি মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কেননা, জলবায়ুতে উষ্ণতার কারণে যদি সমুদ্রের উচ্চতা ৪৫ সে. মি. বাড়ে, তাহলে বাংলাদেশের ১০ থেকে ১৫ শতাংশ এলাকা তলিয়ে যাবে, এমন কি, যদি ২১০০ সাল নাগাদ এক মিটার সমুদ্র সমতলের পরিবর্তন ঘটে, তবে বাংলাদেশের তিন মিলিয়ন হেক্টর জমি প্লাবিত হতে পারে। এই প্লাবনযোগ্য অঞ্চলগুলোর সবগুলোই এদেশের উপক‚লীয় অঞ্চল। এছাড়া, উপক‚লীয় অঞ্চলের উপযুক্ত সুরক্ষা না হলে এদেশের সাত কোটি লোক বিভিন্নভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আক্রান্ত হবে। তাই বলা যায়, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলো এই উপকূলভাগেই অবস্থিত। মাছ, চিংড়ি, লবণ, কৃষি ও বনায়ন, পর্যটন ও বিনোদন এলাকা-সব দিক দিয়ে দেশের জাতীয় আয় ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে এগুলো সর্বোচ্চ সহায়ক। অথচ দেশের সবচেয়ে উপেক্ষিত অঞ্চলও এই উপকূলীয় অঞ্চলসমুহ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো-প্রভৃতিতে আক্রান্ত হয়ে জান-মালের ব্যাপক ক্ষতি হওয়া এ অঞ্চলগুলোর নৈমিত্তিক বৈশিষ্ট্য। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এই এলাকাসমুহের উন্নয়ন সাধন ও সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ, সর্বোপরি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উপকূলবাসীকে সুপ্রতিষ্ঠিতকরণ সময়ের দাবি।
দুর্যোগ আক্রান্ত উপকূল : ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসমুহের উপর বয়ে যাওয়া প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কথা এদেশের মানুষ ভোলেনি, ভুলে যাওয়ার কথাও নয়। এ প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে দেশের ১৬টি জেলার ৪৭টি উপজেলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৪ লক্ষাধিক মানুষ ও অসংখ্য গবাদি পশু প্রাণ হারায়। এই অসংখ্য মানুষের মৃত্যু এবং অগুন্ত সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি জনম জনম ধরে এদেশের উপক‚লবাসীর জন্য এক মর্মন্তুদ ও করুণ ইতিহাস হয়ে থাকবে। ১৯৯১ এর ঘূর্ণিঝড়ের পর বয়ে গেল ১৯৯৭ এর ঘূর্ণিঝড়সহ সাম্প্রতিক প্রলয়ংকরী মর্মান্তিক সিডর। উপক‚লীয় মানুষদের জন্য ঘূর্ণিঝড়, সিডর ইত্যাদি মোকাবেলায় পর্যাপ্ত রক্ষণাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেক প্রাকৃতিক দুর্যোগে উপকূলবাসী সর্বশান্ত হবে। অতীতেও বিভিন্ন সময়ে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছাস ইত্যাদির আক্রমণে উপকূলীয় অঞ্চলের জান-মাল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১৯৫৪, ১৯৬৮, ১৯৭৪, ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল স্মরণকালের স্মরণীয় ভয়াবহ বন্যা অথচ এ ধরনের বন্যার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ ও ২০০৭ সালে। ১৯৭৪ সালের বন্যার কারণে ফসলহানিতে সংঘটিত ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ লক্ষ লক্ষ প্রাণ সংহার করেছে। ১৯৮৮ সালের বন্যা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহতম। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৩টি এ বন্যায় ডুবে যায়, ৩০০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে এবং ৪৫ লাখ হেক্টর জমির ফসল ধ্বংস হয়। ১৯৯৮ সালের বন্যা ছিল ইতিহাসের দীর্ঘতম। ৩ মাস স্থায়ী এ বন্যায় দেশের ৫৪টি জেলা জলমগ্ন হয়। ২০০৪ সালের বন্যায় দেশের ৫৬টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারি প্রাথমিক হিসাব মোতাবেক এ বন্যায় মোট ৪২ হাজার কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল এ বন্যায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলোচ্ছ্বাস বাংলাদেশের উপক‚লীয় এলাকার মানুষের নিকট এক মূর্তিমান আতঙ্ক। গত ১৮৫ বছরে অন্তত ৫১ বার ভয়ংকর জলোচ্ছ্বাসের হামলায় পড়েছে বাংলাদেশ। তবে ১৯৬০, ১৯৭০, ১৯৮৫, ১৯৯১ এবং ১৯৯৭ সালের জলোচ্ছ্বাস ছিল বিভীষিকাময়। ১৯৭০ সালের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস উপকূলীয় বিশাল এলাকাকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিল এবং এতে ৫ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। ১৯৮৫ সালের ঘূর্ণিঝড়ে উড়িরচর নামক জনপদ সম্পূর্ণ জনশূন্য হয়ে পড়ে।
উপকূলে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব : বিজ্ঞানীদের আশংকা অনুযায়ী বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ এক মিটার স্ফীত হলে তাদের ওপর নেমে আসবে চরম বিপর্যয়। শত শত বর্গকিলোমিটার উপকূলীয় ও অন্যান্য নিম্নাঞ্চল অধিক মাত্রায় প্লাবিত হবে। উপকূলীয় কৃষি জমি, প্রতিরক্ষা বাঁধ, আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো ও বিনোদন সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেই সাথে উপকূলীয় অঞ্চলে বসবাসরত প্রায় ৪ কোটি মানুষ বাস্তুভিটাহীন হয়ে পড়বে। এ বিরাট জনগোষ্ঠির পুনর্বাসন আমাদের মতো জনবহুল দেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে যা জাতীয় উৎপাদন ও অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে, ফলে মারাত্মক হুমকির মধ্যে পড়বে জাতীয় জীবন।
লবণ চাষ ও পর্যটন শিল্প : সমুদ্র উপকূল এলাকার লবণ একটি অন্যতম শিল্প। হাজার হাজার পরিবার এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ও নীতিমালার অভাবে এ শিল্প আজ ধ্বংসের মুখে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে চাষীরা লবণ উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হলে আমাদের লবণের জন্য সম্পূর্ণভাবে বিদেশের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হবে। তখন কিন্তু লবণ নিয়ে সরকারের বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হবে এবং দেশে লবণের সংকট সৃষ্টি হতে পারে। তাই লবণ শিল্পকে রক্ষার জন্য শক্তিশালী লবণ বোর্ড গঠন এবং লবণ আমদানি ও চোরাচালানি বন্ধ করতে হবে। পর্যটন শিল্প উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য একটি আকর্ষণীয় ও অর্থকরী কর্মকান্ড। এ শিল্পে বিপুল কর্মসংস্থান হতে পারে এবং প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় হতে পারে এ শিল্প থেকে। মাস্টার প্লানের আওতায় কক্সবাজারকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন হিসাবে গড়ে তোলা গেলে এবং দীর্ঘ ৮৪ কি.মি. মেরিন ড্রাইভ সড়কসহ প্রতিশ্রুত ডাবল রেলপথ ও এশিয়ান হাইওয়ে নির্মিত হলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হবে। এছাড়া, কুতুবদিয়া, পতেঙ্গা, ক‚য়াকাটা, সুন্দরবন, হীরণ পয়েন্টসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত উপকূলীয় এলাকাকে পরিকল্পিত উপায়ে উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে আরো এগিয়ে যাবে।
মৎস্য, শুটকি এবং অন্যান্য : মৎস্য উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য আরেকটি অর্থকরী সম্পদ। দেশের মাছের চাহিদা পূরণের জন্য সামুদ্রিক মাছের কোন বিকল্প নেই। চিংড়ি দেশের রফতানি আয়ের দ্বিতীয় উৎস। হোয়াইট গোল্ড নামে খ্যাত চিংড়ি-চাষ ও রফতানিতে সরকারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা থাকা প্রয়োজন। চিংড়ি চাষ উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা ব্যবস্থাসহ চিংড়ির খাদ্য হিসেবে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রয়োজনীয় আরটিমিয়া আমদানির বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে স্থানীয়ভাবে লবণ মাঠগুলোতে তা চাষ করার জন্য গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা আবশ্যক। উপকূলীয় অঞ্চলে শুটকি ও পানসহ অসংখ্য অর্থকরী ফসল ও সম্পদ রয়েছে যার উন্নয়নের জন্য সরকার ও সংশ্লিষ্ট সকলের উদ্যোগসহ বাস্তবমুখী পদক্ষেপ প্রয়োজন। বঙ্গোপসাগরের আহরিত মাছের প্রায় ৩০% শুটকিতে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে শুটকি রফতানি করে মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে। এছাড়া, মহেশখালীর মিষ্টি পান খুবই জনপ্রিয়। বিদেশে এ মিষ্টি পান রফতানি করেও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। তাছাড়া, ধান, আলু ও শাক-সবজিসহ নানা প্রজাতির ফসল দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টির যোগান দিয়ে থাকে।
বিদ্যুৎ, তেল, খনিজ সম্পদ, ম্যানগ্রোভ ও সামুদ্রিক সম্পদ : বিদ্যুৎ হচ্ছে উন্নয়নের চালিকা শক্তি। উপক‚লীয় অঞ্চল, বিশেষ করে দ্বীপ অঞ্চলের মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা হতে বঞ্চিত। বিশাল সম্ভাবনাময় বায়ু বিদ্যুৎ দেশে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, ভারতে ৮ হাজার মেগাওয়াট বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে যা বাংলাদেশে সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় কাছাকাছি। বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে ইতোমধ্যে এর কয়েক গুণ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিয়েছে ভারত। এমনিভাবেই বাংলাদেশের পুরো উপক‚লে বিপুল পরিমাণ বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। বায়ু বিদ্যুতের পাশাপাশি মহেশখালী-কুতুবদিয়াসহ উপক‚লীয় অঞ্চলে টাইডাল বিদ্যুৎ, বায়ু গ্যাস বিদ্যুৎ এবং সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। ভোলা, মহেশখালী ও কুতুবদিয়াসহ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে তেল-গ্যাসসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ রয়েছে। ১৯৭৭ সালে কুতুবদিয়ায় একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয় যার মজুদের পরিমাণ ১০০০ ট্রিলিয়ন ঘন ফুট বলে এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপের পশ্চিমে সৈকতে বালিতে জিরকন, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, কয়নাইট ও মোনাজাইট-এর মত মূল্যবান খনিজ পদার্থ আছে। তাছাড়া, বাংলাদেশে কুতুবদিয়া দ্বীপে গন্ধকের খনি পাওয়া গেছে। এই গন্ধকসহ প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে উত্তোলন করা হলে দেশের অর্থনীতি আরো সমৃদ্ধি লাভ করবে। বাংলাদেশের সুন্দরবন ও মহেশখালী-কুতুবদিয়াসহ সমগ্র উপকূলব্যাপি বিস্তৃত এলাকা জুড়ে যে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে তা উপকূল রক্ষা ও পরিবেশ সংরক্ষণে বড় ধরনের অবদান রাখছে। এছাড়া জ্বালানি, গৃহ নির্মাণ, উপকূলীয় বাঁধ রক্ষা, ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধ ইত্যাদি কাজে উক্ত বনের ভূমিকা অপরিসীম। বাংলাদেশের সমুদ্রে মৎস্য ও নানা প্রজাতির প্রাণিসম্পদ ছাড়াও সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ।
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ ভালো : বিশেষজ্ঞদের অভিমত, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ করা সম্ভব না হলেও দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। তা করতে হলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মসুচির চেয়ে প্রস্তুতিমূলক কর্মসুচির প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি। আপনাদের হয়তো স্মরণ আছে ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে সরকারি হিসাবে প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল এবং ফসল, গাছপালা ও পশুপাখিসহ সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। লক্ষ লক্ষ পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে প্রায় অনুরূপ ঝড়ে ক্ষতির পরিমাণ ছিল খুবই কম, কারণ, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর কিছু সংখ্যক আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল যেখানে মানুষ আশ্রয় নিতে পেরেছিল এবং তারা অনেক বেশি সচেতন হয়েছিল। সতর্ক সংকেত প্রচারে সরকারের এবং স্থানীয় জনগণের ব্যাপক ভূমিকা ছিল। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষও সহজে সতর্ক সংকেত বিশ্বাস করেছিল। সাম্প্রতিক উপকূলীয় দক্ষিণ অঞ্চলে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সিডরের গতিবেগ ছিল ঘায় ২২০ কি.মি.। সুন্দরবনের বাধার কারণে তা কমে ঘণ্টায় ১২০ কি.মি. -এ দাঁড়িয়েছিল। যদি সিডর ঘণ্টায় ২২০ কি. মি. গতিবেগে ভূখন্ডে আঘাত হানতো, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ কী দাঁড়াতো আমরা সকলেই তা অনুমান করতে পারি। এ বর্ণনার অর্থ এই যে, দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য দুর্যোগ প্রস্তুতিমূলক কর্মসুচির (Disaster Preparedness) কোন বিকল্প নেই। সেই সাথে বাংলাদেশের সুন্দরবন (World Heritage) রক্ষা করা জাতীয় দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে অন্তত ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে ক্ষতিকর কোন প্রকল্প বাস্তবায়ন থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা (Global Warming) রোধে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আরো সোচ্চার হতে হবে। কার্বন নিয়ন্ত্রণে নিঃসরণকারী শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। তাছাড়াও, দুর্যোগের ক্ষতিক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য নতুন প্যারাবন সৃষ্টি ও সামাজিক বনায়নের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা বাড়াতে হবে। দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্র পরিবার, বিশেষ করে মহিলা এবং শিশুরা। দুর্যোগে দরিদ্রদের সামান্য সম্পদও ধ্বংস হয়। ফলে তারা একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়ে। তাদের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে না পারলে বারে বারে সংঘটিত দুর্যোগের ক্ষতি সামলানো তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। বিষয়টি সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে আরো বেশি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। তাদের আয় বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত ও সময়োপযোগী বাস্তবভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।
লেখক ঃ অধ্যক্ষ, মেরন সান স্কুল এন্ড কলেজ
সি.সহ-সভাপতি, কেন্দ্রীয় কমিটি, উপক‚লীয় উন্নয়ন ফাউন্ডেশন