ইসরায়েলি আগ্রাসনের নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে ইরান। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রভাবশালী দেশটির নাম ইরান। একসময় ইরান ও ইরাক দুই প্রভাবশালী রাষ্ট্র পুরো মধ্যপ্রচ্যে গৌরবজনক অধ্যায় রচনা করলেও দেশ দুটির ধর্মীয় আদর্শগত ভাবধারা, তেল ও খনিজ সম্পদ এবং ভূ-রাজনীতির প্রভাবের কারণে ক্রমান্বয়ে দেশ দুটির মধ্যে বিভাজনের রেখা তৈরি হয়। একসময় মদ্যপ্রাচ্যও দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তবে এ বিভক্তির মূলে রয়েছে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ আমেরিকা, যে দেশটি ইহুদীবাদকে সংরক্ষণ করে ইসরায়েলকে ফিলিস্তিন ভূ-খন্ডে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে মরিয়া। ব্রিটিশ উপনিবেশের ছত্রছায়ায় বিংশ শতকের শুরুর দশকে ফিলিস্তিনে ইহুদী বসতি শুরু হয়। এরপর ব্রিটিশ ও আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে একক মুসলিম আধিপত্য ক্ষুণ্ণ করতে সুকৌশলে ইরায়েল নামক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়। সেই থেকে শুরু হয় মধ্যপ্রাচ্যের সংকট, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আর অশান্তির কালো অধ্যায়। ইতিহাসে ফিলিস্তিনের ভূমিতে জোরজবরদস্তির উপর সৃষ্ট ইরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বস্তুত ফিলিস্তিন আর ইরায়েলের সংঘাত যতটুকু না দেশ দুটির এর চেয়ে বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রভাব প্রতিপত্তির। ফলে ইসরায়েল দীর্ঘ ৭ দশক ধরে লাখো ফিলিস্তিনকে হত্যা, নির্যাতন ও নিগৃহীত করে আগ্রাসন অব্যাহত রাখলেও আমেরিকা ইসরায়েলের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছে। সম্প্রতি দুই বছর প্রায় ইসরায়েল ফিরিস্তিনের গাজায় আগ্রাসন চালিয়ে জঘন্য গণহত্যা চালাচ্ছে, যাতে পঞ্চাশ হাজারের অধিক গাজাবাসী হত্যার শিকার হয়েছেন। সারা বিশ্বের মানুষ নিন্দা জানিয়েছেন, সারা বিশ্ব একযুগে ধর্মঘট পালন করেছে, কিন্তু ইরায়ের ও আমেরিকা ছিল নির্লিপ্ত। গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনকে কেন্দ্র করে যুদ্ধের মোড় ইরানের দিকে ফিরতে পারে এমনটি আশঙ্ক করা হয়েছিল। গত শনিবার ইরানে ইসরায়েলের হামলার মাধ্যমে সেই আশঙ্কার সত্যতা প্রমাণ হলো। এরপর ইরানও তার প্রতিশোধের অগ্নিশিখা নিক্ষেপ করল ইসরায়েলকে। বলা হচ্ছে, এতোদিন গাজায় ইসরায়েল একপক্ষিয় যুদ্ধ করলেও এবার কিন্তু শিয়ানে শিয়ানে যুদ্ধ চলছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নেই। এ অবস্থায় শক্তিশালী দেশগুলোও নড়েচড়ে বসল। রাশিয়া, চীনসহ বেশ কয়েকটি মধ্যপাচ্যের দেশ ইরানকে সমর্থন জানিয়ে ইসরায়েলের আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জি-৭ এর সদস্য রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলের পক্ষে সমর্থন জানাল। সুতরাং ইরান-ইসরায়েলে মোড় নেয়া যুদ্ধ সহজে থামবে বলে মনে হয় না। এরপরও বিশ্ববিবেক যুদ্ধের পক্ষে কখনো নয়, যুদ্ধ শুধু মানবতার ক্ষয় করে, জাতিসত্তা ধ্বংস করে। আমরা মনে করি, এ যুদ্ধ যত দ্রæত সম্ভব এখানেই থামানো জরুরি। না হয়, পালটাপালটি হামলায় সংঘাত আরও তীব্র হবে। উপসাগরীয় অঞ্চলে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়াবে।
আমরা উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি, প্রভাবশালী দেশগুলো, জাতিসংঘ, ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি), এমনকি বিশ্বের মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকেও সংঘাত বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের বর্বরোচিত হামলা বন্ধেও এসব সংস্থা ও দেশগুলো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, যা নিন্দনীয়। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে তেল আবিবকে প্রকাশ্যই সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহী রণতরি পাঠিয়েছে। এদিকে ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসাবে পরিচিত চীন ও রাশিয়া জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকে ইসরায়েলের অব্যাহত হামলার নিন্দা জানালেও যুদ্ধ বন্ধে দেশ দুটির কোনো সক্রিয় ভূমিকা এখনো দৃশ্যমান নয়।
কোনোরকম উসকানি ছাড়াই ইসরায়েল গত শুক্রবার রাতের আঁধারে ইরানে হামলা চালায়। এ হামলার টার্গেট ছিল আবাসিক ভবনসহ বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা। হামলায় ইরানের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। বাড়িঘর লক্ষ্য করে হামলা চালানোর ফলে বেসামরিক নাগরিকদেরও প্রাণহানি ঘটে। আক্রান্ত হওয়ার অল্পসময়ের মধ্যেই ইরান প্রতিশোধমূলক পালটা হামলা শুরু করে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র তেলআবিব, হাইফাসহ ইসরায়েলের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানে। এরপর থেকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে পালটাপালটি হামলা অব্যাহত রয়েছে; প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে। আরও উদ্বেগের বিষয়, এ সংঘাত সর্বাত্মক যুদ্ধের দিকে ধাবিত হওয়ায় বিশ্বের আর্থিক বাজার ও বিমান খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উল্লেখ্য, বিশ্বের অধিকাংশ জ্বালানি তেল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য, যেমন প্রাকৃতিক গ্যাস মধ্যপ্রাচ্যের সমুদ্রপথ দিয়ে সরবরাহ করা হয়, যার অন্যতম হলো হরমুজ প্রণালি। এই প্রণালি ইরানকে উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে আলাদা করে এবং আরবসাগরকে ভারতমহাসাগরের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এটি বিশ্বের সমুদ্রপথে তেলের এক-তৃতীয়াংশ সরবরাহের পথ। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের কারণে যদি হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে। তেলের দাম বাড়লে উৎপাদন খরচও বাড়বে, যার পরিণতি শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপর পড়বে। সংঘাত চলতে থাকলে তেল আমদানিকারক দেশগুলোয় উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশের মতো যেসব দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক জনশক্তি কর্মরত, সেসব দেশের অর্থনীতিতে পড়বে ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের অভিঘাত। কাজেই অবিলম্বে এ সংঘাতের অবসান কাম্য। আমরা আশা করি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্রুত এ যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর ক‚টনৈতিক উদ্যোগ নেবে।