আহমদ মমতাজ : ইতিহাসের এক নীরব সাধক ও চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক বাতিঘর

1

সোহেল মো. ফখরুদ-দীন

বাংলা সাহিত্য, ইতিহাসচর্চা এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতি গবেষণায় যাঁরা নীরবে-নিভৃতে কাজ করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে আহমদ মমতাজ ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব। গবেষক, লেখক এবং সংগঠক- এই তিন ভূমিকায় তিনি যেমন ছিলেন বিশুদ্ধ, তেমনি ছিলেন নিষ্ঠাবান ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন। আজ ৯ মে ২০২৫ তাঁর চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকীতে আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও বেদনাভরে স্মরণ করছি এই ইতিহাসপ্রেমী নিঃস্বার্থ সাধককে, যিনি তাঁর নিরবিচার কর্ম ও সাধনার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে এক নতুন আলোয় আলোকিত করেছিলেন। আহমদ মমতাজের জন্ম ১৯৬০ সালের ২০ জুন, চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার পশ্চিম অলিনগর গ্রামে, এক প্রখ্যাত সুফি পরিবারে। তাঁর পিতা আবদুল বারী ছিলেন একজন সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী, যার আদর্শ ও কর্মকান্ডে প্রভাবিত হয়ে মমতাজের মননে মানবিকতা ও দায়িত্ববোধের বীজ রোপিত হয়। তাঁর মা আমেনা খাতুন ছিলেন এক প্রজ্ঞাময়ী নারী, যিনি গৃহকর্মের পাশাপাশি সন্তানদের শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলায় রেখেছিলেন অসামান্য ভূমিকা। বাঘ শিকারি হাজী শমসের আলী পাহলোয়ান ও ইউসুফ আলী ভূঞার মতো পূর্বপুরুষদের জীবনী তাঁর মধ্যে ইতিহাসচর্চার প্রতি এক প্রগাঢ় আগ্রহ সৃষ্টি করে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের মধ্য দিয়ে তিনি বিদ্যাচর্চার দৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করেন। জীবনের শুরুতে শিক্ষকতা, ব্যাংকিং ও সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত থাকলেও ১৯৯২ সালের পর থেকে তিনি পুরোপুরি নিবেদিত হন মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্প এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক গবেষণায়। বাংলা একাডেমির সহ-পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন বহু গবেষণামূলক কর্মকান্ডে। কৈশোরেই শুরু হয় তাঁর লেখালেখি। ছোটগল্প, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরবর্তীতে তিনি একনিষ্ঠভাবে আত্মনিয়োগ করেন ইতিহাস গবেষণায়। আশির দশক থেকে তিনি চট্টগ্রামের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, সুফিবাদ, লোকজ সংস্কৃতি এবং অবহেলিত মনীষীদের জীবন নিয়ে নিবিড় গবেষণা শুরু করেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও জার্নালে তাঁর ৬০০-র অধিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যা তাঁকে এক স্বতন্ত্র ইতিহাসচর্চাকারী হিসেবে পরিচিত করে তোলে।
তাঁর গ্রন্থ চট্টল মনীষা চট্টগ্রামের ইতিহাস ও মনীষীদের জীবনচিত্র নিয়ে একটি অনন্য গ্রন্থরূপে বিবেচিত। তিনি এই গ্রন্থে অতীতকে বর্তমানের আলোকপাতে বিশ্লেষণ করে একটি বাস্তবধর্মী ইতিহাসচিত্র নির্মাণ করেছেন। জব্বার আলীর বলিখেলা নিয়ে তাঁর গবেষণা, সুফিবাদ ও আঞ্চলিক সংস্কৃতি সংরক্ষণে নিবেদিত কর্ম তাঁকে ইতিহাসচর্চার এক নির্ভরযোগ্য কান্ডারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর পরিচিতি কেবল একজন গবেষক হিসেবে সীমাবদ্ধ ছিল না—তিনি ছিলেন ইতিহাসভিত্তিক সমাজ সংগঠনের এক অগ্রপথিক। চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র, ভ্রাম্যমাণ প্রত্নতাত্ত্বিক আলোকচিত্র মিউজিয়াম, বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ইতিহাস একাডেমি, PEN International-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকায় বাংলা একাডেমির সহ পরিচালক পদে কর্মরত ছিলেন।
চট্টগ্রাম সমিতি-ঢাকা’র সাহিত্য ও গবেষণা নির্ভর রূপায়ণ ছিল তাঁর অন্যতম কীর্তি। এই সমিতির মাধ্যমে তিনি ইতিহাস উৎসবের আয়োজন করে আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় এক নবদিগন্ত উন্মোচন করেন। সেই উৎসবে আমি নিজেও অংশগ্রহণ করেছিলাম এবং ‘প্রাচীন চট্টগ্রাম ও বদর আউলিয়া’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করি। আহমদ মমতাজ ব্যক্তি জীবনে ছিলেন বিনয়ী, আত্মপ্রবঞ্চনাহীন, দৃঢ়চেতা ও অন্তর্মুখী মননের এক নিঃশব্দ যোদ্ধা। ইতিহাস ও সাহিত্যের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল গভীর ও অকৃত্রিম। তাঁর সহধর্মিণী রাইহান নাসরিন একজন লোকসংস্কৃতি সংগ্রাহক ও লেখিকা, যিনি জীবনের পরতে পরতে তাঁর সঙ্গী হয়ে থেকেছেন। তাঁদের যুগল প্রয়াসে চট্টগ্রামের প্রবাদ-প্রবচন নিয়ে একটি মূল্যবান গবেষণাকর্ম ২০০৯ সালে এশিয়াটিক সোসাইটির সাংস্কৃতিক সমীক্ষা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়। আহমদ মমতাজের প্রয়াণ চট্টগ্রামের ইতিহাস গবেষণার অঙ্গনে এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করেছে। তবে তাঁর চিন্তা, কর্ম ও সাহিত্যিক সাধনা আজও তরুণ গবেষক ও ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস। আঞ্চলিক ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রচারে তাঁর যে নিরলস প্রচেষ্টা, তা ভবিষ্যতের গবেষণা ও ইতিহাসপ্রণয়নের এক ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁর সান্নিধ্যে ইতিহাসচর্চায় অনুপ্রাণিত হয়েছি এবং গবেষণাকাজে তাঁর মূল্যবান পরামর্শ ও সহযোগিতা লাভ করেছি।
আহমদ মমতাজ ছিলেন এক আলোকবর্তিকা—নিজে আলো জ্বালিয়েছেন, কিন্তু আলোয় ভেসে থাকার চেষ্টা করেননি। ইতিহাসচর্চায় তাঁর নিঃস্বার্থ সাধনা ও সাংস্কৃতিক দায়বদ্ধতা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে আঞ্চলিক ইতিহাসও হয়ে উঠতে পারে জাতীয় ইতিহাসের অপরিহার্য অংশ। তাঁর এই জীবন ও কর্ম আমাদের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পাঠ, যা কেবল স্মরণ নয়, বরং ইতিহাসচর্চার ভবিষ্যতের জন্য এক দিকনির্দেশনা। চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আহমদ মমতাজ একটি অনন্য নাম। তাঁকে হারিয়ে আমরা হারিয়েছি এক পথপ্রদর্শক, কিন্তু রেখে গেছেন এমন এক আলো, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে যাবে—গবেষণা ও চেতনার বাতিঘর হিসেবে।
লেখক : সভাপতিত- চট্টগ্রাম ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র