ফখরুল ইসলাম নোমানী
বালাগাল উলা বেকামালিহি, কাশাফাদ্দুজা বেজামালিহি। হাসানাত জামিউ খেসালিহি, সাল্লুআলাইহে ওয়াআলিহি। আজ পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। এই দিনেই আমাদের প্রিয় নবী, শেষ নবী, নবীকুলের শিরোমণি, বিশ্বমানবতার আশীর্বাদ হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর শুভাগমন ও ওফাত। ১২ রবিউল আউয়ালকে মুসলিম বিশ্ব মহানবীর জন্ম ও ওফাতের দিবস হিসেবে পালন করে থাকেন। এ দিবসটি একই সঙ্গে আনন্দের এবং দুঃখের। তাই এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্যের সাথে পালিত হয় সিরাতুন্নবী হিসেবেও। মহানবী (সা.)-সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব। তাঁর পবিত্র জন্মও হয়েছে অলৌকিক পš’ায়। তাঁর জন্মে গোটা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনা। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যাঁর স্মরণ সব জাতি, সব যুগে করেছে। কিন্তু কবে এই মহামানব জন্মগ্রহণ করেছেন তা নিয়ে সব আলোচনা রবিউল আউয়াল মাস ঘিরেই হয়ে থাকে। পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল। ইসলামের ইতিহাসে দিনটি অত্যন্ত তাৎপর্যমন্ডিত। বিশেষত দুটি কারণে ১২ রবিউল আউয়াল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। প্রথমত, সব ইতিহাসবিদের ঐকমত্য বর্ণনা মতে এই দিনেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-লক্ষ-কোটি ভক্ত-অনুরক্তকে এতিম বানিয়ে এ পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, প্রসিদ্ধ অভিমত অনুযায়ী এই ১২ রবিউল আউয়ালই মহানবী (সা.)-জন্মগ্রহণ করেছেন।
অন্ধকার যুগের পশুসুলভ জীবনাচার ও জুলুম নিপীড়ন– নির্যাতনের সামাজিক অন্যায়–অবিচার ও অত্যাচারের তমসা থেকে মানবতাকে সভ্যতার আলোর দিকে এগিয়ে নিতে ; তিনি ভোরের সমীরণপ্রবাহ সঙ্গে নিয়ে প্রভাত রবির রঙিন আলোয় সকালের সূর্যের হাসি হয়ে উষার আকাশে উদিত হলেন মুক্তির দূতরূপে। তখন চলছিল আইয়ামে জাহেলিয়াত মানে অন্ধকার যুগ। অজ্ঞানতা, মূর্খতা, কুসংস্কার ও পাপাচারে নিমজ্জিত ছিল জাজিরাতুল আরব বা আরব উপদ্বীপ। এ সময় জ্ঞানের আলো নিয়ে মুক্তির বাণী নিয়ে পৃথিবীতে আসেন মানবতার মহান বন্ধু হজরত মুহাম্মদ (সা.)। পৃথিবীর ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যাঁর স্মরণ সব জাতি সব যুগে করেছে। কিন্তু কবে এই মহামানব জন্মগ্রহণ করেছেন তা নিয়ে সব আলোচনা রবিউল আউয়াল মাস ঘিরেই হয়ে থাকে। আল্লাহর বিশেষ রহমত মহানবীর দুনিয়ায় আগমন। নবী করিম (সা.)-এর আবির্ভাবে মানুষের ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সমগ্র বিশ্ব পরিণত হয় এক বেহেশতি পরিবেশে। তাই তো আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন হে নবী (সা.)! আমি আপনাকে পাঠিয়েছি বিশ্বজগতের জন্য শান্তি ও রহমতস্বরূপ। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরতের উদ্দেশে রওনা করেছিলেন ১ রবিউল আউয়াল। তিনি মদিনায় পৌঁছেন ১২ রবিউল আউয়াল। প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ মো¯তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে কুবা নির্মাণ করেন ১৬ রবিউল আউয়াল। মাহে রবিউল আউয়ালের আগমন ঘটে নবী প্রেমের প্রতীক ও নিদর্শন হিসেবে। সাইয়্যেদুল কাওনাইন হাবীবে খোদা মুহাম্মদুর রসুলুল্লাহ (সা.)-এর আগমন এই মাসে। যিনি বিশ্বনবী, শেষ নবী, যার শুভাগমনে ধন্য সমগ্র জগৎ, আলোকিত মক্কার মরুপ্রান্তর, যার কারণে চিরভাস্বর মদিনাতুল মুনাওয়ারাহ। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যাকে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেছেন সমগ্র জগত্বাসীর জন্য আপনাকে রহমত করেই প্রেরণ করেছি। ওই আয়াত প্রমাণ করছে রসুলে আকরাম (সা.)-গোটা সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত। আরও ইঙ্গিত বহন করছে আল্লাহ জগৎসমূহের রব এবং তার প্রিয়বন্ধু মুহাম্মদ (সা.)-হলেন এ জগৎসমূহের রহমত। আল্লাহর রুবুবিয়্যাত তথা মালিকানা যে পর্যন্ত বিস্তৃত বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুয়ত সে পর্যন্ত ব্যাপৃত।
বর্তমান সময়ের ঘুণে ধরা অশান্ত, অন্যায়-অবিচার ও অত্যাচারে জর্জরিত পচনশীল সমাজে শান্তিপ্রতিষ্ঠায় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর আদর্শ অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই। একজন মানুষের জন্য জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি পুরো জীবনের রয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর জীবন থেকে শিক্ষার সবকিছু। এ কারণে রাসুলের আদর্শের কথা, তার শিক্ষার আলোচনা সারা বছরই হয়। তবে রবিউল আউয়াল মাসের প্রতি মুসলিম জাতির ভিন্ন একটি আবেগ ও ভালোবাসা রয়েছে। রবিউল আউয়াল মাস স্মরণ করিয়ে দেয় হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসার কথা। এ মাসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর শুভাগমন,তার আগমনকে ঘিরে ঘটে যাওয়া বিস্ময়কর মুজেজা,তার অলৌকিক জীবনাদর্শ সবগুলো মুসলিম জাতির অন্তরে ঢেউয়ের মতো দুলতে থাকে। এই কারণে মুসলিম জাতি এ মাসকে ঘিরে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ভালোবাসাকে তাজা করার লক্ষ্যে সিরাত মাহফিলসহ বিভিন্ন সেমিনার-সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভার আয়োজন করে থাকে।
মুসলিম শরিফে বর্ণিত বিশুদ্ধ এই হাদিস দ্বারা মহানবী (সা.)-তার জন্মদিনে উম্মতের করণীয় কী তা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাই প্রকৃত নবী-প্রেমিক হতে হলে প্রতি সোমবার রোজা রাখা চাই। সেই সঙ্গে রোজা বৃহস্পতিবারও রোজা রাখা উচিত। এসব আমল বিশুদ্ধ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। অন্য আরেক হাদিসে নবী (সা.)-বলেন সোমবার ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমলনামা আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়ে থাকে। অতএব রোজা অবস্থায় আমার আমলনামা পেশ করা হোক এটা আমি পছন্দ করি। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর সুন্নতমতো জীবনযাপনে ব্রতী হওয়া যার কোনো বিকল্প নেই। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-দশম হিজরীতে মক্কায় হজ্ব পালনের ই”ছা প্রকাশ করেন। এটা ছিল তাঁর জীবনের শেষ হজ্ব। তিনি এরপর আর হজ্ব করার সুযোগ পাননি। তাই একে বিদায় হজ্ব বলে। হজ্ব শেষ করে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-মদিনায় ফিরে আসেন। এর তিন মাস পর তিনি জ্বরে আক্রান্ত হন। যতদিন তাঁর শরীরে শক্তি ছিল,ততদিন তিনি নামাজে যোগ দিতেন। কিন্তু শেষে তাঁর শরীর এত দুর্বল হয়ে পড়ল যে,তিনি হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-কে তাঁর পরিবর্তে নামাজের ইমামতি করতে আদেশ দিলেন। তাঁর অবস্থা ধীরে ধীরে খারাপ হতে লাগল। অত:পর ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার ৬৩ বছর বয়সে আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মদ (সা.)-ইন্তেকাল করেন। মদিনা শরীফে মসজিদে নববি বিশ্বের মুসলমানগন ভক্তিভরে নবীর রওজা জিয়ারত করেন। রাসূলের ভালোবাসা শুধু রবিউল আউয়াল মাসে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়; বরং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে সিরাত চর্চা করা, তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা ও তাঁর জীবনাদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা উচিত। তবেই প্রমাণিত হবে আমরা আশেকে রাসূল এবং রক্ষিত হবে রবিউল আউয়াল মাসের মর্যাদা।
অতএব, রসুলে আকরাম (সা.)-এর আগমনের এই মাসকে কেন্দ্র করে তার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে তার মহান আদর্শ ও সুন্নতকে আঁকড়িয়ে ধরে ইহকালীন ও পরকালীন অগ্রগতি ও মুক্তিলাভে সাফল্যমন্ডিত হওয়া। ১২ই রবিউল আউয়ালের বারাকাত, রসুলে আকরাম (সা.)-এর মহব্বত ও পরকালীন নাজাত আল্লাহ আমাদের সবাইকে নসিব করুন। সকলেই পড়ি—আল্লাহুম্মা সাল্লে আলা সাইয়েদিনা মুহাম্মদ, ওয়ালা আলেহি ওয়া আসহাবিহি ওয়া সাল্লাম। আমাদের হৃদয়ে জারি থাকুক বিশ্ব নবীর (সা.)-ভালোবাসা। আমিন।
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট