মিঞা জামশেদ উদ্দীন
পোড়াগন্ধ বীভৎসতা ছড়ায়। এ বীভৎসতায় চমকে উঠি! আজকাল ঘরে-বাইরে, সবখানে আগুন পোড়া-গন্ধ। দাউ দাউ জ্বলছে আগুন। কেন এত আগুন তারও যেন অন্ত নেই। মনেও আগুন; এ আগুন কেউ কেউ দেখে, কেউ দেখতে পায় না। যেন তুষের আগুন নিরবধি জ্বলে, অঙ্গার হয় জীবন-যৌবন। তবে আগুনের মেলা ফিরিস্তি আছে। একসময়ে পাড়াগাঁয়ে আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে, জনে জনে হাতে-হাতে বালতি, কলসি, হাঁড়ি-পাতিল ও জগ নিয়ে বের হওয়ার ইতিহাস আছে। গ্রামের নারী-পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার সেকি প্রাণপণ চেষ্টা। অতঃপর নাগালের পুকুর-কূয়া থেকে পানি এনে আগুন না নিবিয়ে ফেরা হতো না। তারা সমানে আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসতেন। প্রবাদবাক্য আছে, সতিনের মুখে ছাই, তবুও পাড়া-প্রতিবেশীর ঘরদুয়ারে আগুন না লাগে। ৭১ সালেও দাউ দাউ আগুন জ্বলে। তবে আজকের মতো এত আগুন দেখা যায়নি। ৭১ সালে মাইলের পর মাইল ঘরদোর ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান, মিল-কারখানা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। তারা শত্রু মনে করে নির্বিচারে আগুন দিয়েছে জনবসতিতেও। বিশেষ করে স্বাধীনতাপন্থি হিন্দু-মুসলিম পরিবারের ঘর-বাড়িতে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাইভস্ম করে দেয়। তাই আগুনে লেলিহান দেখলে মাথা আউল-বাউল হয়ে ওঠে। ১৮/৩/২৫ ইং-এর দৃশ্যপট। এদিন অন্যদিনের চেয়ে ঘুম ভাঙে একটু দেরিতে। অবশ্য বলতে গেলে, রাতে একেবারেই ঘুম হয়নি। শত চেষ্টার পরও একবিন্দু পরিমাণ ঘুম আসেনি। সেহেরি খাওয়ার পরও ঘুম আসেনি। অনেকটা সকালে সকালে ঘুম হয়। তাই, সঙ্গত কারণে একটু দেরিতে ঘুম ভাঙে। নাহয় দিনভর তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব থাকে চোখেমুখে, আর যেখানে যায় ‘হা’ হয়ে ঝিম খাটতে হয়। এই এক বিশ্রী ব্যাপারস্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তবে, বিকেল গড়িয়ে গেলে শরীর আস্তে-আস্তে আবারও চাঙা হয়।
ওইদিনও যথানিয়মে ঘুম থেকে ওঠে দরজা খোলা হয়। কিন্তু অদূরে-আঙ্গিনায় দাউ দাউ আগুন জ্বলছিল। সমানে ধুয়োর কুন্ডলীও পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশে ওড়ছে। সম্ভবত কিছু খড়খুড়োতে আগুন দিয়েছে কেউ একজন। কিন্তু ওই মুহূর্তে এর ধারেকাছে কাউকে দেখছি না। এমতো, আগুন ছড়িয়ে পড়লে কি-যে দশা হবে; এমনিতে এখন চলছে শুষ্কমৌসুম। চারিদিকে কাল-বিল পুকুর শুকিয়ে খাঁ-খাঁ করছে। আর প্রকৃতির নিয়মে যেখানে সেখানে গাছের মরমরে-শুকনো পাতার স্ত‚প। অনেকটা ঝরাপাতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সবখানে। একটু থেকে একটু হলেই বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পড়বে আগুন। রীতিমতো নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হবে না। হ্যাঁ, বলি কি, নাহয় দ্রুত ফায়ারসার্ভিসকে খবর দেওয়া গেল। তারাও ঢংঢং- হুইসেল বাজিয়ে ছুটে আসবে। কিন্তু এতক্ষণে সবই শেষ হয়ে যাবে! তবে এ ফায়ারসার্ভিসের আগুন নেবানোরও একটি রুটিন মাফিক কাজ। বলতে হয়, হাজিরা দেয়াটা বা চাকরি গোড়ায় পানি দেয়া। তবে ব্যতিক্রম কিছু যে দৃষ্টান্ত নেই তা-ও না। আগুন নিবাতে গিয়ে ফায়ারসার্ভিসের অনেক জোয়ানকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তবে এও ঠিক, এ পর্যন্ত যতখানে আগুন লেগেছে, ফায়ারসার্ভিস ঘটনার স্থলে আসতে আসতে আগুনে পুড়ে একেবারে অঙ্গার; হ্যাঁ, ফায়ারসার্ভিস দ্রæত আসালে যে কাজটুকু হয়— অন্তত আগুনের বিস্তৃতি ঠেকানো যায়। এছাড়া তাদেরও প্রস্তুতি নিতে হয়-ওই দ্রæত সময়ে। এবং বাতাসের বেগেতো ছুটে আসাও দেখাযায়; অতঃপর যন্ত্রপাতি, পাইপ বসাতে-বসাতে যেসময়ক্ষণ লাগে… অবশ্য এখনতো আগের মতো হাতের নাগালে পুকুর-কূয়া-দীর্ঘি নেই। শহরে মতো গ্রামেও ঢেউ লেগেছে-এ মহামারির, আকাল। জলাশয়-পুকুর, দীর্ঘ, কূয়া, খাল, নদী ভরাট-দখল চলছে সমানে। চট্টগ্রাম শহরে হাতেগোণা যে কয়টি দীর্ঘ এখনো ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায় টিকে আছে, তারমধ্যে লাল দীঘি, আসকার দীঘি ও বল্লারদীঘি অন্যতম। তবে আগ্রাবাদ এলাকায়, অর্থাৎ চেম্বার ও কমার্স-এর অফিস লাগোয়া আরো একটি বড় দীঘি আছে। এ মুহূর্তে এ দীঘির নাম স্মরণে নেই। বলতে হয় প্রকৃতিগতভাবে পর্যাপ্তপরিমাণ পানি না থাকলে ফায়ারসার্ভিসের বাউসারের-ওইটুকু পানি দিয়ে কতক্ষণবা সামাল দেয়া যায়। তবুও পাড়াগাঁয়ে এখনো হালকা-পাতালা, গুটিকয়েক পুকুর-কূয়া দেখাযায়। অন্তত এটুকু ভরসা রাখা যায় গ্রামের ক্ষেত্রে।
অবশ্য পরক্ষণে ওই আগুনে নিকটে একজন নারীকে অর্ধবিবস্ত্র অবস্থায় দেখা যায়। সে একটি খুঁটি দিয়ে খড়খুড়ো নেড়ে ছেড়ে দিচ্ছিল, এতে আগুন আরো দ্বিগুণ লকলকিয়ে ওঠে। কিন্তু আমাদের আঙ্গিনায় কেন আগুন? রামের রাজ্য পেয়েছে নাকি; এ আগুন ছড়িয়ে পড়েলে কে দায়ী নেবে।
এর মধ্যে ভারতের মহারাষ্ট্রেও আগুন; একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্য দেখে হিন্দু স¤প্রদায়ের কিছু উগ্র লোকজন ক্ষেপে ওঠে। বিশেষ করে উগ্রবাদী হিন্দুরা রাস্তায় নেমে সমানে জ্বালাওপোড়াও এবং দোকানপাট ভাংচুর ও লুটপাট চালায়। তারা মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধিসৌধও ভাংতে চেষ্টা করে। তাতে মুসলিমরাও প্রতিরোধ করতে চেষ্টা করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার লেগে যায়। অবশ্য ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনী সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধিসৌধ ঘিরে রাখে। তাঁরা সমাধিসৌধের ধারেকাছে কাউকে ডুগতে দেননি। গত মঙ্গলবার এ দাঙ্গা বেঁধে যায়। সাংবাদিক মাসুদ কামাল তাঁর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরো জানান, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড ভারতে অবস্থান করছিলেন। তিনি বিশ্বের বাঘা বাঘা প্রধান ২০ রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের সাথে বৈঠক করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের
সভাপতিত্বে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান অজিত কুমার ডোবালও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। মার্কিন এ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান দিল্লিতে অবস্থান করা সাবেক-পতিত সরকারের প্রধান শেখ হাসিনার সাথেও সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া ভারতের শীর্ষপর্যায়ে এক পত্রিকায় ভারতীয় বংশভূত এ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানের সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করেন, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ক্যাথলিক ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুর্ভাগ্যজনক নিপীড়ন, হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতন যুক্তরাষ্ট্র সরকার, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসনের উদ্বেগের একটি প্রধান ক্ষেত্র। তবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার শুরুতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশ চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে আসছেন। তিনি সরাসরি বলেছেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিবর্তনে ২৯ মিলিয়ন ডলার, ইউএসএআইডির অর্থায়নের সম্পৃক্ততার কথা জানান। তিনি এ বিষয়ে আরো বলেন, শীর্ষ দু-ব্যক্তি ও একটি সংগঠন এ অর্থ গ্রহণ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের-এ অভিযোগ একেবারে ওড়ে দেয়ারও সুযোগ নেই। ইতিমধ্যে বিশ্ব দেখেছে, তাঁর হুমকি ও গর্জন। ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ কার্যকর হয়েছে। রাশিয়া ও উইক্রেনের মধ্যে চলমান যুদ্ধের লাগাম টানতে শুরু করেছেন তিনি। এরমধ্যে ইউক্রেনের সকলপ্রকার অস্ত্রশস্ত্র ও সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে উত্তপ্ত বাকবিতন্ডা হওয়ার দৃশ্যও বিশ্ববাসী দেখেছেন। অবশ্য এরপর দ্বিতীয় অধিবেশনে ভলোদিমি জেলেনস্কিনের সাথে ডোনাল্ড ট্রাম্প আর বৈঠক করেননি। এমতাবস্থায় দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর সরকার কতদিনবা স্থায়ী হবে। যদিওবা জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সাম্প্রতিক বাংলাদেশে তিনদিন সফরে এসে ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি পূর্ণসমর্থন ব্যক্ত করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব আরো বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের এ সংস্কারের প্রতি তাঁদের দ্বিমত নেই এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের প্রতিও জোর দেন তিনি। একইসাথে বিতাড়িত হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিদের সমস্যা নিয়েও বিশ্ববাসীর সহযোগিতা আহবান জানান তিনি। তবে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ক্রমাগত উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। বিশেষ করে মাঠপর্যায়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি শীঘ্রই নিবার্চনের দাবি করে আসছে। তারা ঈদের পরে আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে চাপের মুখে রাখতে চাইবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে। আবার কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনের আগে সংস্কার দ্রুত বাস্তবায়ন চায়। বিশেষ করে নতুন-বিপ্লবের ছাত্র-জনতা সংস্কার শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন চায় না, তারা তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে। তারা মাঠেও রয়েছেন সমানে এবং সভা-সমাবেশও চালিয়ে যাচ্ছে। বলতে কি, রাজনীতির মাঠ দিনে দিনে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আইনশৃঙ্খলাও চরম অবনতি ঘটেছে। মাঠপর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনও অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। তারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে মোটেই ভরসা পাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে তাদের হাত থেকে জোরপূর্বক গ্রেপ্তারকৃত আসামি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনাও ঘটছে। তারা পদে পদে লাঞ্ছিত হওয়ায় একধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
লেখক: কবি, গবেষক ও কলামিস্ট