ইরানে ইসরায়েলের হামলা, অগ্নিকুন্ড মধ্যপ্রাচ্য

1

আকতার কামাল চৌধুরী

ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তিন দফা সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম প্রথম এ সংলাপ অত্যন্ত আন্তরিক ও সফল বলে উভয়পক্ষ দাবি করলেও চতুর্থ দফা বৈঠকে তা থমকে দাঁড়ায়।
কারণ, যুক্তরাষ্ট্র চায়, ইরান নিজেদের পারমাণবিক প্রকল্প সম্পূর্ণরুপে ত্যাগ করুক। এমনকি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণও করতে পারবে না। এ-নিয়ে চুক্তির একটি খসড়াও মধ্যস্ততাকারী ওমানের মাধ্যমে ইরানের হাতে তুলে দেয়।
কিন্তু ইরান এ-চুক্তি সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে। তাদের বক্তব্য, তারা পারমাণবিক প্রকল্পের আওতায় কোনো পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার নিশ্চয়তা দেবে,তবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া চালু রাখবে। এই পরিশোধিত ইউরেনিয়াম বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বেসামরিক কাজে ব্যবহার করবে। তাঁদের যুক্তি, এরকম প্রকল্প পৃথিবীর অনেক দেশে চালু আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সাফ জবাব, ‘এটা হবার নয়’।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ভেঙে পড়ার পর এধরণের একটি আক্রমণের আশঙ্কা জোরদার হচ্ছিল কয়েকদিন ধরে। বিষয়টা ইরানেরও জানা ছিল।
ইসরায়েল এধরণের হামলার জন্য মুখিয়ে আছে অনেকদিন থেকে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাচ্ছিলেন, একটি চুক্তির অধীনে ইরানকে পারমাণবিক নিরস্ত্রকরণ করতে। তাই ট্রাম্প ইসরায়েলের সাঁড়াশি আক্রমণের ইচ্ছাকে নিরুৎসাহিত করেন।
চুক্তির কঠিন শর্ত না-মানার অভিপ্রায়ে ইরান অটল থাকলে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সবুজ সংকেত পাঠায়।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হয়তো এরকম,- ‘প্রথম দফায় চোখ ধাঁধানো আক্রমণে ইরান বেসামাল হয়ে পড়বে। তখন আরও আক্রমণ থেকে বাঁচতে তারা সুরসুর করে আলোচনার টেবিলে ফিরে আসবে, আর যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া শর্ত মেনে চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হবে’।
এদিকে খুশিতে ডগমগ নেতানিয়াহুও এরকম একটি মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের এমন অভিপ্রায়ে এখন তাঁর পোয়াবারো। গাজা আর গাজার মানুষকে শেষ করে দেওয়া গেল, এখন মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের ‘মূল শত্রু’ নিধনের এ-ই তো সুবর্ণসুযোগ। এ সুযোগ তিনি হাতছাড়া করবেন কোন দুঃখে।তিনি দিগুণ উৎসাহে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিলেন। শেষমেশ যা হবার তা-ই হলো।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, এ হামলায় যুক্তরাষ্ট্র জড়িত নয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এই হামলার বিষয়ে তাঁরা আগে থেকে ওয়াকিবহাল ছিলেন। তিনি আরও একধাপ এগিয়ে এসে বলেন, ইরানের এখন উচিত আলোচনার টেবিলে ফিরে আসা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া।
তাঁদের বক্তব্যেই স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে ও সহযোগিতায় ইসরায়েল এ হামলা করার দুঃসাহস দেখিয়েছে। খবর বেরিয়েছে, এর আগে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত গোপনে ইসরায়েলে তাদের অত্যাধুনিক হেলফায়ার ক্ষেপণাস্ত্রও পাঠিয়েছে। হামলার আগে-আগেই নিরাপত্তা সঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র তার ইরাকি দূতাবাস থেকে অনেক কর্মীকে সরিয়ে ফেলে।
শেষপর্যন্ত যা হওয়ার তা-ই হল।ইসরায়েল ইরানের একাধিক পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। এ-পর্যন্ত ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, পুলিশ প্রধান, নয়জন পরমাণু বিজ্ঞানীসহ ৮০ জনের অধিক নিহত হয়েছে।
জবাবে ইরান ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত উভয়পক্ষে সাঁড়াশি আক্রমণ অব্যাহত আছে।
ইরানের বহুবছরের সাধনা এই পারমাণবিক প্রকল্প। তাদের সুদুরপ্রসারি লক্ষ্য ছিল-এই প্রকল্পের আওতায় একসময় পরমাণু বোমার অধিকারী হয়ে নিজেদের শক্তিমত্তা দিয়ে বিশ্বকে বিশেষকরে ইসরায়েলকে একটা কঠিন বার্তা দিবে।
এ-লক্ষ্যে ইরান পশ্চিমা শক্তির ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা, নানা চোখরাঙানী ও ঘাত-প্রতিঘাতের মোকাবিলা করে এই কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিল। মূলত এটাই ছিল ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের ঘুম কেড়ে নেওয়ার কারণ। তাই এই পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা বলতে গেলে ইরানের অস্তিত্বের উপর-ই আঘাত।
কিন্তু, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ঘিরে তাদের নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরিপূর্ণ কাজে আসেনি। তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইসরায়েলের এ হামলা ঠেকাতে অনেকটা ব্যর্থই বলা যায়।
প্রণিধানযোগ্য যে, ইসরায়েল ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী ও শীর্ষস্থানীয় কমান্ডারদের হত্যা করেছে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা ‘মোসাদের, স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে।
এখন প্রশ্ন, এ হামলার পর ইরান কী করতে পারে? তারা কি পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আলোচনার টেবিলে ফিরে যাবে?
এরইমাঝে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনী হুঙ্কার দিয়েছেন, ‘তারা এর কঠিন জবাব দেবে’ এবং বলেই দিয়েছেন, ‘এ হামলার পর আলোচনা নিরর্থক’। অর্থাৎ, ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা ভেঙ্গেই গেল।
মধ্যপ্রাচ্যের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে- ইরান মুলত তেমন কিছুই করতে পারবে না। বড়োজোর ইসরায়েলের ভূখন্ডে কয়েকদফা ক্ষেপণাস্ত্র আর ড্রোন ছুঁড়তে পারবে। প্রশ্ন হলো, ইরানের পক্ষে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করা কতটুকু সম্ভব? অভিজ্ঞতা বলে,ইরান হামলা শুরু করার সাথেসাথেই যুক্তরাষ্ট্র তার অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ইসরায়েলের পাশে দাঁড়াবে। বিশ্ব এমন চিত্র আগেও দেখেছে। ইরানের সেনাপ্রধান কাসেম সোলাইমানীকে দামেস্কে হত্যার পর ইরান প্রতিশোধ নিতে মরিয়া ছিল। এমনকি ইসরায়েলে শ’দুয়েক ক্ষেপণাস্ত্র ড্রোনও ছুঁড়ে। দেখা যায়,এ আক্রমণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে গাঁটছড়া বাঁধে। ফলাফল যা হবার তা-ই হয়েছে। দু’চারটে স্থানে আঘাত হানতে সক্ষম হলেও ইরানের প্রায় সবগুলো ক্ষেপণাস্ত্র-ড্রোন আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়।
এবারও কি এরচেয়ে ব্যতিক্রম কিছু ঘটতে পারে? মনে হয়,‘না’।
ইরান যেভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে তাতে কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েলের বিভিন্ন বেসামরিক স্থানে আঘাত হেনে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারলেও ইসরায়েলের মত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হচ্ছে না।
তাহলে কি ইরান আলোচনার টেবিলে ফিরে আসবে? সেটাও প্রায় অসম্ভব। কারণ, আলোচনার টেবিলে ফিরতে হলে ইরানকে পুরো পারমাণবিক প্রকল্প বাদ দেওয়ায় মতো কঠিন শর্ত মানতে হবে। অথচ ইরানের পক্ষে তা অসম্ভব-ই। কারণ, ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প তাদের জন্য যত-না নিরাপত্তার তারচেয়েও বেশি আত্ম-মর্যাদার।
লেখক : প্রাবন্ধিক