ঈদ উৎসব : কালের আয়নায় ৫০ বছর আগের দৃশ্যপট

1

আবু মোশাররফ রাসেল

‘থালা ঘটি বাটি বাঁধা দিয়ে হের চলিয়াছে ঈদগাহে,
তীর-খাওয়া বুক, ঋণে-বাঁধা-শির, লুটাতে খোদার রাহে।
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?’

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘কৃষকের ঈদ’ নামক কবিতাটি পড়লে এখন থেকে অন্তত পঞ্চাশ বছর আগের, এ দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার অনেক দৃশ্যপট আমাদের মনের মাঝে ভেসে উঠে। কৃষিপ্রধান এই দেশে তখন বেশিরভাগ মানুষেরই জীবন-জীবিকার উৎস ছিল কৃষিকাজ। সুতরাং কৃষকজীবনের এই দৃশ্যপট-চালচিত্রই ছিল এই দেশের বাস্তব প্রেক্ষাপট। ঋণে জর্জরিত, ক্ষুধায় কাতরÑমানবজীবন, এরই মাঝে বছর ঘুরে আসতো আনন্দের ঈদ। কিন্তু জীবনজুড়ে নানা অসঙ্গতির মাঝে সেই সময়ে মানুষের মনে ঈদ কতটা আনন্দ বয়ে আনতো সেটি এক মৌলিক প্রশ্ন বটে। সময়ের ¯্রােতে মানুষের সঙ্গতি বেড়েছে, সাথে সাথে বেড়েছে ঈদের আনন্দ-উৎসবও।
বর্তমান সময়ে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ‘মনের মতো’ একটি পাঞ্জাবি পরা লাগবেই-তাই পাঞ্জাবি পছন্দ করতে কিংবা পছন্দের পাঞ্জাবিটি খুঁজে নিতে অনেকে শপিংয়ে ঘুরে ঘুরে গলদঘর্ম হন। মসজিদে কিংবা পুরো ঈদগাহ মাঠে দেখা যায় মুসল্লিদের পরনে রঙ-বেরঙের পাঞ্জাবির বাহার। দেশের ঈদ উৎসবে এই দৃশ্যপট এখন স্বাভাবিক। কিন্তু এই যে পাঞ্জাবির প্রচলন অর্থাৎ ঈদের নামাজে পাঞ্জাবি পরার রীতিটি ঠিক কখন থেকে চালু হয়েছে?
আশির দশকের শেষের দিকে কিংবা নব্বইয়ের দশকে এ দেশে ঈদ উৎসবের দৃশ্যপট কেমন ছিল? তখনকার সময়ে ঈদের দিনে ঘরে ঘরে কি রান্না হতো, অতিথিদের আপ্যায়ন করা হতো কোন খাবারে? অথবা সেই সময়গুলোতে মানুষজন বন্ধুবান্ধব বা আপনজনদের ঈদের শুভেচ্ছা জানাতেন কোন উপায়ে? আজকের প্রজন্মের কাছে নিশ্চয়ই এসব জানার তৃষ্ণা আছে, তারা হয়তো কৌত‚হলী হয় অথবা তাদের জানানোর দায় আমাদের।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দশক আর একবিংশ শতাব্দীর প্রথম আড়াই দশক-এই সময়ে, মোটামুটি তিন যুগের ব্যবধানে এ দেশের ঈদ উৎসবে, মানুষের আচার-সংস্কৃতি, চাহিদায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। সেকাল আর একালের ঈদের পোশাক পরিচ্ছদ, খাবার-দাবার থেকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মতো অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে এখন ব্যাপক তফাৎ। বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় ঈদের সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির চর্চায়ও।
সময়ের স্রোত বহমান-সময় গড়াতে গড়াতে সমাজ-প্রকৃতির অনেক কিছুই বদলে যায়। এই বদলে যাওয়া বা পরিবর্তনের হাওয়ায় মানুষের রুচিবোধ, চাহিদাও বদলে যায়। সময়ের স্রোতে কয়েক বছর ঘুরতেই সামাজিক জীবন-উৎসব আয়োজন থেকে কিছু অনুষঙ্গ হারিয়ে যায়, নতুন কিছু এসে সেই স্থান দখল করে নেয়। একবিংশ শতাব্দীর শুরুটা প্রযুক্তির যুগ, দ্রুত সময়ে প্রযুক্তির উৎকর্ষের কারণে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনাচরণ যেমন বদলে গেছে, তেমনি ঈদের আয়োজনেও যেন ‘বিপ্লব ঘটে গেছে।’
আমাদের শৈশব কেটেছে নব্বইয়ের দশকে, একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে আমরা ‘অনেকটা বুদ্ধিমান’ হতে থাকা প্রজন্ম, এখন তো জীবনবোধের পরিপূর্ণতার মাঝেই আছি। তাই সেকালের ঈদের চালচিত্র, দৃশ্যপটের সাথে এ কালের দৃশ্যপট চোখ বন্ধ করে তুলনা করা সম্ভব। তবুও এবার ঈদে গ্রামের বাড়িতে বেড়ানোর ফাঁকে বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে আড্ডা জমিয়েছিলাম, সেকালের ঈদ আর একালের ঈদ নিয়ে। পুরোনো কথা তুললে বয়োজ্যেষ্ঠরা নস্টালজিক (স্মৃতিকাতর) হয়ে পড়েন, তারা গদগদ করে তুলে ধরেন ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া অনেক তথ্য-উপাত্ত। তারই আলোকে কয়েকটি অনুষঙ্গ তুলনামূলক তুলে ধরবো এই লেখায়-
শার্ট-লুঙ্গি থেকে চোখ ধাঁধানো পায়জামা-পাঞ্জাবি :
বর্তমান সময়ে ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য কিংবা আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে বেড়ানোর অনুষঙ্গ হিসেবে পাঞ্জাবি বেশ জনপ্রিয় একটি পোশাক। শুধু যে ঈদের পোশাক হিসেবেই পাঞ্জাবি জনপ্রিয় তা নয়, মানুষ এখন যে কোনো উৎসব-আয়োজনে, এমনকি শোকের আবহ প্রকাশেও কালার ম্যাচিং করে পাঞ্জাবি বেছে নেন। অথচ মাত্র ৩০/৩৫ বছর আগেও এই দেশের মানুষজন পাঞ্জাবি চোখে দেখেননি। সে সময় গ্রামীণ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের পোশাক ছিল লুঙ্গি আর হাফহাতা শার্ট। শহর এলাকায় মানুষ লুঙ্গির পাশাপাশি ফুলহাতা শার্ট আর ঢিলেঢালা প্যান্ট পরতো। এই ধরনের পোশাক নিয়েই তখনকার মানুষজন ঈদের নামাজ আদায় করতেন। তারও আগে এই দেশে পোশাক পরিচ্ছদের আকাল ছিল। গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব একজন মুরুব্বী বলেছেন, তিনি ছোটবেলায় ‘বিদ্রি’ পরতেন। ‘বিদ্রি’ কি জিনিস জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, সেটি ছিল সাদা সেলাইবিহীন এক টুকরো কাপড়, যেটি দিয়ে শরীরের নিচের অংশ ঢেকে রাখা যেতো। আমাদের চোখে দেখেছি, দেশে পাঞ্জাবির প্রচলন হয়েছে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে। তখনও কেবল শহরের বাসিন্দারাই ঈদ কিংবা আনন্দ উৎসবে পাঞ্জাবি পরতেন। গ্রামেও ধনী মানুষজন নিজেদেরকে অন্যদের তুলনায় আলাদা দেখাতে কিংবা আভিজাত্য প্রকাশ্যে ঈদের দিন লুঙ্গির সাথে পাঞ্জাবি পরতেন। তবে তখনও পাঞ্জাবি মানে একটি রঙের-কেবলই সাদা। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ঈদগাহে ছোট-বড়, ধনী-গরিব সব শ্রেণির মানুষের মধ্যে পাঞ্জাবির প্রচলন বাড়তে থাকে, আস্তে আস্তে নানা রঙের, নানা ঢংয়ের কিংবা ফ্যাশন্যাবল পাঞ্জাবির সমাহার হতে থাকে। পাঞ্জাবি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে তরুণদের হাত ধরে; যখন তারা উৎসব আয়োজনে ফ্যাশনের অংশ হিসেবে, নিত্যদিনের ইউনিফর্ম এর বিকল্প হিসেবে পাঞ্জাবি পরা শুরু করেন।
বাংলা সেমাইয়ের জায়গায় বিরিয়ানি, হালিম, লাচ্ছা সেমাই :
এবারের ঈদে আত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধবের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে কি কি খেয়েছেন তার একটি তালিকা করুন। তালিকায় পাবেন-নানা ধরনের বিরিয়ানি, কোর্মা-পোলাও, ছোলা ভাজা, নুডলস, হালিম, লাচ্ছা সেমাই, পাস্তা, ফিরনি…আরও কতকিছু। ঈদের দিন কিংবা ঈদের সময়টিতে ঘরে ঘরে কত ধরনের সুস্বাদু আইটেমের খাবার যে রান্না হয়েছে তার ইয়াত্তা নেই। অথচ পঞ্চাশ বছর আগে এই দেশের কৃষক পরিবারের ঈদের দিনেও নতুন কিছু রান্না হতে বলে কোনো তথ্য আমি পাইনি। আত্মীয়-স্বজনরা বেড়াতে হলে সে সময়ে ক্ষেত-খামারে উৎপাদিত প্রচলিত যে খাবার-দাবার ছিল তা দিয়েই আপ্যায়ন করা হতো। আশির দশক কিংবা নব্বইয়ের দশকে ঈদের দিনের জন্য নতুন একটি খাবার প্রচলন হতে শুরু করে-সেটি হলো বাংলা সেমাই। তখন গ্রামে-গঞ্জে ঈদের দিন প্রতিটি বাড়িতে রান্না করা হতো কেবল ‘বাংলা সেমাই’। ঈদের বাড়তি খাবার বলতে সেই সেমাই ছিল একমাত্র অনুষঙ্গ, সব বাড়িতে রান্না হতো একই ধরনের রেসিপিতে। তবে কৃষি প্রধান এই দেশে কখনো কখনো ফসল উঠার সময়টাতে রোজা-ঈদ হলে সে বছর কোনো কোনো অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের শস্যদানাও রান্না হতো। যেমন চট্টগ্রামের গ্রামীণ জনপদে ‘ফেলন ডাল’ নামক এক ধরনের ডালের চাষ হতো বেশ, এখনও হয় সেগুলো ঈদের দিন ভাজা হতো অনেক কৃষি পরিবারে।

ডিজিটাল কার্ড হয়ে ফিরেছে ঈদকার্ড :
ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর মতো কোনো ব্যাপার প্রাচীন বাংলার মুসলিম সংস্কৃতিতে কিংবা পঞ্চাশ-ষাট বছর আগের ঈদের প্রেক্ষাপটে তেমন কোনো তথ্য মিলে না। ঈদ ছিল ধর্মীয় সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির এক অনন্য মিলনমেলা। সমাজ এগোতো এগোতে এ দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যেই প্রথম ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর কদর দেখা যায়। আশির দশকে শহর এলাকার মানুষজন বন্ধুবান্ধবদের ঈদকার্ড পাঠাতেন, গ্রাম অঞ্চলের তখনো সে সবের প্রচলন খুব একটা হয়নি। ব্যবসায়ীরা ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের কার্ড ছাপিয়ে যখন বাজারজাত শুরু করলেন, সেগুলো ধীরে ধীরে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ল। নব্বইয়ের দশকে গ্রামীণ জনপদের বইয়ের দোকান, লাইব্রেরিগুলোতে ঈদকার্ড বিক্রি শুরু হয়। বিভিন্ন ধরনের ডিজাইন করা কার্ডে বাংলা ও ইংরেজিতে ‘ঈদ মোবারক’ লেখা আইকনের কার্ড নব্বই দশকে বেশ জনপ্রিয় ছিল। তরুণ-তরুণীরা বিশেষত বন্ধুবান্ধবকে ঈদকার্ড পাঠিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করতো। এই শতকের শুরুতেই প্রযুক্তির হাওয়ায় ঈদকার্ড হারিয়ে যেতে থাকে। মানুষের হাতে মোবাইল ফোন আসার পর ঈদে কিংবা উৎসবে এসএমএস করে শুভেচ্ছা জানাতে থাকেন। তাতে ঈদকার্ড বাজার থেকে প্রায়ই উধাও হয়ে যায়। তবে এসএমএস এর সেই ধারাও বেশিদিন টিকেনি। প্রযুক্তির দ্রুত অগ্রগতির কারণে স্মার্টফোন বাজারে আসে, শুরু হয়Ñডিজিটাল কার্ড পাঠানো। চলতি বছর ঈদে মাত্র দুয়েকটি এসএমএস পাওয়া গেছে, আর হোয়াটসঅ্যাপ-ম্যাসেঞ্জারে ডিজিটাল ঈদকার্ড এসেছে শত শত। সেই ঈদকার্ডই যেন ফিরে এসেছে ডিজিটাল হয়ে।

মসজিদ থেকে বেরিয়ে ঈদগাহ ময়দান বেড়েছে :
এবার ঈদের নামাজ কোথায় আদায় করেছেন? বেশিরভাগ মানুষের জবাব হবে ঈদগাহ ময়দানে। ‘আমাদের মসজিদে’ কথাটি খুব কমই শোনা যাবে। এটাও ঈদের একটি বড় পরিবর্তন। আগে মসজিদেই ঈদের নামাজ আদায় করা হতো। ইসলামের বিধান অনুসারে, ‘ঈদের নামাজ কোনো ময়দানে পড়াটা উত্তম’। তবে নামাজ আদায়ের জন্য প্রতিটি এলাকায় আলাদা মাঠে, প্যান্ডেল তৈরি, শামিয়ানা টাঙানোসহ আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গতি বা পরিস্থিতি বিগত বছরগুলোতে সব জায়গায় ছিল না। ধীরে ধীরে ঈদ আয়োজনে অন্যান্য অনুষঙ্গের মতো এটিতেও পরিবর্তন এসেছে-এখন বেশিরভাগ এলাকাতেই ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য আলাদা ঈদগাহ মাঠ রয়েছে, সেগুলোর আলাদা ব্যবস্থাপনা কমিটিও আছে। কোনো কোনো জায়গায় ঈদ জামাত কমিটি নামে কমিটি করা আছে। অবশ্য নব্বইয়ের দশক থেকেই শহর এলাকাগুলোতে সরকারি সংস্থার (সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন) ব্যবস্থাপনায় বড় একটি ঈদগাহ মাঠে ঈদের নামাজ আদায় হয়ে আসছে।

সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সালাম থেকে ঈদ সালামির জোয়ার :
ঈদের নামাজ আদায়ের পর কবর জেয়ারত এবং সৌহার্দ্য-সম্প্রীতির সালাম বিনিময় আর কোলাকুলিই চিরন্তন দৃশ্য। ঈদ আসে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু ভেদাভেদ ভুলে সবাই একই কাতারে এসে মুসলিম ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করতে। প্রাচীনকাল থেকেই এ দৃশ্যপট বয়ে আসছে। আমাদের শৈশবে বড়দের সালাম করার পর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতেন, বড়রা ছোটদের স্নেহের পরশে আগলে নিতেন-এটুকুই। তবে ইদানীং বিশেষ করে গত বছর দশেক ধরে নতুন একটি ধারা চালু হয়েছে-ঈদ সালামি। এখন ঈদে ছোটরা সালাম করে বড়দের কাছ থেকে ‘ঈদ সালামির’ নামে টাকা দাবি অথবা আদায় করে। ইসলামের বিধানে ঈদের দিনে পারস্পরিক উপহার প্রদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে, তবে আমাদের দেশে ইদানীংকালের চর্চাটি একটু বাড়াবাড়িই বলে মনে হয়।