পূর্বদেশ ডেস্ক
হামলা, পাল্টা হামলার পর অবশেষে ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে একটি পোস্ট দিয়ে লিখেছেন, ‘যুদ্ধবিরতি এখন কার্যকর। দয়া করে এটি লঙ্ঘন করবেন না!’
ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম প্রেস টিভি জানিয়েছে, গতকাল মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৩০ মিনিটে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। তবে যুদ্ধবিরতির ঠিক আগে শেষবারের মতো ইসরায়েলের অভ্যন্তরে দু’দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। ইসরায়েলি চ্যানেল ১৪ জানিয়েছে, সর্বশেষ ইরানি হামলায় বীরশেবা শহরে এখন পর্যন্ত ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে।
ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সংস্থার মুখপাত্র লিনয় রেশেফ জানিয়েছেন, হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনে এখনো কয়েকজন আটকা পড়ে আছেন। আহত অন্তত ২২ জন, এদের মধ্যে দুজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এরআগে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে তেহরানকে রাজি করাতে মধ্যস্থতা করেছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী। কাতারে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের আল উদেইদ বিমানঘাঁটিতে ইরানের হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টার মাথায় এই আলোচনা এবং সমঝোতার খবরটি প্রকাশিত হয়।
ইরান ও ইসরায়েল একটি ‘পর্যায়ক্রমিক’ যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে বলে জানিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এ সমঝোতা দ্বিপক্ষীয় দ্বন্দ্বের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটাবে। যদিও তেহরানে গতকাল সোমবার রাতভর হামলা চলেছে। ট্রাম্প তাঁর নিজ মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ স্যোশালে লেখেন, ‘ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে পূর্ণ সমঝোতা হয়েছে।’
তবে মধ্যপ্রাচ্যের চির বৈরী দুই প্রতিপক্ষ, ইরান ও ইসরায়েলের কেউ তাৎক্ষণিকভাবে ট্রাম্পের ঘোষণার বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি। প্রায় দুই সপ্তাহ চলা নজিরবিহীন পাল্টাপাল্টি হামলায় ইরানে কয়েকশ’ মানুষ নিহত হয়েছেন, আর ইসরায়েলে প্রাণ গেছে অন্তত ২৪ জনের।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতি প্রক্রিয়া শুরু হবে আজ (মঙ্গলবার) সকাল ১০টায় (বাংলাদেশ সময়) এবং তা ২৪ ঘণ্টায় ধাপে ধাপে কার্যকর করা হবে। প্রথমে ইরান একতরফাভাবে সব সামরিক অভিযান বন্ধ করবে, ১২ ঘণ্টা পর ইসরায়েলও একই পথে হাঁটবে।
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা পূর্ণ হওয়ার পর, বিশ্বের সামনে ১২ দিনের যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি উদ্যাপন করা হবে।’ উভয় দেশ এ সময়কে ‘শান্তিপূর্ণ ও শ্রদ্ধাশীলভাবে’ অতিক্রম করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বলেও জানান তিনি।
ট্রাম্পের ঘোষণার মধ্যেই তেহরানের উত্তরে ও কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ব্যাপক বিস্ফোরণের খবর পাওয়া গেছে। সাংবাদিকেরা জানান, যুদ্ধ শুরুর পর এটি ছিল সবচেয়ে জোরালো হামলাগুলোর অন্যতম।
বিশ্বনেতারা দীর্ঘদিন ধরেই এ সংঘাত বড় ধরনের যুদ্ধের দিকে গড়ানোর আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই যুদ্ধবিরতির খবরটি তাঁদের জন্য স্বস্তির নিশ্বাস হয়ে এসেছে।
ইসরায়েল ১৩ জুন ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় ‘আগাম প্রতিরক্ষামূলক’ হামলা চালায়। এরপরই শুরু হয় পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা। এর জের ধরে ট্রাম্প হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, মধ্যপ্রাচ্যে বড় ধরনের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে হামলা : যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার কয়েক ঘণ্টা আগেই ইরান মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় মার্কিন ঘাঁটি কাতারের আল উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। ট্রাম্প অবশ্য একে ‘খুব দুর্বল’ হামলা বলে উল্লেখ করেছেন।
উত্তেজনা কমানোর আহবান জানিয়ে ট্রাম্প দাবি করেন, ইরান আগেই এ হামলার বিষয়ে জানিয়েছিল এবং এতে কেউ হতাহত হননি।
ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাদের পারমাণবিক স্থাপনায় ‘আক্রমণাত্মক ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ হামলা চালানোর প্রতিক্রিয়ায় কাতারে ওই হামলা চালানো হয়েছে।
তেহরান জানায়, যুক্তরাষ্ট্র যতটি বোমা ফেলেছে, ইরানও ঠিক ততগুলো ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াটি ছিল নিয়ন্ত্রিত ও প্রতিসম।
এ হামলা (যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটিতে) এমন পরিকল্পনামাফিক চালানো হয়েছে, যাতে কোনো মার্কিন হতাহতের ঘটনা না ঘটে এবং উভয় পক্ষের জন্যই (সংঘাত থেকে) সরে আসার পথ খোলা থাকে।
গবেষণা সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ’-এর অন্যতম জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আলি ভায়েজ এএফপিকে বলেন, এ হামলা এমন পরিকল্পনামাফিক চালানো হয়েছে, যাতে কোনো মার্কিন হতাহতের ঘটনা না ঘটে এবং উভয় পক্ষের জন্যই (সংঘাত থেকে) সরে আসার পথ খোলা থাকে।
ইরান মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা এমন এক সময় করল, যখন যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে তেহরানের বিরুদ্ধে হামলায় অংশ নিয়েছে। গত শনিবার গভীর রাতে তারা ইরানের একটি ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র ও আরও দুটি পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার বিধ্বংসী বোমা ফেলে।
ইরান দাবি করেছে, তাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা কাতার নয়; বরং মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করেই চালানো হয়েছে। তবে দোহা সরকার এটিকে ‘স্পষ্ট আগ্রাসন’ বলে আখ্যায়িত করেছে ও পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানোর অধিকার সংরক্ষণের কথা জানিয়েছে।
ইরানি রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, ইসলামী বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে আল উদেইদ ঘাঁটিতে। কাতার জানায়, হামলার আগে ঘাঁটিটি খালি করে ফেলা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানান, হামলায় স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
মার্কিন ঘাঁটিতে হামলার ঘটনায় তেহরানের কেন্দ্রে জনগণ রাস্তায় নেমে আনন্দ উদ্যাপন করেন বলে জানায় রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন। অনেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পতাকা নেড়ে ‘যুক্তরাষ্ট্র নিপাত যাক’ স্লোগান দেন।
এদিকে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় কাতার সাময়িকভাবে তাদের আকাশসীমা বন্ধ ঘোষণা করেছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বিদেশি দূতাবাস তাঁদের নাগরিকদের নিরাপদে আশ্রয়ে থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য, ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত ৪০০ জনের বেশি নিহত হয়েছেন। আর ইরানের হামলায় ইসরায়েলে ২৪ জন নিহত হয়েছেন বলে জানায় তেল আবিব কর্তৃপক্ষ।