জুলাই বিপ্লবকে কেন্দ্র করে পুলিশ-জনতার মধ্যে বড় ধরণের সংকট তেরি হয়েছে। যদিও এ দায় পুলিশের একক নয়, এর দায় যখন যে সরকার আসে তাদেরও নিতে হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সরকারগুলো প্রতিপক্ষকে দমাতে পুলিশ এবং সহযোগি বাহিনীগুলোকে যথেচ্ছ ব্যবহার করেছে, এর প্রমাণ নিকট অতীতে অহরহ রয়েছে। বিগত আওয়ামীলীগ সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবকালে ছাত্রজনতাকে নির্মমভবে দমন করার চেষ্টার অভিযোগ রয়েছে। আর এ অভিযোগের অগ্রভাগে ছিল পুলিশ। এর জন্য সরকারকে চরম খেসারত দিতে হয়েছে, তবে পুলিশ বাহিনীও রক্ষ পায় নি। বিপ্লব পরবর্তী প্রথম ঝড়তুফান যায় বলি, পুলিশের উপরই গিয়েছে, মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে থানা, পাড়িতে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। এ উদ্যোগের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, পুলিশসহ র্যাব ও আনসার বাহিনীর ইউনিফর্ম পরিবর্তনের। ইতোমধ্যে ইউনিফর্মের ডিজাইন, কালারসহ আনুষাঙ্গিক বিষয়সমূহ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। মূলত, পোশাকের কালার ও ধরণ দেখে সচেতন মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞদেরও এ আলোচনার টেবিলে উত্তাপ ছড়াতে দেখা যাচ্ছে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে বাহিনীর কার্যকারিতা এবং জনসেবার মান বাড়াতে কেবল পোশাক পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, দরকার প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ এবং নৈতিকতার উন্নয়ন। জনগণের প্রতি দায়িত্বশীল এবং মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়তে হলে শুদ্ধাচারের কোনো বিকল্প নেই। পোশাক নয়, বরং বাহিনীর ভেতরের চরিত্র এবং কাঠামোর উন্নয়নেই হতে পারে প্রকৃত পরিবর্তনের চাবিকাঠিশুদ্ধাচারি করার উদ্যোগ নেয়া। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে একজন কলামিস্ট পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের লিখতে গিয়ে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। লেকখের বক্তব্যগুলো এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে সা¤প্রতিক সময়ের গরম গরম আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে নানা প্রশ্ন, বিতর্ক ও মতামত। তবে এই বিতর্কের মূলে রয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ সত্য-পোশাকের পরিবর্তন কোনো বাহিনীর কর্মক্ষমতা বা জনসেবার মানে সরাসরি পরিবর্তন আনে না। বরং বাহিনীর শুদ্ধাচার, মনোভাব এবং কার্যকর সংস্কারই পারে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে।
উল্লেখ্য যে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকের পরিবর্তনের বিষযটি মোটেই নতুন নয়, এর একটি বিবর্তনিক ইিিতহাস রয়েছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সময় পুলিশ সদস্যদের জন্য খাকি রঙের পোশাক নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই রঙ নির্বাচন করা হয় সহজলভ্য রঞ্জক পদার্থ দিয়ে পোশাকের ময়লা ঢাকার সুবিধার্থে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালি পুলিশ সদস্যরাও এই খাকি পোশাক ব্যবহার করতেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের পোশাকের পরিবর্তন আনা হয়েছে। ২০০৪ সালে মহানগরের জন্য জলপাই রঙ এবং জেলা পুলিশের জন্য গাঢ় নীল রঙের পোশাক প্রবর্তন করা হয়। তবে এসব পরিবর্তন কেবল বাহ্যিক ছিল। পুলিশের নৈতিক আদর্শের কার্যকর কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। পুলিশ সব সময় সরকারি দলের দোসর এবং সাধারণ নাগরিকের জন্য খলনায়কের খোলসে আবৃত থাকলেও সময়ের পরিবর্তনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পুলিশের অভ্যন্তরীণ সংস্কার নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল। এমন প্রেক্ষাপটে পোশাক পরিবর্তনের দাবি ওঠে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পুলিশের নতুন পোশাক হবে ‘আয়রন’ রঙের। র্যাবের পোশাক হবে ‘অলিভ’ এবং আনসারের পোশাক হবে ‘গোল্ডেন হুইট’। এই পরিবর্তনের পেছনে বাহিনীর কর্মক্ষমতা বাড়ানোর থেকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বাহ্যিক চেহারার পরিবর্তনে। এই পরিবর্তন কী পারবে পুলিশকে তাদের নৈতিক স্খলন থেকে ফেরাতে? তাদের যে জব ডেসক্রিপশন, সেই অনুযায়ী তাদের পরিভ্রান্তভাবে গড়ে ওঠা মানসিকাতা থেকে ফিরিয়ে মূল শুদ্ধাচার নীতিতে তারা কী সত্যিই ফিরবে জনগণের বন্ধু হয়ে? অনেকে মনে করেন, পোশাক পরিবর্তন বাহিনীর কার্যকারিতা বা জনসেবায় কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারবে না। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা একে কসমেটিক পরিবর্তন হিসেবে অভিহিত করেছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক শেখ আদনান ফাহাদ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পোশাক পরিবর্তনের পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু পোশাক পরিবর্তন করে দায়িত্ব পালনের মান উন্নত করা যাবে না। ‘পোশাক পরিবর্তনে অর্থ বিনিয়োগের বদলে প্রশিক্ষণ ও কাঠামোগত উন্নয়নে জোর দেওয়া প্রয়োজন ছিল। বাহিনীর কর্মক্ষমতা বাড়াতে প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশের ভেতরে দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং মানবিক পুলিশিং নিশ্চিত করতে বিশেষ অভ্যন্তরীণ ইউনিট গঠন করা দরকার। প্রশিক্ষণ এবং মনোভাব পরিবর্তনের মাধ্যমে পুলিশ সদস্যদের জনসেবার মানসিকতা তৈরি করা প্রয়োজন। পোশাক পরিবর্তনের মাধ্যমে বাহিনীর একটি নতুন পরিচয় তৈরি হলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে সন্দেহ থেকে যাবে। আমরা মনে করি, পোশাক নয়, পুলিশ বাহিনীকে নৈতিক ও শুদ্ধাচারি করে তোলার যথাযথ উদ্যোগ এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়েজন।