মিনহাজুল ইসলাম মাসুম
ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বিখ্যাত স্কটিশ ইতিহাসবিদ ও পরিসংখ্যানবিদ ডব্লীউ ডব্লীউ হান্টার। পুরো নাম উইলিয়াম উইলসন হান্টার। (জন্ম: স্কটল্যান্ড, ১৫ জুলাই ১৮৪০ এবং মৃত্যু ৬ ফেব্রূয়ারি ১৯০০) তিনি ১৮৬২ সালে হান্টার সুদূর ইংল্যান্ড থেকে এসে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। পরবর্তীতে তার ভাগ্য তাকে বাংলায় নিয়ে আসে। ১৮৬৩ সালের ডিসেম্বরে ভাষাগত যোগ্যতা যাচাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তিনি বীরভূম জেলায় সহকারি ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর নিযুক্ত হন। ১৮৬৫ থেকে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি কুষ্টিয়াতে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। লেখক হিসেবে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো ‘দ্য ইন্ডিয়ান মুসলমানস্’ নামক প্রতিবেদনমূলক গ্রন্থটি রচনা। এটি একটি মূল্যবান দলিলের ন্যায় এবং এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব গবেষকদের কাছে অপরিসীম।
‘ঊনবিংশ শতকের ষাটের দশক থেকে সত্তরের দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত তথাকথিত ‘ওহাবী আন্দোলন’ অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান লেখকদের নিকট একটি জনপ্রিয় বিষয় ছিল। হান্টার ছদ্মনামে ক্যালকাটা রিভিউ এবং Englishman পত্রিকায় ওহাবী মতবাদের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে কয়েকটি প্রবন্ধ লিখেন। এগুলি ভাইসরয় লর্ড মেয়োর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের অসন্তোষের কারণ বিশ্লেষণ করে একটি গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি হান্টারকে অনুরোধ করেন। এই অনুরোধের ফসল হিসেবে হান্টার রচিত The Indian Musalmans: Are they bound in Conscience to rebel against the Queen ১৮৭১ সালে প্রকাশিত হয়।’ (সূত্র : বাংলা পিডিয়া) লেখক আবদুল মওদুদের অনুবাদকৃত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস্’ বইটি বাংলা একাডেমী থেকে ১৩৭০ বঙ্গাব্দ বা ১৯৬৩ সালে সম্ভবত (!) প্রথম প্রকাশিত হয়। তখন পরিচালক ছিলেন কবি সৈয়দ আলী আহসান। হান্টার বইটি মি. হাডসনকে উৎসর্গ করে বলেন,
‘এশিয়াবাসী প্রজাদের বিষয়ে ইংরেজদের সবচেয়ে বড় অন্যায় হচ্ছে, তাদের সম্পর্কে ভালোভাবে ওয়াকিফহাল না হওয়া। ভারতে বৃটিশ শক্তির সবচেয়ে দূরতিক্রম্য বিপদ হচ্ছে, শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিরাট ব্যবধান।’
এবার মূল পর্যালোচনায় আসি। হান্টারের বইটি চার অধ্যায়ে বিভক্ত এবং পরিশিষ্টে আলেমদের ফতোয়াও যুক্ত আছে। অধ্যায়গুলো হচ্ছেঃ সীমান্তে বিদ্রোহী শিবির, সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে অবিরাম ষড়যন্ত্র, মুসলিম আইনবিদদের সিদ্ধান্ত বা মতামত ও বৃটিশ শাসনে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি অবিচার। বইটি পড়ে সহজেই অনুধাবন করা যায় যে, এটি মহারানীর কাছে লিখিত একটি রিপোর্ট। কেন মুসলমানরা ইংরেজদের বিরুদ্ধ যুদ্ধে জড়িয়েছিল তাঁর কারণ অনুসন্ধান। সবাই জানি সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশ-ইংরেজ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রাম মুসলমানরাই শুরু করেছিল এবং শেষপর্যন্ত ১৯০ বছর একের পর যুদ্ধ করে ১৯৪৭ এ এসে বিজয় ধরা দেয়। দার্শনিক শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী (রহ.) ছেলে শাহ আবদুল আজিজ দেহলভী (রহ.) এর একটি যুগান্তকারী ফতোয়ায় (দেশ এখন দারুল হরব বা শত্রূ রাষ্ট্র এবং জিহাদ অবশ্য কর্তব্য) ইংরেজদের ভিত নাড়িয়ে দেয়। এ বইতে তিনি মুসলমানদেরকে ন্যায়সংগ্রামকে বিদ্রোহ, আন্দোলনকারিদের ওয়াহাবী, ধর্মান্ধ, উগ্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে অভিহিত করেছেন। যা মিথ্যাচার বা অপবাদ বলেই শেষপর্যন্ত প্রমাডুত হয়েছে। তাঁর রিপোর্টে অনেক পক্ষপাতমূলক আচরণ ধরা পড়ে। তিনি লিখেন, ‘প্রাচীন হিন্দুদের এই তীর্থ ভূমিতে এখন বসবাস করে উগ্র এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন কতিপয় মুসলমান উপজাতি। সিন্ধুর পূর্বতীরে কৃষ্ণপর্বত এখন যাদের দখলে, সেই ক্ষুদ্র রাজন্যবর্গ এবং ধর্মান্ধতার দিক থেকে কোনো অংশে কম নয়।’ (দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস্- পৃষ্ঠা: ২০)
শাহ আবদুল আজিজ দেহলভীর শিষ্য সাইয়্যেদ আহমদ বেরলবির নেতৃত্বে ১৮৩১ সালের বালাকোটের যুদ্ধ, ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ, তিতুমীর বাঁশেরকেল্লা, ফকির মজনু শাহের বিদ্রোহ, হাজী শরীয়ত উল্লাহদের আন্দোলন ইংরেজ দখলদাররা মোকাবেলা করতে হিমশিম খায়। উভয়পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। শেষপর্যন্ত ইংরেজদের কিছু এ দেশীয় দোসর, জমিদাররা এবং দালালিতে লিপ্ত লোকদের জন্য বৃটিশ শাসন দীর্ঘ হয়। শাহ আবদুল আজিজ দেহলভীর ফতোয়ার বিরুদ্ধে ইংরেজরা এদেশের মুসলমানদের মাযহাবী দ্ব›দ্বকে সুচতুরভাবে কাজে লাগান। তারা হানাফি মাযহাব, শাফেয়ী মাযহাব, মালেকী মাযহাব এবং কলকাতা মোহামেডান সোসাইটির কাছ থেকে ফতোয়া বা অভিমত নিয়ে সর্বত্রই ছড়িয়ে দেন। কুটকৌশলে শাসনকালকে ধরে রাখার জন্য শিয়া, সুন্নি ও ওয়াহাবী দ্বন্দ্ব লাগিয়ে রাখেন। ‘ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি’র মাধ্যমে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সবসময় দাঙ্গা-হাঙ্গামা লাগিয়ে রাখতেন। ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্তওয়ালিশের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র মাধ্যমে মুসলমানদের চিরতরে অর্থনৈতিকভাবে শেষ করে দেয়। শাসনে-শোষণে হীনবল হয়ে যায় কয়েকশত বছর ভারত শাসনকারী মুসলমানরা। আলেম সমাজের এ মুক্তি আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা রাখেন যা চিরস্মরণীয় হয়ে আছে রক্তরাঙা ইতিহাসে।
হান্টার সাহেব, বইতে সাইয়েদ আহমদ বেরলভী এবং অন্যান্য আলেমদের চারিত্রিক দৃঢ়তা, সরল জীবন, জনগণের উপর তাদের প্রভাব, অনুপম ব্যক্তিত্ব, ধর্মের প্রতি দরদ, আল্লাহর প্রতি অগাধ বিশ্বাসেরও উল্লেখ করেছেন। যেমন: ‘সীমান্তে বিদ্রোহীদের এই অসাধারণ শক্তির উৎস আমাদের কাছে রহস্যাবৃতই থেকেছে। বৃটিশ সৈন্যবাহিনীর পদতলে এরা তিনবার পর্যুদস্ত হয়েছে। কিন্তু তথাপি এই বিদ্রোহী শিবির এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এই অবিনশ্বরতা এক অলৌকিক ঘটনারই শামিল।’ (পৃ-৩৩)
‘১৮২২ সালে সে (সাইয়েদ আহমদ বেরলভী) হজ্ব করতে মক্কা গমন করে। এইভাবে হজ্বের পবিত্র আবরণে সে তার প্রাক্তন দস্যু চরিত্রকে সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত করে পরবর্তী বছর অক্টোবর মাসে বোম্বাই হয়ে ফিরে আসে। বোম্বাই শহরেও ধর্ম প্রচারক হিসেবে সে কলকাতার মতই বিরাট সাফল্য অর্জন করে। ১৮২৪ সালে সে পেশোয়ার সীমান্তের অসভ্য পার্বত্য অধিবাসীদের মধ্যে উপস্থিত হয় এবং পাঞ্জাবের শিখ অধ্যুষিত সমৃদ্ধ শহরগুলোতে পবিত্র জিহাদের বাণী প্রচার করতে থাকে।’ (পৃ- ৫) ‘ধর্মবিশ্বাসে অণুপ্রাডুত হয়ে যেসব লোক ধর্মান্ধ শিবিরে যোগদান করেছিল, তাদের অন্তরে ছিল লুঠতরাজ করে ধনসম্পদ লাভের আশা অথবা শাহাদাত লাভের আশা।’(পৃ-২৭) ‘এই বিস্ময়কর প্রভাবের উৎপত্তি কেবলমাত্র অশুভ ভিত্তির উপরেই ঘটেনি, সাইয়েদ আহমদের ধর্মীয় নেতা হিসেবে তার জীবন আরম্ভ করেছিল দু’টি মহান নীতির প্রবক্তারূপে। নীতি দু’টি হচ্ছে আল্লাহর একত্ব এবং মানুষের সাম্য। সত্যিকার ধর্ম প্রচারকরা সকলেই এই দুই নীতি অনুসরণ করে থাকেন।’(পৃ-৩৯)
‘আমরা দেখেছি, বিভিন্ন সময়ে তাদের উদ্দেশ্য যখন প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে তখনও অদম্য মনোবলের সাথে ভস্মস্তূপের মধ্য থেকে বার বার ধর্মযুদ্ধের স্ফুলিঙ্গ বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে। মিশনারিদের মত অক্লান্ত, নিজের সম্পর্কে নির্লিপ্ত, নিষ্কলঙ্ক চরিত্র, ইংরেজ বিধর্মীদের বিতাড়নের লক্ষ্যে অবিচল, অর্থ ও লোক সংগ্রহে সক্ষম একটি সুষ্ঠু সংগঠন গড়ে তোলার কাজে সুদক্ষ পাটনার খলিফারা সমগ্র ওয়াহাবী জামাতের কাছে আদর্শ -দৃষ্টান্তস্থানীয় হয়ে রয়েছেন।’ (পৃ- ৫৭) চতুর্থ অধ্যায়ে তিনি বৃটিশ শাসনে ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি অবিচারের কথা স্বীকার করেছেন। বৃটিশ শোষণ ও নির্দয় শাসনে, তাদের লালিত সুদী মহাজনদের শোষণে সোনার বাংলা বিরান হয়েছিলো। বাংলার গোয়াল ভরা ধান, পুকুর ভরা মাছ সব শূন্য হয়ে মুসলমানরা অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেছিলো। হান্টার সাহেব উল্লেখ করেন, ‘মুর্শিদাবাদের প্রতিটি জেলায় সাবেক নওয়াবদের কোনো না কোনো বংশধর ছাদবিহীন ভগ্নপ্রাসাদে অথবা শেওলাপড়া জীর্ণ দীঘির পাড়ে বসে অর্ন্তজ্বালায় দগ্ধ হচ্ছে। এদের ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাসাদগুলো বয়োঃপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি ও ভাইপো-ভাইঝিতে পূর্ণ হয়ে গেছে এবং এই ক্ষুধার্ত বংশধরদের কারো সামনেই আত্মোন্নতির কোনো সুযোগই আর নেই। তারা জীর্ণ ছাদযুক্ত ভগ্ন বারান্দায় বসে বসে ধুঁকছে, তারা ক্রমাগত ঋণের দরিয়ায় ডুবে যাচ্ছে, প্রতিবেশী হিন্দু মহাজনের সাথে ঝগড়া-বিবাদে সর্বস্বান্ত হয়ে শেষ অবলম্বনটিও তার কাছে বাঁধা দিচ্ছে। এভাবেই এই প্রাচীন মুসলিম পরিবারগুলোর শেষ চিহ্ন মুছে যাচ্ছে।