এম এ হোসাইন
পবিত্র রমজান মাসে ইফতারির সময় ভাজাপোড়া ও বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের চাহিদা বেড়ে যায়। তবে এ সময় বাজারে ভেজাল ও নকল পণ্যের ছড়াছড়ি চোখে পড়ার মতো। ভেজাল তেল, মসলা, শরবত, দুধ, ঘি এবং নিম্নমানের ভাজাপোড়া খাবারের কারণে রোজাদারদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব পণ্য গ্রহণের ফলে পেটের পীড়া, বদহজম, অ্যাসিডিটি, ফুড পয়জনিং, এমনকি দীর্ঘমেয়াদি লিভার ও কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে।
রমজানের আগে থেকেই অসাধু ব্যবসায়ীরা ভেজাল পণ্য বিক্রির প্রস্তুতি নেন। বিশেষ করে ইফতারির সময় বিক্রি হওয়া চপ, পেঁয়াজু, বেগুনি, ডাল, ছোলা, জিলাপি এবং বিভিন্ন ধরনের শরবতে ভেজালের মিশ্রণ থাকে। অনেক ক্ষেত্রে পচা বা নিম্নমানের তেলে ভাজা খাবার বিক্রি করা হয়। এছাড়া মসলা, দুধ, ঘি, সরবত এবং জুসে ভেজাল মেশানো হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. সুশান্ত বড়ুয়া বলেন, ভেজাল তেল ও নি¤œমানের উপকরণে তৈরি ভাজাপোড়া খাবার স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব খাবার খেলে গ্যাস্ট্রিক, আলসার এবং লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে। রোজাদারদের উচিত তাজা ও স্বাস্থ্যকর খাবার বেছে নেওয়া। বাড়িতে তৈরি খাবার সবচেয়ে নিরাপদ।
বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটির (বিএফএসএ) তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর রমজান মাসে ভেজাল পণ্য বিক্রির অভিযোগ বেড়ে যায়। বিএফএসএ’র পরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, আমরা বাজার মনিটরিং জোরদার করেছি। ইতিমধ্যে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ভেজাল পণ্য বিক্রির অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে জনসচেতনতাও জরুরি। ভোক্তাদের উচিত লাইসেন্সপ্রাপ্ত দোকান থেকে পণ্য কেনা এবং পণ্যের মেয়াদ ও গুণগত মান যাচাই করা।
ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার : ইফতারি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড ও সোডিয়াম সাইক্লামেট। জিলাপিসহ বিভিন্ন ইফতারি আইটেমে এসব রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। যা মানবদেহের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক রং ব্যবহার করা হচ্ছে ইফতারি পণ্যে। শুধুমাত্র বেশি সুস্বাদু ও আকর্ষণীয় দেখানোর জন্য এসব কৃত্রিম রং ও রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। পক্ষান্তরে পুরো ইফতারি অনিরাপদ হয়ে উঠছে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, ভেজালের দৌরাত্ম থেমে নেই। পবিত্র রমজানে ইফতার সামগ্রীও ভেজালমুক্ত নয়। ক্ষতিকর পদার্থ মিশিয়ে খাদ্যকে বিষাক্ত করে তোলা হচ্ছে। খাদ্যে ভেজাল এমন একটি নীরব ঘাতক, যা ধীরে ধীরে সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করে তোলে। প্রশাসনের নজরদারি আরও জোরদার করার মাধ্যমে এই ভেজাল থেকে আমাদের বের হতে হবে।
ইফতারি পণ্যে ভেজালের ধরন : ইফতারি পণ্যের ভেজাল অনেকে জেনে আবার অনেকে না জেনেই করছেন। ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানগুলো ব্যবহারের মাত্রা না বুঝেই করা হচ্ছে ব্যবহার। ইফতারসামগ্রী আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল রং। ফুটপাতসহ বিভিন্ন খাবারের দোকানে ময়দার সঙ্গে কেমিক্যাল রং মিশিয়ে, পোড়া তেলে ভেজে তৈরি করা হচ্ছে ইফতারি। বেগুনি, পেঁয়াজু, ডালের বড়া, নিমকি, আলুর চপসহ অনেক ধরনের ইফতারসামগ্রী আকর্ষণীয় করতে ব্যবহৃত হচ্ছে কেমিক্যাল রং। জিলাপি দীর্ঘ সময় মচমচে রাখতে ব্যবহার করা হচ্ছে পোড়া মবিল। মুড়ি সাদা করতে ব্যবহার হচ্ছে বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রোসালফাইড। বুন্দিয়া, জিলাপিসহ মিষ্টান্নজাতীয় খাবার তৈরিতে ব্যবহার হচ্ছে ভেজাল চিনি। এর রাসায়নিক নাম সোডিয়াম সাইক্লামেট। খাবারকে অধিকতর মিষ্টি করতে ব্যবহৃত হচ্ছে স্যাকারিন, সুকরালেস ইত্যাদি। আবার বাসি ইফতারি মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে নতুন তৈরি করা ইফতারির সঙ্গে। এসব সামগ্রী দেদার বিক্রিও হচ্ছে।
রেস্তোরাঁ ও ফুটপাতের ইফতারির অবস্থা : রেস্তোরাঁ ছাড়াও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা রাস্তার মোড়ে, অলিগলিতে ইফতারির পসরা সাজিয়ে বিক্রি করছেন। ছোলা, বেগুনি, পেঁয়াজু, ডালের বড়া, নিমকি, বুন্দিয়া, আলুর চপ থেকে শুরু করে মুরগির সুতি কাবাব, হালিম, লাচ্ছি, দইসহ বহু রকমের ইফতারি বিক্রি হচ্ছে। এসব ইফতারির প্রায় সবই কোন না কোন রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। দেখতে সুন্দর দেখালেও বাস্তবে এর মধ্যে আছে ভেজাল। আর এই ভেজালের কারণে ধীরে ধীরে মানুষ অসুস্থ হচ্ছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) ফুড সেইফটি প্রোগ্রামের সিনিয়র ন্যাশনাল অ্যাডভাইজার ডা. শাহ মুনীর হোসেন বলেন, অনেক সময় সঠিক ধারণার অভাবে ভালো খাবারও আমরা নষ্ট করে খাই। হোটেল ব্যবসায়ীরা শুধুমাত্র সঠিক জ্ঞানের অভাবে অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিবেশন করে। তাই এসব বিষয়ে সবার সজাগ হওয়া প্রয়োজন। কেবলমাত্র পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নিচে এবং ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রায় খাবার নিরাপদ থাকে। কিন্তু হোটেলের খাবারগুলো সাধারণত এই তাপমাত্রায় থাকেনা, যা সম্পূর্ণ অনিরাপদ।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ : জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, ফাস্ট ফুড শপ বা রেস্তোরাঁর ফ্রায়েড চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও চিনিযুক্ত পানীয়তে উচ্চমাত্রায় লবণ ও ক্ষতিকর এসিড থাকে। যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। তাই ইফতারিতে এসব খাবারসহ ছোলা, পেঁয়াজু, বেগুনি, পাকোরার মতো ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। সহজে হজম হয় এমন খাদ্য খেতে হবে। এক্ষেত্রে খিচুড়ি, চিড়া, ভাত, শরবত, খেজুর, ফলমূল জাতীয় খাদ্য উপাদান খেতে হবে।