বাসুদেব খাস্তগীর
বাংলা নববর্ষ যেমনি আমাদের নানাভাবে আনন্দ দেয়, ইংরেজি নববর্ষও এখন আনন্দ বা খুশির অনুষঙ্গ হয়ে উঠছে ক্রমাগত। বাংলা নববর্ষের যেমন একটি ইতিহাস আছে, ইংরেজি নববর্ষেরও নানা ইতিহাস লোক মুখে প্রচলিত আছে। ইংরেজি নববর্ষের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রথম রোমান ক্যালেন্ডারটি ছিলো চন্দ্রকেন্দ্রিক এবং এতে মাস ছিলো দশটি। এই ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছরের প্রথম মাসটি ছিলো মার্চ। তাই তখন মার্চের ১ তারিখকে বছর শুরুর দিন হিসেবে উদযাপন করা হতো। ৭০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রোমের রাজা নুমা পম্পিলিয়াস এই ক্যালেন্ডারে নতুন দুটি মাস যুক্ত করেন জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারি। এরপর বছরের প্রথম মাস মার্চ হতে জানুয়ারিতে পরিবর্তন করা হয় বলে অনুমান করা হয়। তবে জানুয়ারির ১ তারিখকে নববর্ষ হিসেবে চালু করতে বেশ সময় লাগে। এটি প্রথম চালু হয় ১৫৩ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রোমে। তখন এটি অনিয়মিতভাবে পালিত হতো। কারণ তখনো বিভিন্ন স্থানে জনগণ মার্চের ১ তারিখকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে ব্যবহার করতো। কিন্তু ৪৬ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার যখন সূর্যকেন্দ্রিক ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ চালু করেন, তখন জানুয়ারির ১ তারিখকেই নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মূলত তখন থেকেই এই রীতি ছড়িয়ে পড়ে বলে ধারণা করা হয়। তবে আরো নানা ধরনের কথাও প্রচলিত আছে। এগুলো যেহেতু অনেক পুরানো প্রাগঐতিহাসিক ঘটনা সেখানে অনেক মতবাদ থাকতেই পারে। অনেক মতবাদের গ্রহণযোগ্যতা কম, আবার অনেক মতবাদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। এভাবেই লোকমুখে প্রচলিত অনেক মতবাদ সর্বজনীন হয়ে উঠলেই সমাজে সেটা ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করে। তবে অনেক মতবাদের গ্রহণযোগ্যতার শক্তিশালী ভিত্তিও রয়েছে। তবে প্রচলিত কোনো মতবাদকে অস্বীকার কোনো উপায় নেই। যাহোক ইংরেজি ২০২৪ সাল বিদায় নিয়ে ২০২৫ সাল আমাদের সামনে উপস্থিত। নানা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির যোগ বিয়োগে ২০২৪ সাল আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত জীবনের জন্য অনেক প্রাপ্তির, আবার হারানোর কষ্টেও ভরপুর। নানা সমস্যার মধ্য দিয়েই আমাদের পথ চলা।
চাহিদার তুলনায় সীমিত সম্পদের এ দেশে নানা সমস্যা আমাদের প্রতিনিয়তই সামনে এসে দাঁড়ায়। মানুষতো সামাজিক জীবন। সমাজে চলমান নানা সমস্যা থেকে কেউ আমরা দূরে নই। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আমরা সবাই সমাজের নানা ইতিবাচক বা নেতিবাচক ঘটনার কম-বেশি অংশীদার। তবুও আমরা আশায় বুক বাঁধি। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বেঁচে থাকার জন্য আমাদের নিরন্তর সংগ্রাম। এরই নাম জীবন। ব্যর্থতার গ্লানি ঝরে পড়ে সাফল্যের স্বর্ণালি সুখ আমাদের হাতের মুঠোয় আবার ধরা দেবে এ প্রত্যাশা আমাদের মনে প্রতিনিয়তই আলোড়িত করে। জীবনের নানা সংকটকে অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যাবার শপথে আসে নতুন বছর। নানান প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের এগিয়ে যাওয়া। এই এগিয়ে যাবার মধ্যেই আছে নানা সমস্যা। মানুষ জীবনটা হলো নানা প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার হিসাব নিকেশ। একটি বছরে মানুষ তার অবচেতন মনে একটু করে হলেও মনে মনে সে হিসাব নিকেশে মেতে ওঠে। কারো হিসেব মিলে না, কারো হয়তো মেলে, আবার কারো হয়তো মিল-অমিলের ভারসাম্যে এক ধরনের দোলাচলে দোলে। জীবনটাতো সমস্যায় ঘেরা চলমান একটি চাকা। সেখানে আনন্দ আছে, বেদনা আছে, প্রাপ্তি আছে, অপ্রাপ্তিও আছে। আবার নতুন বছরের প্রত্যাশা আছে। বছর শেষে আবার সে প্রত্যাশার হিসাব নিকেশ আছে। এভাবেই তো জীবন এগিয়ে যায়। নানা প্রতিক‚লতাকে অতিক্রম করেই তো আমাদের এগিয়ে যেতে হয়। বছরের শুরুতেই প্রত্যাশা সুন্দর আগামীর লক্ষ্যে শুরু হোক নতুন বছর। সত্যিকার অর্থে এ সমাজে শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্বরাই সমাজের বন্ধু, দার্শনিক, পথ প্রদর্শক ও সমাজের দর্পণ হিসেবে চিহ্নিত। সে হিসাবে আমাদেরও অনেকগুলো দায়িত্ব রয়েছে। সত্যিকার অর্থে সমাজ পরিবর্তনে আমাদের শিক্ষিত সুশীল সমাজকে কার্যকর অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে হবে, সমাজের চাহিদার সাথে তার সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। সমাজের কুসংস্কার, কূপমন্ড‚কতা ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে লেখককে সৎ ও সাহসী ভ‚মিকা নিতে হবে। বৃহত্তর সমাজের মৌলিক অনেক আশা-আকাঙ্খার সাথে ঐক্য সৃষ্টি করতে হবে। এ দেশ আমাদের সকলের। দেশপ্রেমের অনুভূতি অনেক বড় একটি বিষয়। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হওয়া খুবই জরুরি।
নতুন বছরে আমাদের সকলের বলিষ্ট ভূমিকা দেশকে অগ্রগতির পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে নেবে, এ প্রত্যাশা সকলেরই থাকা উচিত। সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্যতম হাতিয়ার। দেশে এখন প্রচাররত প্রচুর সংবাদপত্র আছে। অনেক ইলেকট্রনিক মিডিয়াও আছে। সংবাদপত্র ও বিভিন্ন মিডিয়ার স্বাধীনতা থাকা অতীব প্রয়োজন। একটি সংবাদপত্রে প্রত্যেকের ভালো দিক তুলে ধরার অধিকার যেমনি আছে, তেমনি মন্দ দিকগুলোও তুলে ধরার অধিকার আছে। রাষ্ট্রের বা সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ভালো মন্দের খবর নিয়ন্ত্রহীনভাবে প্রকাশ সমাজের জন্য ইতিবাচক। তবে তা হতে হবে অবশ্যই রাষ্ট্রের স্বার্থের পক্ষে এবং সংবাদপত্র ও মিডিয়ার নীতিমালার ভিত্তিতে। যদি প্রচার মাধ্যম যথাযথ ভ‚মিকা পালন করতে না পারে সেখানে অগ্রগতি পিছিয়ে যায়। সংবাদপত্র বা যে কোনো মিডিয়া যেন সকলের বন্ধু হতে পারে, কোনো ভাবেই প্রতিপক্ষ নয়- সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। মানুষের সবকিছু জানার অধিকার আছে। অধিকার আছে বলেই সংবাদপত্রসহ নানা মিডিয়া সব ভালোমন্দ, অপকর্ম দুর্নীতি ইত্যাদি প্রকাশ করে গণতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোয় দেশের নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করে। মিডিয়া যদি অফিস আদালতের দুর্নীতি, সমাজবিরোধী দলের সন্ত্রাস, প্রভাবশালীদের কারসাজি, ভন্ডামি, কুসংস্কার ও কূপমন্ড‚কতা ইত্যাদি সম্পর্কে ছাপার অধিকার বা বলার অধিকার না পায়, তাহলে মিডিয়া তার যথার্থ দায়িত্ব পালনে শুধু ব্যর্থই নয়, গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যথার্থ কোনো অবদানই রাখতে পারে না। এ দেশে বিভিন্ন সময় মানুষ নির্যাতিত হয়। সে নির্যাতনের নানা রকমভেদও আছে। কিছু বিষয় সময়ে সময়ে সামনে উঠে আসে। এ রকম নির্যাতিত মানুষকে সামনে আনার মত সৎ সাহস চাই মিডিয়ার। এক্ষেত্রে সংবাদপত্র হচ্ছে সমাজের দর্পণ। এ দর্পণের মাধ্যমে সত্যকে উদ্ভাসিত করার সাহস থাকা দরকার। নতুন বছরের ঊষালগ্নে আমরা কামনা করি একটি সুন্দর আগামীর। প্রকৃতপক্ষে ৩১ ডিসেম্বর আর ১ জানুয়ারির মধ্যে দিনগত চরিত্রের কোনো পার্থক্য নেই। অন্যসব সব দিনের মত স্বাভাবিক দুটো দিন। তবুও মানুষ অবচেতন মনে দিন দুটোর মধ্যে পার্থক্যের বিভাজন রেখা তৈরি করে। সে বিভাজন প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির। সেটা অতি স্বাভাবিক একটি বিষয়। নতুনের কাছে থাকে সুন্দরের আবাহন আর সুন্দর জীবন যাপনের প্রত্যাশা।
পুরাতনের কাছে হিসাব-নিকাশ। সুন্দরের প্রত্যাশায় আমাদের চাওয়া সুন্দর একটি বর্ষ। যার নির্মল হাওয়া আমাদের ভিন্ন এক পরিবেশে নিয়ে যাবে। যে বর্ষের প্রতিটি দিন হোক স্বপ্নময় সোনালি দিন। স্বাগত ইংরেজি শুভ নববর্ষ ২০২৫।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও শিশুসাহিত্যিক,
সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম