সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী
হিজরী সন বা ইসলামি ক্যালেন্ডোর শুধুমাত্র একটি দিন-তারিখ গণনার পদ্ধতি নয়, এটি মুসলিম জাতির ইতহিাস, ঐতহ্যি এবং ধর্মীয় বিধি-বিধান অনুশীলনরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি। কারণ চন্দ্রমাসের প্রভাব মুসলমানদের জীবনে ব্যাপক। জীবনের সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব ও গুরুত্ব রয়েছে। বিশেষত ইবাদতের তারিখ, ক্ষণ ও মৌসুম নির্ধারণের ক্ষেত্রে এর প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। এ কারণে হিজরী সনের হিসাব স্মরণ রাখা মুসলমানদের জন্য অতীব জরুরি।
মুসলমানগণ হিজরী সনকে ভিত্তি করে বিভিন্ন ধর্মীয় বিধি-বিধান যথাঃ রমযানের রোযা, ঈদুল ফিতর, ঈদুল আয্হা, ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম, হজ্ব, যাকাত, শবে-বরাত, শবে-ক্বদর, শবে-মি’রাজ, আ’শুরা এবং বিভিন্ন মাসের নফল রোযা ইত্যাদি পালন করে থাকেন। এমন কি স্বামীর মৃত্যুর পর মহিলাদের ইদ্দতের ক্ষেত্রগুলোতেও চন্দ্রবর্ষের হিসাবে গণনা করতে হয়। তাইতো মহান আল্লাহ এরশাদ করেন, “হে হাবীব! আপনার নিকট তারা জিজ্ঞেস করবে নতুন চাঁদের বিষয়ে। আপনি বলে দিন, এটি মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ এবং হজ্বের সময় ঠিক করার মাধ্যম। (বাকা¡রাহ-১৮৯)
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেন: “তিনিই সে মহান সত্তা, যিনি বানিয়েছেন সূর্যকে উজ্জ্বল আলোকময়, আর চন্দ্রকে স্নিগ্ধ আলো বিতরণকারীরূপে অতঃপর নির্ধারিত করেছেন এর জন্য মনযিলসমূহ, যাতে করে তোমরা চিনতে পার বছরগুলোর সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ এই সমস্ত কিছু এমনিতেই সৃষ্টি করেন নি, কিন্তু যথার্থতার সাথে। তিনি প্রকাশ করেন লক্ষণসমূহ সে সমস্ত লোকের জন্য যারা জ্ঞানী।” (সূরা ইউনূস: আয়াত- ৫)।
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেন: “নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করো না। (সূরা আত-তাওবাহঃ ৩৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, বারো মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক: যিলক্বদ, যিলহজ্ব, মুহররম। আর চতুর্থটি হল রজব মুদার, যা জুমাদা আল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারী-৩১৯৭, মুসলিম-১৬৭৯)
চন্দ্রের প্রভাব ও গুরুত্ব :
চাঁদের আবর্তন ও বিবর্তনে সদা সচেতনতা ও গূঢ় পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন হয়। নিছক সূর্যের মতো উদিত হওয়া ও অস্ত যাওয়ার মধ্যেই চাঁদ সীমীত নয়। শুধু তাই নয়, চাঁদের উপরেই নির্ভর করে পৃথিবীর অনেক প্রাকৃতিক গতি বিধি, যেমন সাগরের জোয়ার ভাটা, মানুষ, পশু-পাখি, উদ্ভিদরাজি ইত্যাদি অনেক কিছুই লুনার সাইকেলে বা চন্দ্রের আবর্তনে অবর্তিত হয়ে থাকে।
হিজরী সনের ইতিহাস :
ইসলামের পূর্বে দিন-তারিখ গণনার জন্য আরবদের এমন কোন ঐতিহাসিক উৎস ছিল না, যাকে কেন্দ্র করে তারা কয়েক দশক বা শতাব্দীকে চিহ্নিত করতে পারত। অবশ্য তারা তারিখ গণনার জন্য এক দশক বা কয়েক দশকের মধ্যে ঘটিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমূহকে উৎস করে তা কেন্দ্রিক সাময়িক তারিখ গণনা করত। যেমন আবরাহার হাতি বাহিনীর মাধ্যমে মক্কা শহরে হামলা; যা “আমুল ফী-ল বা হাতির বছর” নামে খ্যাত। কাবা ঘর সংস্কারের বছর; যা কয়েক যুগ পর্যন্ত তারিখ গণনার উৎস হিসেবে ব্যবহৃত ছিল। পরবর্তীতে হযরত মোহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুওয়তের প্রচারকালীন সময়ে যখন তিনি আরকামের গৃহে যান, তখন থেকে এটি তারিখ গণনার উৎস হিসেবে পরিণত হল। সর্বশেষ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতকে কেন্দ্র করে হিজরী সালের প্রবর্তন করা হয়।
হিজরতকে কেন্দ্র করে কেন এ সনের প্রবর্তন করা হয় ?
হিজরতের পর মদিনায় ইসলামের একটি শক্তিশালী- নিরাপদ ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা ও ইসলামী সমাজে এক নতুন জীবনের সূচনা হওয়ার কারণে হিজরত সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অন্য দিকে যেহেতু হিজরত আল্লাহর নিদের্শেই হয়েছিল, তাই এটি ছিল ইসলামের আবশ্যকীয় দায়িত্ব। বিনা কারণে মক্কায় অবস্থান গোনাহ হিসাবে বিবেচিত হত। উপরোক্ত কারণসমূহ হিজরতের বিষয়টিকে ইসলামী বর্ষ পঞ্জিকার সূচনা হওয়ার বিষয়টিকে যথাযথভাবে অনুমোদন করে।
কখন থেকে এ সনের প্রবর্তন করা হয় ?
কখন থেকে হিজরত ইসলামী বর্ষপঞ্জির উৎস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এ সম্পর্কে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকের মতে হিজরতের ১৭’তম বর্ষে (৬৩৮ খ্রীষ্টাব্দ) হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বিভিন্ন কারণে ইসলামী ইতিহাসের সূচনা নির্ধারণের জন্য ইসলামী বর্ষপঞ্জি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর কাছে ইরাক ও কুফার প্রশাসক হযরত আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এক চিঠিতে লেখেন, “আমিরুল মুমিনীন! আপনার পক্ষ হতে আসা শাসন কার্যের সাথে সংশ্লিষ্ট উপদেশ, পরামর্শ এবং নির্দেশ সম্বলিত বিভিন্ন চিঠিপত্র ও দলিলে কোন সন-তারিখ না থাকায় আমরা তার সময় ও কাল নির্ধারণে যথেষ্ট সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। অধিকাংশ সময় এসব নির্দেশনার মাঝে পার্থক্য করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে বলে আপনার নির্দেশ ও উপদেশ পালন করতে গিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
এ গুরুত্বপূর্ণ পত্র পাওয়ার পর তিনি মুসলিম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে এক পরামর্শ সভার আয়োজন করেন এবং প্রত্যেকেই এ বিষয়ে নিজ নিজ মতামত উপস্থাপন করেন। কেঊ কেঊ নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জন্ম বা মিলাদ দিবসকে, কেউ তাঁর নবুওয়ত প্রকাশের দিবসকে, আবার কেউ কেউ তাঁর ওফাত দিবসকে বর্ষপঞ্জির সূচনা হিসেবে প্রস্তাব করেন। এরই মাঝে আমিরুল মোমিনীন হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দিনটিকে ইসলামী ইতিহাস ও বর্ষপঞ্জির সূচনা হিসেবে প্রস্তাব করেন এবং এই প্রস্তাবটিই সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। ফলে হিজরতের এ ঐতিহাসিক দিন থেকে নতুন একটি সন তৈরী করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (ফতহুল বারী- ৩৭১৯. ইবনুল আসীর:আল কামেল- পৃ-১৪)
হিজরী সনের তাৎপর্য :
মুসলিম উম্মাহর কৃষ্টি-কালচারে হিজরী সন ও তারিখের গুরুত্ব অপরিসীম। হিজরতের ঘটনাকে স্মরণ করে হিজরী সন শুরু করার কারণ হলো, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদীনায় হিজরত করার মাধ্যমে ইসলাম প্রসার লাভ করে, মুসলিমদের সংখ্যা ও শক্তিমত্তা বাড়তে থাকে। ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ইসলাম বিজয়ী শক্তিতে পরিণত হয় এবং ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মৃতিবাহী হচ্ছে হিজরী সন। এতদিন মুসলমানরা নিরবে জুলুম অত্যাচার সহ্য করে কেবল আত্মরক্ষার প্রচেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু হিজরতের মধ্য দিয়ে এতসব জুলুম-অত্যাচারের প্রতিরোধ ও প্রতিকারের ক্ষমতা তাঁদের অর্জিত হয় এবং রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে ইসলাম আত্নপ্রকাশ করে। হিজরত পরবর্তী সময়ে মুসলমানরা ক্রমেই সুসংহত ও সম্প্রসারিত হয়েছে। ইসলাম বিশ্বজনীন রূপে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। ইসলামের অবদানে বিশ্ব সভ্যতা সমৃদ্ধশালী হয়েছে। এক সময়ে মুসলমানরা বিশ্বের এক অজেয় শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। জ্ঞান বিজ্ঞানের সকল শাখাকে অবিস্মরণীয় অবদানে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। এ সব কিছুরই শুভ সূচনা এই হিজরত থেকেই।
ফলে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর গুরুত্ব বিবেচনায় নবীজির মিলাদ বা ওহী নাযিলের সময়কে হিজরী বর্ষপঞ্জি না করে হিজরতকেই হিজরী সাল রূপে গণ্য করেন। এ সময় থেকেই ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং আদর্শগত ঐতিহ্যের প্রেক্ষিতে মুসলিমরা মুহাররম মাস দ্বারা বর্ষ গণনা শুরু করেন।
উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক দিন বা ঘটনা ভিত্তিক বহু সনই বিশ্বে প্রচলিত হয়ে আসছে। উদাহরণ স্বরূপ খ্রীস্টীয় স্মারক সন খ্রীস্টান ঐতিহ্যের সাথে সম্পৃক্ত। জাতিগতভাবে কোন জাতির পক্ষেই আপন ঐতিহ্য ত্যাগ করা সম্ভব নয়। মুসলিম পরিবারগুলোও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচলিত অন্যান্য সন তারিখ অনুসরণ করা সত্তে¡ও সূচনালগ্ন থেকেই হিজরী সনকে পাশাপাশি গুরুত্বের সাথে পালন করে থাকেন। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও আনন্দ-উৎসবসহ সব ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ্ হিজরী সনের অনুসারী। খ্রীস্টীয় সন, বাংলা সনসহ অন্যান্য সনের প্রচলন সত্তে¡ও আরবী সনের দিন-মাসের হিসাব চর্চা একটুুও ম্লান হয়নি।
বাংলাদেশে হিজরি সনের আবির্ভাব :
ইসলাম প্রচারের সাথে সাথেই বাংলাদেশে হিজরী সনের প্রচলন ঘটেছে। আমাদের এদেশে ইসলাম প্রচার শুরু হয় হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর খিলাফত কাল থেকেই। তখনকার ইসলাম প্রচারকগণই এদেশে হিজরী সনের প্রচলন করেন। হিজরী সনের বিভিন্ন মাসে ইসলামী বিধি-বিধান থাকার কারণে এদেশের জন-সমাজে হিজরী সনের ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যার প্রতিফলন ঘটেছে মুসলমানদের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ও ভারতে প্রচলিত বাংলা সন সম্পর্কে বলা যায়, হিজরী সনেরই চলমান পথে এক পর্যায়ে সৌরকরণের মাধ্যমে বাংলা সনের জন্ম। আর হিজরী সনই বাংলাদেশে প্রচলিত একমাত্র সন, যা প্রায় জন্মকাল থেকেই এখানে প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশে ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দ হতে সর্বক্ষেত্রে হিজরী সন ব্যবহার শুরু হয়। (তবাকাতে নাসিরী- ১/৫৪) উপমহাদেশে প্রায় ৫৫০ বৎসর রাষ্ট্রীয়ভাবে এই হিজরী সন স্বীকৃত ছিল। ইংরেজ শাসনকালে আমাদের দেশে অমুসলিমদের রাষ্ট্রীয় সনের প্রচলন হয় (১৭৯০ সাল হতে) যা আজও আমরা অন্ধের মতো অনুসরণ করছি।
এই পৃথিবীতে মুসলমানদের সংস্কৃতির পাশাপাশি আর যত সংস্কৃতি বর্তমানে রয়েছে সেগুলোর ভিত্তি স্ব-স্ব স্থানের অধিবাসীদের অনুসৃত ধর্মীয় বিশ্বাসের আলোকেই গড়া । কাজেই মুসলমান জাতি তাদের জন্যে আল্লাহর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নির্দেশে তাঁর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক নির্ধারিত সংস্কৃতি ছাড়া আর কোনো সংস্কৃতির অনুসরণের এখতিয়ার রাখে না।
বিশ্বের মুসলিমদের কাছে ইসলামী সন হিসেবে হিজরী সন অতি পবিত্র ও অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। শুধুমাত্র এই একটি সালই সমগ্র বিশ্বে সর্বত্র সমানভাবে সমাদৃত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের এই প্রেক্ষাপট ও পটভূমি যদি হিজরী নববর্ষে স্মরণ করা হয় তাহলে মুসলিম ভাই-বোনেরা ইসলামী সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারবে। তখনই কেবল ইসলামি সংস্কৃতি বিমুখ হৃদয়ে পরিবর্তন আসবে। তাই আমাদের উচিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হিজরতের তাৎপর্য স্পষ্টভাবে জনসম্মুখে তুলে ধরা। আল্লাহ আমাদের সকলকে সেই তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয় খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