ইফতারিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ‘মেজবানি মাংস’

2

মনিরুল ইসলাম মুন্না

সারাদিনের ক্লান্তি কেটে যখন ইফতারের সময় হয়, তখন রোজাদারদের মনে যেন জান্নাতের এক তৃপ্তি নেমে আসে। সে তৃপ্তিতে যদি খাবার হয় মুখরোচক, তাহলে আর কাথায় নেই। এখন ইফতারের সাথে যোগ হচ্ছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানি মাংস। তাই নগরীর বেশ কয়েকটি হোটেল এখন ইফতারি আইটেমের পাশাপাশি রাখছেন মেজবানি মাংস। গত কয়েকদিন ধরে নগরীর কয়েকটি হোটেল এবং রেস্তোরাঁয় মেজবানি মাংস রাখার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
এদিকে স্থানীয়রা ছাড়াও অন্যান্য জেলার অতিথিদের কাছে খুবই পছন্দ চট্টগ্রামের মেজবানি। মাংসের সঙ্গে চনার ডাল ও নলার ঝোল ভোজন রসিকদের ভীষণ পছন্দ। চাহিদা থাকায় দিন দিন বাড়ছে হোটেল-রেস্তোরাঁয় মেজবানি বিক্রি।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের ঐতিহ্য এই মেজবান। গরু জবাই করে সমাজের সব শ্রেণির মানুষকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানোর রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। ধনী-গরিব এক কাতারে বসে খাওয়া হয়। পরিবেশন হয় মাংস, হাড় দিয়ে চনার ডাল, নলা ঝোল। মুখরোচক খাবারে সবাই তৃপ্ত হন। এখন আর সেই মেজবান সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন চলে এসেছে হোটেল-রেস্তোরাঁয়। আস্ত গরু জবাই করে মেজবানি রান্না করে মাংস বিক্রি করা হয়। মানভেদে ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা পড়ে এক-একজনের। হোটেলে বসে খাওয়া যায় মেজবান। এছাড়া কেজি ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকায় পাওয়া যায় মেজবানের মাংস। এখন ইফতারিতে বিক্রি হচ্ছে এ মেজবানি।
জানা গেছে, হোটেল জামান মেজবানকে সাধারণ মানুষের বা ভোজন রসিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। তারা হোটেলে মেজবানির খাবার বিক্রির রেওয়াজ চালু করেছিল। এখন সেটি বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রাহকরাও স্বাদ নিতে পারছেন হাতের নাগালে। গত ২০০০ সালের দিকে চট্টগ্রামের প্রথম হোটেলে মেজবানের আয়োজন করে হোটেল জামান। নগরের কোর্ট বিল্ডিং শাখায় তারা মেজবানি বিক্রি করত মাত্র ১০০ টাকায় প্রতিজন। এতে থাকত একজনের পরিমাণ মাংস, ছোলার ডাল ও নলার ঝোল। বর্তমানে মুরাদপুরের হোটেল জামান শাখা ও বায়েজিদ শাখায় মেজবানি চালু আছে। বিক্রি করা হয় প্রতি কেজি ১ হাজার ২০০ টাকায়, প্রতিজনে পড়ে ৩৫০ টাকা। সম্প্রতি চট্টগ্রামের আরও বেশ কিছু রেস্তোরাঁয় চালু হয়েছে মেজবানি বিক্রি। এর মধ্যে মেজ্জান হাইলে আইয়্যুন, কুটুমবাড়ি, মেজবানবাড়ি, নগরের ২নং ষোলশহরে ক্যাফে আলী, চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম মার্কেটে রোদেলা বিকেল, ক্যাফে আল মক্কা অন্যতম।
নগরীর পাঁচ তারকা হোটেল র‌্যাডিসন ব্লু ও দ্যা পেনিনসুলাতেও বিক্রি হচ্ছে মেজবানি। এছাড়া মহানগরের চকবাজার, কাজীর দেউড়ি, মুরাদপুর, জিইসি, বহদ্দারহাট, নিউ মার্কেট, আগ্রবাদ, অক্সিজেনসহ বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁয় বিক্রি হচ্ছে মেজবানি।
হোটেল জামানের মালিক মোহাম্মদ কায়সার জামান বলেন, ‘হোটেল জামান চট্টগ্রামের ঐতিহ্য মেজবানকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে এসেছিল। মেজবান সবার পছন্দ। বিশেষ করে ঢাকা থেকে যারা চট্টগ্রামে বেড়াতে আসতেন, তারা মেজবান খুঁজতেন। তাই আমার বাবা মোহাম্মদ জামান চট্টগ্রামের কোর্ট বিল্ডিং হোটেল জামান শাখায় মেজবানের আয়োজন করতেন প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার। এ দুইদিন দূর-দূরান্ত থেকে এসে মেজবান খেতেন গ্রাহকরা। এ শাখা সম্প্রতি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে আমাদের অন্য শাখায় মেজবান চালু আছে।’
তিনি বলেন, মেজবান এখন সর্বত্রই বিক্রি হচ্ছে। তবে অনেক হোটেল বাজার থেকে মাংস সংগ্রহ করে মেজবান হিসেবে বিক্রি করছে। এতে মেজবানের মান কমে যাচ্ছে। মেজবান করতে হলে আস্ত গরু জবাই করতে হবে। সেটি রক্ষা করে হোটেল জামান।
জামাল খানের মেজ্জান হাইলে আইয়্যুনের মালিক মনজুরুল হক বলেন, ‘বিভিন্ন এলাকা থেকে মেজবানের স্বাদ নিতে অনেক মানুষ আসেন। আমরা ১ হাজার ২০০ টাকায় মেজবানের মাংস বিক্রি করছি। আমাদের ৫টি শাখা রয়েছে চট্টগ্রামে। সব শাখাতেই উল্লেখযোগ্য হারে বিক্রি হচ্ছে মেজবানি। মেজবানিকে ইফতারের আইটেম হিসেবে চালু করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। যদিও ইফতার হিসেবে বেচা-বিক্রি তেমন বেশি না, তবুও কিছু বিশেষ গ্রাহক হয়েছেন। তারা কিনছেন এই মেজবানি।’
নগরীর অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁ সবখানেই নানা স্বাদের ও রকমারি ইফতারিতে ভরপুর দোকানগুলো। মুরগি, গরু, খাসির মাংসে তৈরি বিভিন্ন ইফতারি পসরায় চোখ ক্রেতাদের। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে হালিম, মেজবানি মাংস ও বিরিয়ানি।
দুপুর থেকেই হোটেল-রেস্তোরাঁয় পসরা সাজানো হচ্ছে ইফতারির। নামিদামি প্রত্যেক রেস্তোরাঁয় ৩০ থেকে ৪০ আইটেমের ইফতারসামগ্রী বিক্রি করা হচ্ছে। মুখরোচক ইফতারি খাবার পদে পদে সাজিয়ে পরিপ‚র্ণ করা হয় শোকেজ। বিকেল গড়াতেই শুরু হয় বেচাকেনা।
হোটেল জামান মুরাদপুর শাখার স্বত্বাধিকারী গোলাম কিবরিয়া বলেন, ‘চট্টগ্রামের প্রাচীন রেস্তোরাঁ হোটেল জামান মুরাদপুরে মেজবানি মাংস, সব ধরনের হালিম, সব রকম বিরিয়ানি, চিকেন কাবাবসহ ১০৩টি আইটেম রয়েছে ইফতারিতে। ১ হাজার ২০০ টাকায় মেজবানের মাংস বিক্রি করছি আমরা। মেজবানির জন্য সপ্তাহে দুটি বড় গরু জবাই দিই আমরা। ফলে স্বাদে গুণে মানে আমাদের মেজবানি চট্টগ্রামের শীর্ষে।’
নগরীর স্টেডিয়াম পাড়ায় ‘রোদেলা বিকেল’ মেজবানের গরুর মাংস বিক্রি করছে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজিতে। ঝোলবিহীন এ মেজবানির মাংস স্বাদে মানে অনন্য।
এ রেস্তোরাঁর ম্যানেজার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন বলেন, এবার প্রায় ৪০ আইটেম নিয়ে ইফতার বাজারের মেজবানির মাংসও একটি। রোজার প্রথম দিন প্রায় একমণের উপরে মাংস বিক্রি হয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদুল হান্নান বাবু বলেন, মেজবান চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। মেজবানি হোটেলে বিক্রি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি অবশ্য গ্রাহকদের জন্য সুখবর। কিন্তু অনেকে মান ঠিক রাখতে পারবে না। চট্টগ্রামের মানসম্পন্ন রেস্তোরাঁগুলোতে গুণেমানে অনন্য খাবার প্রস্তুত করেন বিক্রি জন্য। গ্রাহকরা যেন রাস্তার পাশের খাবার না খায় এ অনুরোধ করবো। কারণ মানহীন রেস্তোরাঁ বা ফুটপাতের খাবারে স্বাস্থ্য খারাপ হয়। ইফতারসামগ্রী বেশি দামে বিক্রির সুয়োগ নেই। সব নিত্যপণ্যের দাম এবার বেশি। রেস্তোরাঁয় ব্যবহার হওয়া সব ধরনের পণ্যের দাম অনেক হওয়ার ফলে সীমিত লাভে বিক্রি করতে হচ্ছে।