…তাদের দীঘিগুলো একদিন মৎস্যরাজিতে পূর্ণ ছিল, এখন তা এঁদো ডোবায় পরিণত হয়েছে।’ (পৃ-১৩৪-১৩৫)
সবশেষে মুসলমানদের অভিযোগগুলো চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তিনি রানীর কাছে রিকমেন্ট করেন। তা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি। ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর হস্তক্ষেপ, গরু জবাই, মসজিদ নির্মাণে চাঁদা ও দাড়ি রাখলে কর দেয়া হত জমিদারদের, শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, চাকরি বাকরিতে অসুবিধে তৈরি করা, ইসলামী আইন পরিবর্তনের চেষ্টা, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা, শিক্ষা তহবিল তছরূপ, অবিচার, দমন নিপীড়নসহ নানা নানা অভিযোগ। তিনি আরো বলেন, ‘ভারতীয় মুসলমানরা নিজস্ব আইন দ্বারা আমাদের শাসনে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে বাধ্য। কিন্তু ততক্ষুই বাধ্যবাধকতা টিকে থাকতে পারে যখন আমরা চুক্তিগুলো মেনে চলব এবং তাদের ধর্মীয় সুযোগ-সুবিধাসমূহ পালনে সহযোগিতা দেব। আমরা তাদের আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করতে পারব, কিন্তু আনুগত্য দাবি করতে পারব না।… বৃটিশ সরকারের কর্তব্য হবে বাংলার মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ দমনের সাথে সাথে তাদের অসন্তুষ্টির কারণগুলো দূর করা। আমাদের বিজয় ও শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে তারা যে দুর্দশায় পতিত হয়েছে এবং চরম সর্বনাশের মধ্যে তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তার ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য তাদের প্রতি আমাদের অনুসৃত নীতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে।’ (পৃ-১৮৭)
হান্টারের রিপোর্টানুযায়ী মহারানী কতটা পদক্ষেপ নিতে পেরেছিলো আমরা ইতিহাস থেকে জানি। প্রবল বাধা তৈরি করেছিলো মুসলমানদের বিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠরা। তারা আন্দোলন করে বঙ্গভঙ্গকেও রদ করেছিল, ইংরেজ সরকার সান্ত¡নাস্বরূপ মুসলমানদের জন্য পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে এতেও তারা প্রবল আপত্তি জানায়। যাই হোক বহু ঐতিহাসিক ঘটনারই সার নির্যাস হান্টারের বইটি। আমরা কাদের সহযোগিতা, মীরজাফরী ও দালালির খপ্পরে পড়ে প্রায় দু’শত বছর বৃটিশদের গোলামীর জিঞ্জিরের আবদ্ধ হয়েছিলাম। এ বইটি পাঠ করলে দিবালোকের মতো প্রতিভাত হবে। এ বইটি পড়ুন ইতিহাস সচেতন হোন এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শত্ু-মিত্র চিনুন।