ঈদে শিক্ষা, শিক্ষায় ঈদ

7

অধ্যক্ষ আবু তৈয়ব

শিক্ষার লক্ষ্যগুলোর মধ্যে যেমন দৃশ্যমান লক্ষ্য থাকে তেমনি অদৃশ্যমান লক্ষ্যও থাকে। দৃশ্যমান লক্ষ্যগুলো জীবিকামুখী বলে আমরা তা সহজেই উপলব্ধি করতে পারি, কিন্তু শিক্ষার জীবিকামুখী নয়, জীবনমুখী লক্ষ্যগুলো আমাদের বোধে ও মননে আনতে মনোযোগ একটু বেশি দিতে হয়। একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ভাল পাস দিল,তাই সে একটা চাকুরি যোগাড় করতে পারল। তার মধ্যে শিক্ষার দৃশ্যমান লক্ষ্য অর্জিত হল । খেয়ে-দেয়ে বেঁচে থাকতে পারবে। কিন্তু মানুষ তো শুধু নিজে খেয়েপরে বাঁচলে হয় না। মানুষ হতে হলে তাকে মানবিক গুণাবলিও অর্জন করতে হয়। শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য সেই মানবিক গুণাবলিও অর্জন করানো। শিক্ষার্থীকে সমাজমুখী করা, দায়িত্বশীল করা, দেশপ্রেমিক করার পাশাপাশি সুনাগরিক ও উপযোগিতায় বিশ্ব নাগরিকরূপে গড়ে তোলা। তা তার মধ্যে অর্জিত না হলে শিক্ষা তার জন্য ব্যর্থ হয়েছে বলে ধরা যায়।কিন্তু রহস্য হলো মানবিক হওয়ার লক্ষ্যগুলো অর্জিত হয়েছে কিনা তা সহজে বোঝতে পারা যায় না,দৃশ্যমান হয় না। এসব গুণাবলিকে শিক্ষার লক্ষ্যগুলোর মধ্যে কোমল দক্ষতামূলক লক্ষ্য হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কোমল দক্ষতায় আরও আছে সহমর্মিতা, সহযগিতা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ইতাদি বিষয়। জীবিকামুখী নানা দক্ষতার লক্ষ্য অর্জনের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে উপর্যুক্ত কোমল দক্ষতাগুলো অবশ্যই অর্জন করতে হয়। শিক্ষাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য। এসব অর্জিত হলে শিক্ষার্থী ব্যক্তি নিজের কাছে নিজেই শুধু সম্পদ হয়ে উঠে না। শিক্ষার্থী ব্যক্তি চেতনার বৃত্তাবদ্ধতা ভেঙ্গে সমাজমুখী হয়ে উঠে। আর তখন কোমল দক্ষতা অর্জনে গড়ে উঠা শিক্ষার্থী পরিবারের, রাষ্ট্রের ও সমাজের সম্পদ হয়ে উঠে। সেই দিকে আমাদের মনোযোগ কম বলে ও গুরুত্ব কম অনুধাবন করায় মানবিক শিক্ষার্থী তেমনভাবে গড়ে তোলা যাচ্ছে না। তাতে কোমল দক্ষতা অর্জনে সফল না হওয়ায় এখনকার শিক্ষাকার্যক্রম প্রকৃত শিক্ষাদানে ব্যর্থ বলে বিবেবচনা করা হয়। অথচ তা চর্চা করে অর্জিত হওয়ার জন্যও শিক্ষাক্রমে নানা ক্ষেত্র দেয়া থাকে। এসব গুণাবলি বা কোমল দক্ষতাগুলো ছাড়া একজন শিক্ষার্থী কখনও নিজেকে মানবিক মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে পারে না । আমরা অভিভাবকরা তার দিকে কম মনোযোগ থাকায় সন্তানকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা কোন চাকুরির দক্ষতা অর্জনকে গুরুত্ব দিয়ে কোচিং-এ, প্রাইভেটে ও তদারকির চাপে তাকে এতই ব্যস্ত রাখি যে সন্তানের মধ্যে কোমল দক্ষতাগুলো অর্জিত হওয়ার সুযোগ থাকে না। আবার এই সব কোমল দক্ষতাগুলো গণিতের সমাধান মিলানোর মত বিষয় না। যা ঘরে বসে অর্জন করা যায়। নানা প্রেক্ষাপটের বিষয়গুলো চর্চা করে অর্জন করতে হয়। কোমল দক্ষতা অর্জন ও তার কার্যকারিতা সহজে দেখা যায় না বা চোখে পড়ে না। এই সবগুণাবলি অর্জিত হওয়ার জন্য পরিবারে, সমাজে ও প্রতিষ্ঠানে নানা প্রেক্ষিত, আয়োজন ও অনুষ্ঠান থাকে। যেখানে সন্তান স্বতঃস্ফূর্তভাবে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে তা-সব চর্চা ও অনুভব করতে পারে। এখানে আমাদের ঈদ উৎসব হলো সন্তানকে নানা মানবিকগুণাবলি অর্জনের ও চর্চা করার অন্যতম প্রেক্ষিত।
এখানে ঈদের কয়েকটি প্রেক্ষিত সামনে আনা হলো যা থেকে সন্তান কোমল দক্ষতাগুলো চর্চা করতে পারে।
ক) ঈদের কেনাকাটা- সন্তানকে মানবিক করার ও সহমর্মী করার একটি চমৎকার বিষয় ঈদের জামাকাপড় কেনাকাটা।একজন সচেতন অভিভাবক ঈদ উৎসবে সন্তানকে শুধু নতুন জামাকাপড় কেনাকাটায় ব্যস্ত রাখেন না , ঈদ উৎসবের অদৃশ্যমান লক্ষ্যগুলোর প্রতিও মনোযোগী হয়ে তা সন্তানের বোধে-মননে নেয়ার ও চর্চা করার ব্যবস্থা করে দিয়ে থাকেন। তার জামা কেনার সময় অসহায় প্রতিবেশি বা আত্মীয় স্বজনের কারো জন্যও নতুন কাপড় কেনার বিষয়টি তার সাথে আলাপ করে নিতে পারেন। তার হাত দিয়ে তা উপহার হিসাবে দেওয়াতে পারেন। কাপড় প্রদানে ইহজাগতিক ও পরকালে যে আনন্দ ও সওয়াব হয় তা নিয়েও আলোচনা করা যায়।
খ) অর্থ প্রদান ঈদ হলো সামাজিক উৎসব। তাই একা একা ঈদের নানা বিষয়াশয় ভাবার ও করার মধ্যে তৃপ্তি থাকে না। আনন্দ আসে না। ঈদ উৎসব এর মানবিক দিক হলো ফিতরা ও যাকাত প্রদান করা। এটা ছোট শিশুর ভাবনায় আনতে হবে যে আমাদের আশেপাসের সবাইকে নিয়ে আমি ও আমরা হই। তাদের ভালত্ব দিয়ে আমার ভালত্ব নিশ্চিত হয়। তারা ভাল না থাকলে আমরা ভাল থাকতে পারি না।
সেই ভাল অনুভূতির অনুরণনের জন্য তাদেরকেও ঈদ আনন্দ করার, ভাল খাবার খেতে পারার জন্য যাকাত ও ফিতরার বিধান। আমাদের সম্পদকে পবিত্র করার পাশাপাশি রোজার পূর্ণতার জন্য এই ধরণের অর্থ দেওয়া হলেও মানবিক বিষয় ও সহমর্মী হওয়ার দিকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে। অন্তত ঈদের দিন হলেও একটু সেমাই শিরনী ও নতুন জামা পরিধান করে ঈদের আনন্দে সামিল হতে পারার জন্যও এই ব্যবস্থা।
গ) পানাহারের ব্যবস্থায় : প্রতিবেশিকে উপোস রেখে ইবাদত করলে তা মহান আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না। ঈদের দিন যাতে কারো আত্মসম্মানে আঘাত না লাগে সে ভাবে সেমাই শিরণী ইত্যাদি খাওয়াতে হয়। এখানে সন্তানকে দায়িত্ব দেয়া যায়। যাতে সে খাবার পরিবেশনে সহায়তা করে তার মর্ম উপলব্ধি করতে পারে। আশেপাশে বয়স্ক কেউ থাকলে ভাল ঈদের ভাল খাবার তার হাত দিয়ে পৌঁছিয়ে দেয়া। ছোট হলে তাকে সাথে নিয়ে সেই খাবার দিয়ে আসা।
ঘ) কবর জিয়ারতে- এই সময় আপনার মুরুব্বিদের, হারানো স্বজনদের গুণাবলি তাকে শুনান। এবং তারা কত কষ্ট ও ত্যাগ করে আপনার জীবনে অবদান রেখেছেন তাও কৃতজ্ঞতা চিত্তে স্মরণ করে তাদেরকে জান্নাতবাসী করার জন্য সন্তানকে নিয়ে দোয়া করুন। যাতে সে তার শিকড়ের সন্ধান পায়, বন্ধনের টান অনুভব করে।
ঙ) ঈদে বেড়ানোতে-সন্তানের সামাজিক বিকাশে ও নতুন পরিস্থিতিতে অভিযোজিত হওয়ার সক্ষমতা অর্জনের বড় সুযোগ থাকে ঈদ বেড়ানোতে। যে রকম আত্মীয় হউক না কেন, সমাজের যে স্তরে বেড়াতে যান না কেন একটি দরদি ও সহানুভূতিশীল মানসিকতা নিয়ে থাকতে হবে। তাদের সুখদুঃখের কথা আন্তরিকতার সাথে শুনতে হবে। জানা থাকতে হবে সন্তানের শতকরা আশিভাগ মনোভাব, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ গড়ে উঠে আমাদের তথা পরিবারার ও সমাজে দৃশ্যমান আচরণ থেকে। পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের নানা ঘটনা প্রবাহের ভেতর দিয়ে। এক্ষেত্রে সচেতন থাকাটা জরুরি। প্রত্যেক মানুষই চায় সন্তানরা ঈদগাহে যাক, অন্যদের কলরবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের সন্তানটিও আনন্দে মেতে উঠতে পারুক। এখানেই ঈদ আমাদেরকে মানবিক ও মহৎ করে তুলে। মহত্বের সোনালি আভায় সবদিক ভরে উঠে । অন্যকে অসুখি রেখে নিজের আনন্দে পূর্ণতা আসে না। তাই অসহায় কাউকে অর্থ প্রদানের সময় শিশুকে দরদ দিয়ে কথাগুলো বলে হৃদয়াঙ্গম করতে আগ্রহী করার চেষ্টা করুন।
আমরা ঈদ উৎসবকে উচ্চ মূল্যবোধের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানের ছকে আবদ্ধ রেখে দিলে ঈদ এই সব গুণাবলী অর্জনে তথা শিক্ষার লক্ষ্য, কোমল দক্ষতা অর্জনে সহায়ক হয়ে উঠতে পারবে না। আনুষ্ঠানিকতার কাঠামোতে রেখে দিলে ঈদ শিক্ষার অনুসঙ্গ হয়ে উঠতে পারবে না। এতে আমরা কোমল দক্ষতা অর্জন করানোর সম্ভাব্যতা থাকবে না। ঈদে শিক্ষাকে কার্যকরী করতে হলে এভাবে ভাবতে হবে। এতে ঈদ সত্যিকারের অর্থবহ ঈদ হয়ে উঠবে। অন্য দিকে শিক্ষায় ঈদ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।
শিক্ষার বর্তমানের প্রাযুক্তিক সময়ে বড় সংকট হলো পেশাভিত্তিক দক্ষতা অর্জনের নানা জটিলতা নয়। এখন বড় সংকট হলো কোমল দক্ষতা সম্পন্ন তথা মানবিক মানুষ গড়ে তুলতে না পারা। আর যে শিক্ষা মানবিক মানুষ গড়ে তুলতে পারে না সেই শিক্ষা তো অকার্যকর। অকার্যকর শিক্ষা দিয়ে আর যাই হউক জাতিকে এগিয়ে নেয়া যাবে না, জাতি উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাবে না, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যাবে না তা এখন অনেকে বোঝে। তাই আমাদের উচিত প্রথাগত শিক্ষার মতো শিক্ষাকে শুধু শ্রেণি কক্ষে আবদ্ধ না রাখা। পরিবার ও সমাজের নানা আয়োজন ও প্রেক্ষিতে শিক্ষাকে প্রাসঙ্গিক করা ও তার গুরুত্ব অনুধাবন করতে আগ্রহী হওয়া। আমাদের সন্তানদের এবারের ঈদের নানা আয়োজনে সক্রিয় রেখে শিক্ষার কোমল দক্ষতা অর্জনের দিকে মনোযোগী হব। আমাদের সন্তান যেন মানবিক মানুষ হয়ে ওঠার পথে থাকতে পারে। এতেই ঈদের অর্থবহতা ও কল্যাণকর দিক আমাদের ও সন্তানদের জীবনে কার্যকর হয়ে উঠবে। প্রকৃত শিক্ষায় সন্তান গড়ে উঠতে ভূমিকা রাখতে পারবে। এতেই ঈদ মানব জীবনে মহিমান্বিত হয়ে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
অধ্যক্ষ,খলিলুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজ