রশীদ এনাম
সবারে বাসবে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে, আছে তোর যাহা ভালো, ফুলের মতো দে সবারে
নইলে মনের কালো ঘুচবেনারে- কবি অতুল প্রসাদ সেনের কবিতার চরণগুলি করোনাকালীন সময়ে হৃদয়ের খোলা জানালায় উকি দিয়ে যায়। ঈদ কড়া নাড়তে শুরু করেছে। শপিংমলগুলোতে ঈদের আমেজ আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। বছর দুয়েক আগে ঠিক এই সময়ে মৃত্যুর মিছিলে আমরা দেখেছি। খুব কাছের মানুষের চলে যাওয়া দেখেছি চোখের সামনে। ভয়াবহ করোনার গ্রাসের কথা কিভাবে ভুলি ? প্রকৃতির তার আপন ঠিকানায় ফিরেছে চারিদিকে সবুজের বেষ্ঠনী। বদলে গেছে মানুষের মন। মানুষ যেন আজ রঙিন ফানুষ। শান্তির পায়রা আজ মনিবের কথা শুনে না চক্রাকারে যেন উড়ছে আর উড়ছে। সবকিছু যেন এলোঝেলো। মায়া, মমতা মানবিকতা, ভালোবাসার শেষ পেড়েকটুকু যেন কফিন বাক্সে বন্ধী। ছোট বেলায় ঈদের আগেরদিন বাবার হাত ধরে শপিং করতে যেতাম। বাবা কতো দরকষাকাষি করতেন এই দোকান থেকে ঐ দোকানে শুধু দুটো টাকা বাঁচানোর জন্য। আহা ছোট বেলায় দেখতাম চাকুরিজীবী বাবা তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং সন্তানদের ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে শেষে নিজের জন্য কিছু কিনতেন না কারন তাঁর সীমিত আয়ের টাকা কেনাকেটাতে শেষ। ঈদের দিন দেখতাম বাবা পুরানো জুতো জামা-কাপড় লন্ড্রি দোকান থেকে এনে ঈদের দিন পরিধান করতেন।
ঈদের দিন বাবার চেহারায় আনন্দের কমতি থাকত না, কেননা তিনি সামান্য ঈদ বোনাসের টাকায় নিজের ভোগবিলাস বিসর্জন দিয়ে অনেকের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন। সবার আনন্দে দেখে বাবা যে কি পরিমান আনন্দ উপভোগ করতেন সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাই। সময় ফুরিয়ে যায় হারিয়ে থেকে যায় সব ধুলামাখা স্মৃতি। মধ্যেবিত্ত পরিবারের সব বাবারা বোধহয় এমনই হয়। নিষ্পেষিত পরিবারে ঈদ আনন্দ কেমন হয় জানি না। ওদের বাবামায়েরা কিভাবে সন্তানদের সাথে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে ভাবতে ভাবতে চোখের কোণে জল গড়িয়ে পরে।
আমার একটা হেল্পলেস চাইল্ড ইশকুল ছিল চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলওয়ে জাদুঘর এলাকায়। বেশ কয়েক বছর ধরে নিষ্পেষিত পরিবারে চাঁদমুখো শিশুদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ওদেরকে ঈদের ভালোবাসা হিসেবে নতুন জামা বিতরণ করে এসেছি। আমি খুব কাছ থেকে উপভোগ করতাম নুতন জামা-কাপড় পাওয়ার পর ওদের যে আনন্দ আমার মনে হতো ঈদের আগে যেন ঈদের চাঁদ ও আনন্দে নেমে এসেছে। ওদের বাঁধভাঙ্গা হাসি দেখে আনন্দে ভাসতাম। সংগঠনের কর্মীরা সবাই জীবনে তাগিদে কর্মজীবনে কেউ বা বদলী হয়ে অন্য জেলায় চলে গেছে। ঘরের খেয়ে আজকাল খুব কম মানুষে বনের মোষ তাড়ান। মহত্তম কাজ সবাই করতেও পারে না। বছর তিনেক ধরে ওদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করা হয়নি আমার। সহমর্মিতাদের জন্য কিছু করতে না পারলে ঈদ আনন্দ কিংবা ঈদের আমেজ কি থাকে। আহা ! দেশের প্রতিটি অঞ্চলে কিংবা আপনার চারপাশে আছে নিষ্পেষিত পরিবার ছড়িয় ছিটিয়ে আছে। ওদের মনের আকাশে ঈদের চাঁদ উঠে না। ওদের চুলোয় সেমাইয়ের রন্ধন হয় না। আপনি কি জানেন ?
আপনার ঘরের সেমাই-কোরমা পোলাউ এর সুগন্ধ নাকে গেলে ওদের জিভে জল আসে ওরা সুগন্ধটুকু নিয়ে অনাহারে রাত্রি যাপন করেন। ওরা ঢুকরে ঢুকরে কাঁদেন। ওদের নীরব কান্নার শব্দ সৃষ্টিকর্তার কানে বোধহয় পৌঁছায় না। তবে পৌঁছলে নিশ্চয় আল্লাহর আড়শ কেঁপে উঠত। দেশের নি¤œ আয়ের কেটে খাওয়া মানুষ অর্থের অভাবে ঈদের নতুন জামাকাপড় ক্রয় করতে পারে না। পারে না তাঁদের চাঁদমুখো সন্তানদের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটাতে। একবার ভেবেদেখুন আজ যদি আপনি ওদের অবস্থানে থাকতেন। আপনার কি অবস্থা হতো। প্রতিটি মানুষের উচিত নিষ্পেষিত পরিবারের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়া কিংবা ঈদের আনন্দভাগাভাগিতে এক চিলতে ঈদের উপহার দেয়া যেতে পারে। প্রতিটি মানুষের পেশাগত দায়িত্বেও পাশাপাশি অসহায় সুবিধা বঞ্চিত ও সহমর্মিতাদের কথাও ভাবা উচিত কেননা ওরা আমাদের কারও না কারও আপনজন। ভালোবাসার কোন বিকল্প নেই। ঈদ উপলক্ষে একচিলতে ভালোবাসা বিনিময় করে দেখুন অনেক আনন্দ পাবেন তৃপ্তি পাবেন সুখ পাবেন। যেটা কখনো আপনি লক্ষ টাকা দিয়ে শপিং মল থেকে কিনতে পাবেন না। এক চিলতে ভালোবাসা দিয়ে সহমর্মিতার সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করি। আনন্দ শেয়ার করলে নাকি আনন্দ দ্বিগুন হয়ে যায়। দুঃখ শেয়ার করলে দুঃখ কমে। আসুন ঈদে নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক