নামমাত্র একটি কক্ষের ভেতর থেকেই কাজ চালাচ্ছেন গাজার নাসের হাসপাতালের ফরেনসিক দল। সেখানে নেই কোনো ডিএনএ পরীক্ষার সুযোগ, নেই ঠান্ডা সংরক্ষণাগারও- তবু মৃত্যুর এই সময়েও তারা লড়ছেন নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে।
গত এগারো দিনে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ গাজায় ফিরিয়ে দিয়েছে ১৯৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ। এর বিনিময়ে গাজা থেকে ইসরায়েলে ফেরত গেছে ১৩ জন ইসরায়েলি জিম্মির দেহ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির অংশ হিসেবে।
গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, ফেরত দেওয়া অনেক মরদেহই অচেনা, কেউ কেউ শুধু অন্তর্বাস পরা, কেউ আবার পুরোপুরি উলঙ্গ। বেশিরভাগ দেহে একাধিক আঘাতের চিহ্ন দেখা গেছে। কারও হাত বাঁধা ছিল পেছনে, কারও আবার চোখে ছিল কাপড়ের ফিতা। খবর বিডিনিউজের
চিকিৎসকেরা বলছেন, কিছু মরদেহে গলার চারপাশে দড়ি বা কাপড় জড়ানো অবস্থায় পাওয়া গেছে। নাসের হাসপাতালের ফরেনসিক দল প্রায় কোনো সরঞ্জাম ছাড়াই কাজ করছে। অথচ তাদের ওপর বর্তেছে মৃতদেহ খতিয়ে দেখে নির্যাতন নিয়ে ওঠা প্রশ্নের জবাব দেওয়া এবং পরিচয় নির্ধারণের জটিল দায়িত্ব।
ফরেনসিক ইউনিটের প্রধান ডা. আহমেদ ধেইর বলেন, তাদের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা ঠান্ডা সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকা। ‘দেহগুলো সম্পূর্ণ জমাট অবস্থায় আসে। গলতে সময় লাগে কয়েক দিন, ফলে আমরা দাঁতের নথি মিলিয়ে দেখা বা অন্য কোনো মৌলিক পরিচয় যাচাইয়ের কাজও করতে পারি না, ময়নাতদন্ত তো দূরের কথা। পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল’- বলেন ধেইর।
তিনি বলেন, ‘যদি আমরা অপেক্ষা করি দেহ গলার জন্য, তাহলে দ্রুত পচন শুরু হয়, আর তখন সঠিকভাবে পরীক্ষা করার সুযোগই থাকে না। তাই আমরা যতটা সম্ভব নমুনা নেই এবং দেহের অবস্থা নথিবদ্ধ করি’।
বিবিসি পর্যালোচনা করেছে, গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের শেয়ার করা বেশি কিছু মরদেহের ছবি। অন্যান্য ছবিগুলো মাঠ পর্যায়ে তুলেছেন বিবিসি সাংবাদিকরা। তারা কথা বলেছেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ, নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার, মানবাধিকার সংস্থা এবং ইসরায়েলের সেনা ও কারা কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও।
তিনজন আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি- যাদের একজন নির্যাতন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ। তারা সবাই একমত পোষণ করেছেন যে, ময়না তদন্ত ছাড়া কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া কঠিন।
নাসের হাসপাতালের ফরেনসিক টিমের সদস্য ডা. আলা আল-আস্তাল বলেন, “অনেক মরদেহে আমরা নির্যাতনের চিহ্ন দেখেছি— যেমন কবজি ও গোড়ালির চারপাশে বাঁধার দাগ, রক্ত জমাট, গভীর ক্ষত’।
তিনি বলেন, ‘কিছু ক্ষেত্রে বাঁধন এত টাইট ছিল যে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, টিস্যু নষ্ট হয়েছিল, আর কবজি ও পায়ের চারপাশে চাপের স্পষ্ট চিহ্ন ছিল। এমনকি চোখের চারপাশেও ফিতা বাঁধা থাকার দাগ দেখা গেছে- ভাবা যায় কতটা শক্তভাবে বাঁধা ছিল!’
কিছু মরদেহের গলায় আলগা কাপড় বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেছে, বলেন আস্তাল। ‘এক দেহে আমরা গলার চারপাশে দাগ দেখেছি। সেটি ফাঁস নাকি শ্বাসরোধে মৃত্যু তা বোঝার জন্য ময়নাতদন্ত করা দরকার ছিল, কিন্তু দেহটি বরফে জমাট থাকায় তা সম্ভব হয়নি’।
হামাস প্রশাসনের অধীনে কাজ করা সরকারি কমিটির সদস্য সামেহ ইয়াসিন হামাদ বলেন, ‘বেশ কিছু দেহে মৃত্যুর আগে বেদম প্রহার, রক্ত জমাট বাঁধা ও অভ্যন্তরীন রক্তক্ষরণের চিহ্ন আছে। কিছু দেহে বুকে ও মুখে ছুরিকাঘাতের চিহ্নও পাওয়া গেছে’।
বিবিসি-র দেখা কিছু ছবিতে দেহের কবজি ও পায়ে গভীর দাগ, কোথাও কোথাও তারের বাঁধনের ছাপ দেখা গেছে। একটি ছবিতে দেখা গেছে, বাঁধনের কারণে ত্বক ছিঁড়ে যাওয়ার মতো ক্ষতচিহ্ন— যা জীবিত অবস্থায় বাঁধা হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অন্য দেহগুলোতে কেবল দাগ ছিল, যা থেকে বোঝা যাচ্ছে মৃত্যুর আগে নাকি পরে এসব বাঁধা হয়েছিল, তা জানতে ময়নাতদন্ত অপরিহার্য। ইসরায়েলে মৃতদেহ পরিবহনের সময় কখনও কখনও ‘ক্যাবল টাই’ ব্যবহৃত হয়।
নির্যাতনের এইসব প্রমাণ সম্পর্কে সাংবাদিকরা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলেছে, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন মেনেই কাজ করে।
বিবিসি ছবিগুলো আন্তর্জাতিক ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদেরও দেখিয়েছে। তারা বলছেন, এসব ছবিতে যেসব চিহ্ন দেখা গেছে, তা উদ্বেগজনক হলেও ময়নাতদন্ত ছাড়া নির্যাতন বা মৃত্যুর ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।
‘গাজায় এখন যা ঘটছে, সেটি এক আন্তর্জাতিক ফরেনসিক জরুরি পরিস্থিতি’- বলেন টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেনসিক প্যাথলজিস্ট প্রফেসর মাইকেল পোলানেন। তার কথায়, ‘এই ছবি থেকে স্পষ্ট যে, পূর্ণাঙ্গ ময়নাতদন্ত জরুরি। মৃত্যুর পেছনের সত্য জানার একমাত্র উপায় হল সঠিক ময়নাতদন্ত’।
তবু সীমিত তথ্য নিয়েই নাসের হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলছেন, পেছনে বাঁধা হাত ও কবজির দাগ নির্যাতনেরই ইঙ্গিত দেয়। যখন কারও দেহ উলঙ্গ অবস্থায় থাকে, হাত বাঁধা থাকে পেছনে, কবজি ও গোড়ালিতে দাগ দেখা যায়- তখন বোঝা যায় সে এই অবস্থাতেই মারা গেছে’- বলেন ডা. ধেইর। তিনি বলেন, ‘এটি স্পষ্টভাবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন’।
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ইসরায়েলি হেফাজতে বেসামরিক মানুষসহ অনেক আটক ব্যক্তির ওপর নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, বিশেষ করে সদে তেইমান নামের সামরিক স্থাপনায়।
ইসরায়েলি এক মানবাধিকার সংস্থার কারাবন্দি বিষয়ক পরিচালক নাজি আব্বাস বলেন, ‘যুদ্ধের প্রথম আট মাস গাজার বন্দিদের হাত-পা ও চোখ বাঁধা অবস্থায় ২৪ ঘণ্টা, সপ্তাহের সাত দিন, মাসের পর মাস রাখা হত। অনেকে হাত ও পায়ে ইনফেকশনে ভুগেছে, ত্বকে ক্ষত তৈরি হয়েছে এই বাঁধনের কারণে।
গত দুই বছরে সদে তেইমান সামরিক স্থাপনায় কাজ করা কয়েকজন কর্মী বিবিসি সাংবাদিকদেরকে বলেছেন, বন্দিদের চিকিৎসা চলার সময়, এমনকি অস্ত্রোপচারের সময়ও হাত-পা বাঁধা থাকত।
সেখানকার একজন চিকিৎসাকর্মী জানান, তিনি নিজে এই বাঁধন ঢিলে করার অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু ‘মানবিকতার অবমাননা’ সেখানে নিত্যদিনের বিষয় হয়ে গিয়েছিল।
যুদ্ধের সময় আটক অনেক ফিলিস্তিনিকেই ‘অবৈধ যোদ্ধা’ হিসেবে ধরে রেখেছে ইসরায়েল- কোনো অভিযোগ বা বিচার ছাড়াই।
এখন গাজার নাসের হাসপাতালের চিকিৎসকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ হল নির্ধারণ করা, ফেরত আসা দেহগুলোর মধ্যে কারা হামাস যোদ্ধা, কারা বেসামরিক নাগরিক, আর কারা ইসরায়েলি হেফাজতে মারা যাওয়া বন্দি।
ইসরায়েলের ফেরত দেওয়া কিছু মরদেহে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠী হামাসের হেডব্যান্ড বা সামরিক বুট আছে, কিন্তু বেশিরভাগ মৃতদেহই এসেছে উলঙ্গ অবস্থায় বা সাধারণ পোশাকে— ফলে সঠিক পরিচয় নির্ধারণ কঠিন হয়ে পড়েছে।
বিবিসি-র দেখা ছবিতে দেখা গেছে, বেশিরভাগ দেহই উলঙ্গ বা পচে গেছে। একটি দেহে বেসামরিক পোশাক পরা অবস্থায় পিঠে দুটি ছোট গুলির ক্ষত দেখা গেছে। গাজার ফরেনসিক কমিটির হামাদ বলেন, ‘ইসরায়েল ১৯৫টি মরদেহ ফেরত পাঠিয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে মাত্র ছয়টি দেহের পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যেও পাঁচটি নাম ভুল’।
ডা. ধেইর বলেন, ‘যেহেতু এসব দেহ ইসরায়েলের হেফাজতে ছিল, তাদের কাছে এদের সব তথ্যই থাকার কথা। কিন্তু তারা রেড ক্রসের মাধ্যমে আমাদের কিছুই দেয়নি। আমরা অর্ধেকের মতো দেহের ডিএনএ প্রোফাইল পেয়েছি, কিন্তু মৃত্যুর সময়, স্থান বা পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো তথ্য পাইনি’।
ফরেনসিক দলের অভিযোগ, কিছু দেহ থেকে ইসরায়েল ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আঙুল বা পায়ের আঙুল কেটে নিয়েছিল। এ বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, ‘যেসব দেহ ফেরত দেওয়া হয়েছে, তারা সবাই গাজার যোদ্ধা’। তারা বাঁধা অবস্থায় দেহ ফেরত দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মুখপাত্র শশ বেদরোশিয়ান বলেছেন, ‘গাজা থেকে আসা এসব প্রতিবেদন ইসরায়েলকে অপমানের আরও এক প্রচেষ্টা। গণমাধ্যমের উচিত ইসরায়েলি জিম্মিদের দুর্ভোগের দিকে মনোযোগ দেওয়া’।
ওদিকে, নিখোঁজদের পরিবারগুলো হাসপাতালে ভিড় জমিয়েছে, প্রিয়জনদের খোঁজে। ডা. ধেইর ও তার সহকর্মীরা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন মৃতদের পরিচয় নির্ধারণ ও তাদের মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনে। এ পর্যন্ত মাত্র ৫০টি মরদেহের পরিচয় নিশ্চিত করা গেছে- বয়স, উচ্চতা ও পুরনো আঘাতের ভিত্তিতে। জায়গার সংকটে অজ্ঞাত ৫৪টি মরদেহ ইতোমধ্যেই কবর দেওয়া হয়েছে।
এ সপ্তাহে অজ্ঞাতপরিচয়দের কবর দেওয়ার সময় সেখানে নিখোঁজদের বহু পরিবারই উপস্থিত থেকেছে- হয়তো তাদের প্রিয়জনকেই সেখানে কবর দেওয়া হচ্ছে সেই আশায়। ‘সত্যি বলতে, কোনো দেহ কবর দেওয়া কঠিন, যখন জানি না সেটা আসলেই আমাদের প্রিয়জন কিনা’- বলেন রামি আল-ফারা, যিনি তার কাজিনের খোঁজ করছেন।
ভাতিজার খোঁজ করা হুয়াইদা হামাদ বলেন, ‘যদি ডিএনএ পরীক্ষা থাকত, অন্তত জানতাম সে কোথায় আছে- হ্যাঁ কি না। আমার বোন জানত, যে দেহটা আমরা কবর দিচ্ছি, সেটা তার ছেলের কি ন’।
ডনাল্ড ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি চুক্তি গাজায় কিছুটা স্বস্তি এনেছে বটে, কিন্তু নিখোঁজদের পরিবারের জন্য তা এখনও স্বস্তি বয়ে আনেনি। তারা এখনও তাদের হারানো ভাই, স্বামী বা সন্তানের দেহের খোঁজ পাচ্ছে না।











