ইসলামে শ্রম ও শ্রমিক: মর্যাদা, দায়িত্ব ও অধিকার

1

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। যাতে মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের যাবতীয়বিষয়ে হিকমতপূর্ণ বিধান ও নীতিমালা বিদ্যমান। ইসলাম মানুষের জন্য যা কল্যাণকর ও হিতকর তা পালনে সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে এবং যাঅকল্যাণ ও ক্ষতিকর তাহতে সতর্ক করেছে। মানুষকে তার মেধা, শ্রম ও সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে তার জীবন নির্বাহের অবলম্বন হিসেবে কোন একটি বৈধ পেশা গ্রহণ করার প্রতি তাকিদ দিয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। এগুলোর যোগান দিতে মানুষকে বেছে নিতে হয়;কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরী, শিল্প ইত্যাদি পেশা। উপার্জনের মাধ্যম ব্যতীত কোন ব্যক্তির পক্ষেই তার মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা সম্ভব নয়। যেহেতু উপার্জন মানবজীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাই ইসলামের দিকনির্দেশনা হলো, হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করতে হবে। প্রতারণা, মিথ্যা, ধোঁকাবাজি, সুদ-ঘুষ, চুরি-ডাকাতি, রাহাজানি, ছিনতাই, জুয়া, মিথ্যাচার ইত্যাদির মাধ্যমে জীবিকা উপার্জন করা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “ফরয আদায়ের পর হালাল পন্থায় উপার্জনও ফরয।” (বায়হাক্বী ১১৬৯৫)
আল্লাহ তা‘আলা এরশাদ করেন,‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পবিত্র বাস্তু-সামগ্রী আহার করো, যেগুলো আমি তোমাদেরকে রিয্ক হিসাবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা একমাত্র তাঁরই ইবাদত করে থাকো।’ (বাক্বারাহ- ১৭২)
আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে তাঁর ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। আর ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য হালাল রূযী গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। সে জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘হে মানবসকল! নিশ্চয় আল্লাহ পবিত্র, তিনি একমাত্র পবিত্র বস্তুকেই কবুল করেন। আল্লাহ তাআলা রাসূলগণকে যে আদেশ করেছেন, মুমিনগণকেও সেই আদেশ করেছেন। আর তা হলো, ‘হে রাসূলগণ! তোমরা হালাল-পবিত্র খাদ্য গ্রহন করো এবং সৎ আমল করো।’ (মুমিন- ৫১)
তাই ইসলামী দিকনির্দেশনা মোতাবেক হালাল পথে রূযী-রোযগার করলে সেটিও ইবাদতের মধ্যে গণ্য হবে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘অতঃপর যখন নামায শেষ হবে, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো, আল্লাহর অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ করো এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হ’তে পারো।’ (জুম‘আ-১০)
শ্রম হলো উন্নয়ন ও উৎপাদনের চাবিকাঠি। যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী, সে জাতি তত বেশি উন্নতি লাভ করতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হালাল পন্থায় কাজ করে খাওয়াকে উৎসাহিত করেছেন। তিনি নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন এবং এটাই তিনি খুব বেশি পছন্দ ও স্বাছন্দ্যবোধ করতেন। বিনাশ্রমে অর্জন-উপার্জন করাকে তিনি ঘৃণা করতেন। নিজের পরিশ্রমলব্দ উপার্জনকে সর্বোত্তম উপার্জন বলে আখ্যায়িত করে এরশাদ করেন, ‘কোন ব্যক্তি তা থেকে উত্তম আহার করেনি, যা সে নিজ হাতে উপার্জন করে আহার করেছে। আল্লাহর নবী হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম নিজ হাতে উপার্জন করে আহার করতেন।’ (বুখারী: ২০৭২)
তাই শ্রম বা কাজ হলো নবীগণের সুন্নত। প্রত্যেক নবীই জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো না কোনো বৈধ পেশা চয়ন করে নিয়েছেন। তাঁরা নিজেরা কাজ করে উম্মতকে শ্রমের মর্যাদা সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন। সাথে সাথে এ বিষয়েওউম্মতকে অবহিত করে গেছেন যে, কোনো বৈধ পেশাই ঘৃণিত নয় এবং কোনো পেশাতে শ্রেণিবৈষম্যও নেই। বরং প্রতিটি শ্রমই মর্যাদার ও সম্মানের। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেটে খাওয়া মানুষের মর্যাদা বর্ণনা করে এরশাদ করেন, ‘শ্রমিক হলো আল্লাহর বন্ধু।’(রূহুল বায়ান-৫/২২৯)
ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি ইসলামের ঘৃণা ও নিন্দা: ইসলাম যেমনিভাবে শ্রমের মর্যাদা প্রদানপূর্বক শ্রমের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছে; তেমনিভাবে প্ররিশ্রম না করে ঘৃণিত পেশা ভিক্ষাবৃত্তিকে নিন্দা ও নিরুৎসাহিত করেছে। ইসলামে ভিক্ষাবৃত্তিকে কখনো প্রশ্রয় দেয়া হয়নি। বরং কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করে এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অভাব ব্যতীত ভিক্ষা করলো; সে যেন জাহান্নামের আগুন ভক্ষণ করলো। (মুসনাদে আহমদ:৫১) এবং কেয়ামত দিবসে ভিক্ষাবৃত্তির পরিচয় স্বরূপ ওই ব্যক্তির মুখমÐলে আঁচড় ও ক্ষতচিহ্ন থাকবে।’ (তিরমিযী-৬৫০)
ইসলাম শুধু শ্রমের প্রতি গুরুত্ব প্রদান করেই শেষ করেনি; বরং শ্রমিক ও মালিকের মধ্যকার সম্পর্ক কীরূপ হবে এবং শ্রমিকের অধিকার সংরক্ষনে কী কী ন্যায়গত নীতিমালা প্রয়োজন তাও নির্ধারণ করে দিয়েছে। শ্রমিক ও নিজের অধীনস্থদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, তাদের ন্যায্য মজুরি না দেওয়া ও তাদের নির্যাতনের ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসে কঠোরভাবে হুশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র ইসলামই খেটে খাওয়া ও শ্রমজীবী মানুষের প‚র্ণ অধিকার নিশ্চিত করেছে। শ্রম ও শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে প্রেরণার বাতিঘর ও অগ্রদ‚ত হলেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনিই শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের অধিকার সুরক্ষার দাবিতে বিশ্বের ইতিহাসে সর্বপ্রথম আওয়াজ তোলেন।

ইসলামে শ্রমিকের প্রতি মর্যাদা:
ইসলাম শ্রম ও শ্রমিকের প্রতি যথাযথ মর্যাদা দিয়েছে।হযরত সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু কামারের কাজ করতেন। হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতে করতে তাঁর দুই হাত বিবর্ণ ও শক্ত হয়ে গিয়েছিল। এক দিন রাসুল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তিনি করমর্দন করলেন। তখনরাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাদ রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহুকে হাতের খসখসে অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, হাতুড়ি দিয়ে কাজ করতে গিয়ে এ অবস্থা হয়েছে। রাসুল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার হাত চুম্বন করে বললেন, এ ধরনের হাতকে আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন এবং এ ধরণের হাতকে কখনো জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না।(মাবসূত-৩০/২৪৫)
ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পদের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা আল্লাহ তাআলার, আর মানুষ তার তত্ত¡াবধায়ক মাত্র। সুতরাং এখানে মালিক-শ্রমিক পারস্পরিক সম্পর্ক হবে শ্রদ্ধা, স্নেহ, সৌহার্দ ও বিশ্বস্ততাপূর্ণ। ইসলামী শ্রমনীতিতে মালিক ও শ্রমিকের সম্পর্ক হবে ভাই-ভাই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তারা তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন। সুতরাং যার ভাইকে তার অধীন করেছেন সে যেন তাকে তাই খাওয়ায় যা সে খায়, সে কাপড় পরিধান করায়, যা সে পরিধান করে। তাকে তার সামর্থ্যরে অধিক কোনো কাজের দায়িত্ব দেবে না। যদি এমনটা করতেই হয়, তাহলে সে যেন তাকে সাহায্য করে। (বুখারি: ৩০, ৫৬১৭. মুসলিম-১৬৬১)
শ্রমিক ও মালিক উভয়ের যেভাবে পরস্পরের উপর অধিকার রয়েছে ঠিক সেভাবে উভয়ের উপর কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্যও রয়েছে। নিজ নিজ প্রাপ্য বুঝে পেতে হলে উভয়কে নিজ নিজ কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে সচেতন হতে হবে। ইসলাম মালিককে যেভাবে শ্রমিকের সঙ্গে সবদিক থেকে নিজের আপজনদের ন্যায়-আচরণ করতে বলেছে, ঠিক একইভাবে শ্রমিককেও মালিক কর্তৃক তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনেও সজাগ থাকতে নির্দেশনা দিয়েছে এবং তার সামর্থ্য অনুযায়ী তা আদায় করতে বলেছে।

সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে দৈহিক দিক থেকে শক্তিশালী ও আমানতদার: শ্রমিককে হতে হবে দক্ষ, বিশ্বস্ত ও দায়িত্ববান। পবিত্র কোরআনে হযরত মুসা আলাইহিস সালামের দক্ষতা, বিশ্বস্ততা ও আমানতদারীতার বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, হে পিতা! আপনি তাকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিন। নিশ্চয় আপনার শ্রমিক হিসেবে সে-ই উত্তম যে সামর্থ্যবান ও বিশ্বস্ত-আমানতদার। (কাসাস-২৬)

সঠিক সময়ে বেতন পরিশোধ করা মালিকের দায়িত্ব: বেতন ও পারিশ্রমিক কর্মজীবী ও শ্রমিকের অধিকার; ইসলাম যা দ্রুততম সময়ে আদায়ের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজাহ-২৪৪৩)
যে কোন অজুহাতে বেতন-ভাতা ও প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা মারাত্মক অপরাধ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির বিপক্ষে আল্লাহ তাআলার দরবারে মামলা করব। তাদের মধ্যে একজন হলো সে ব্যক্তি; যে কাউকে শ্রমিক হিসাবে নিয়োগ দেওয়ার পর তার থেকে কাজ বুঝে নিয়েছে অথচ তার প্রাপ্য আদায় করেনি। (বুখারি-২২২৭)
সম্মানজনক জীবন ও জীবিকা শ্রমিকের অধিকার: শ্রমিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব মালিকেরই। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, মালিকানাধীন অধীনস্ত ব্যক্তির খাবার ও কাপড়ের অধিকার রয়েছে। (মুসলিম: ১৬৬২)
মানবতার মুক্তির দিশারী প্রিয় নবীজি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজের ভাষণে এরশাদ করেন, তারা তোমাদের ভাই, আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের কর্তৃত্বাধীন করে দিয়েছেন, তোমরা যা খাবে তা তাদেরকেও খাওয়াবে, তোমরা যা পরিধান করবে তা তাদেরকেও পরিধান করাবে, তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ দিবে না, আর যদি অনুরূপ দায়িত্ব দাও, তাতে তোমরাও সহযোগিতা করবে।’ (বুখারী-২৪০৭)
শ্রমিক ও অধিনস্থদের সাথে প্রিয় নবীজি কীরূপ আচরণ করতেন তার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের খাদেম হযরত আনাস ইবনে মালেক রাদ্বিয়াল্লাহু তাআলা আনহু। তিনি বলেন, আমি ১০ বছর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খেদমত করেছি; কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তিনি কখনো আমার কোন কাজে ‘উহ’ শব্দটি পর্যন্ত করেননি। আমি করেছি এমন কোন কাজের ব্যাপারে তিনি কখনো জিজ্ঞেস করেননি যে, কেন করেছি? আর না করার ব্যাপারেও তিনি কখনো জিজ্ঞেস করেননি যে, কেন করোনি? (বুখারী-৩৫৪৬১)
শ্রমিকের অধিকার ও মানবিক মর্যাদা এবং মালিকের প্রাপ্য সেবা লাভের এমন ভারসাম্যপূর্ণ শ্রমনীতি একমাত্র ইসলামই দিয়েছে। ইসলাম শ্রমের মর্যাদা, শ্রমিকের অধিকার ও মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বিষয়ে যে নীতি-নির্দেশ প্রণয়ন করেছে তা যথাযথ অনুসৃত হলে আজকের দিনে বিশ্বের কোটি কোটি শ্রমিককে তাদের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে হতো না।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়
খতীব- মুসাফিরখানা জামে মসজিদ