রাজনীতি নিয়ে কোনো ‘প্রস্তাব বা সিদ্ধান্ত দেওয়ার এখতিয়ার’ সেনাবাহিনী কিংবা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহব্বায়ক নাহিদ ইসলাম। গতকাল শুক্রবার রাতে দলের জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এসে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিষিদ্ধের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকার, জনগণ ও বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোরই এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য বা পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত বা প্রস্তাব দেওয়ার এখতিয়ার নেই। এ ধরনের চর্চা যেন বাংলাদেশে না হয়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিকভাবেই হবে এবং সামনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই আমরা উত্তরণ করতে চাচ্ছি’। গতকাল শুক্রবার রাতে বাংলা মোটর রূপায়ন টাওয়ারে এনসিপির প্রধান কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন ডাকে দলটি।
আওয়ামী লীগের ‘পরিশীলিত’ নেতাদের নিয়ে নতুন করে দলটি গোছানোর জন্য দেশ ও দেশের বাইরে থেকে প্রচেষ্টা চলছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এ নিয়ে সোচ্চার হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতাদের এই অংশটি। খবর বিডিনিউজের
সংবাদ সম্মেলনে এনসপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, আজ থেকে সাত মাস আগে ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে দেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছিল। আমাদের আশা ছিল বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের চ্যাপ্টার ক্লোজ হয়ে গেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করছে। বিদেশি শক্তিগুলো অনেক সময় আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্মতি উৎপাদনের চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ নিয়ে এসব দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় নাগরিক পার্টি শক্ত অবস্থান ব্যক্ত করছে।
লিখিত বক্তব্যে নাহিদ বলেন, গণঅভ্যুত্থানের সাত মাস অতিবাহিত হলেও গণহত্যাকারী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের খুনিদের বিচারের দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। আমরা তার বক্তব্যের নিন্দা জানাই। আওয়ামী লীগের পিলখানা হত্যাকান্ড, শাপলা হত্যাকান্ড, আগ্রাসনবিরোধী আন্দোলনে হত্যাকান্ড, গুম-ক্রসফায়ার, ভোট ডাকাতিসহ জুলাই হত্যাকান্ডের বিচার প্রশ্নে কার্যকর অগ্রগতি দৃশ্যমান হওয়ার আগে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদ থেকে এ ধরনের বক্তব্য অনাকাঙ্খিত।
তিনি বলেন, ‘এনসিপি মনে করে বিচারিক কার্যক্রমের পরিণতি দৃশ্যমান হতে হবে। কৃত অপরাধের বিচার, দায় স্বীকার, অনুশোচনা, পাপমোচন ছাড়া আওয়ামী লীগের দল হিসেবে ক্রিয়াশীল থাকার পক্ষে যেকোনো ধরনের তৎপরতা ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনের শামিল। এনসিপি জুলাই গণহত্যাসহ বিগত ফ্যাসিবাদী রেজিমে সংঘটিত অপরাপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের নিশ্চয়তা চায়। বিচার চলাকালীন আওয়ামী লীগের নিবন্ধন বাতিল করতে হবে এবং এ মাফিয়াগোষ্ঠীর রাজনীতিতে ফেরার যেকোনো প্রচেষ্টাকে এনসিপি প্রতিহত করবে’।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি রাজনৈতিক দল কেন নিষিদ্ধ থাকবে, সেই প্রশ্নের উত্তরে নাহিদ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কোনো গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক দল নয়; বরং এটি একটি ফ্যাসিবাদী দল। নির্বাচনে ভোটের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পরাজয় ঘটেনি। দল হিসাবে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। যার ফলশ্রæতিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী রেজিম বাংলাদেশ থেকে উৎখাত হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ এ মুহূর্তে গণতান্ত্রিক ফ্রেমওয়ার্কের বাইরে অবস্থান করছে’।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ বলেন, ‘বিচার অনিষ্পন্ন রেখে আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়ার যেকোনো ধরনের আলোচনা ও প্রস্তাব এনসিপি দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে। আওয়ামী মতাদর্শ, দল ও মার্কার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ ৩৬ জুলাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে। ফলে দল ও মতাদর্শ হিসাবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার হারিয়েছে। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার চলাকালে আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিবাদের সব সহযোগী ব্যক্তি ও সংগঠনের রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে’।
ক্যান্টনমেন্টে কী ঘটেছিল?
এনপিপির সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের বিভিন্ন সময় দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু ১১ মার্চের সাক্ষাতের প্রেক্ষাপট ভিন্ন ছিল। আমাদেরকে সেখানে আহবান জানান হয়েছিল। অপর প্রান্তে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ছিলেন’।
সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যে আলাপ হয়েছে, তা ফেসবুকেই স্পষ্ট করা হয়েছে উল্লেখ করে হাসনাত বলেন, ‘এটা রাজনৈতিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা বলে আমরা মনে করছি। রাজনীতির ঘটনা প্রবাহ রাজনীতিবিদদের হাতে থাকা উচিত। কিছু দিন আগে সেনাপ্রধানের একটা বক্তব্য আপনার লক্ষ্য করেছেন। রাজনৈতিক পরিমÐলে এটাকে অশোভন হিসেবে ধরা হয়েছে। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রধানকে যেভাবে এড্রেস করা হয়েছে, আওয়ামী লীগসহ ইনক্লুসিভ নির্বাচনের কথা বলা হয়েছে’।
নিরাপত্তার ঝুঁকি অনুভব করছেন কিনা, এমন প্রশ্নে হাসনাত বলেন, ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো যতক্ষণ ঐক্যবদ্ধ, ততক্ষণ নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি অনুভব করছি না। আওয়ামী লীগ যে একটা গণহত্যা চালাইছে, সে এটাই স্বীকার করে নাই। তার মধ্যে কোনো অনুশোচনা নেই। সেজন্য আমরা বলছি, আগে তার বিচার নিশ্চিত করতে হবে, দল হিসেবে বিচার নিশ্চিত করতে হবে, অপরাধ স্বীকার করতে হবে, তারপর অন্য কোনো আলোচনা হইলে হইতে পারে। এর আগে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা অসম্ভব, ইম্পসিবল’।
একাত্তর প্রসঙ্গ
এনসিপি ২০২৪ সালের পাশাপাশি ১৯৭১ সালের গণহত্যার বিচার নিয়ে কী ভাবছে- এমন প্রশ্নে নাহিদ বলেন, ‘আমরা জুলাই গণহত্যার বিচার নিয়ে অনেক বেশি কনসার্ন। কারণ একাত্তরের গণহত্যার বিচার নিয়ে এখনও অনেক প্রশ্ন আসছে। সেটা আমাদের পুরাতন প্রজন্মের দায়। আমরা একাত্তরের পরে একাত্তরে সংঘটিত গণহত্যার বিচার নিষ্পন্ন করতে পারি নাই। রাজনৈতিক প্রশ্নগুলোর সমাধান করতে পারিনি। এরকম পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য আমরা আওয়ামী লীগের বিচার নিয়ে খুবই কঠোর অবস্থানে। এবং এই বিচারটা আমরা নিষ্পন্ন দেখতে চাই। ৭১ থেকে শুরু করে বাংলাদেশে যত গণহত্যা হয়েছে, সব বিচারই আমরা চাই। তবে রাজনৈতিকভাবে এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ’।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটিকে নিষিদ্ধ করার জন্য বিভিন্ন সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়। গত অক্টোবরে আওয়ামী লীগের ওপর ‘নিষেধাজ্ঞা চেয়ে’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তখনকার সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আব্দুল্লাহ রিট আবেদন করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর আসে। পরে এ বিষয়ে একই বক্তব্য আলাদাভাবে ফেসবুকে পোস্ট করে তারা বলেন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা আদেশ চেয়ে রিট আবেদন করা হয়নি। তারা দুটো রিট আবেদন করেছেন আওয়ামী লীগের বিগত তিনটি নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণার আর্জি জানিয়ে। সেখানে নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয়নি, মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দলটিকে ‘রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখার’ কথা বলা হয়েছে।
এর মধ্যে সবশেষ গত বৃহস্পতিবার রাতে হাসনাতের দেওয়া ফেসবুক পোস্ট ঘিরে নতুন করে আলোচনায় আসে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের ‘দাবি’।
ফেসবুক পোস্টে হাসনাত অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে সেনা প্রশাসন তাদের ‘চাপ দিচ্ছে’। হাসনাতের পোস্টের পর গতকাল শুক্রবার জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এদিন এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ পুরনো দল, এখন সেই দলের যারা অপরাধী, অপরাধের বিচার হলে তারপরে তারা জনগণের কাছে গিয়ে, জনগণ যদি তাদের রাজনীতি করার সুযোগ দেয় সেখানে তো আমাদের কিছু বলার নেই’।