আসুরিক শক্তির বিনাশ ও ঐক্যবদ্ধ শক্তির জয় হোক

1

সুমন মজুমদার

আসুরিক শক্তির বিনাশ আর পৃথিবীময় শান্তি, কল্যাণ ও সমৃদ্ধির বার্তা নিয়ে বছর ঘুরে বাঙালি তথা বিশেষ করে বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের সামনে আবার হাজির মা দুর্গা। দেবী দুর্গার আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত হওয়া আবহমান বাংলার বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব শারদীয়া দুর্গাপূজা। সারা বছর ধরে এ উৎসবের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন বাঙালি হিন্দুধর্মাবলম্বীরা। বাঙালি সংস্কৃতিতে বাঙালি মুসলমান সম্প্রদায়ের ঈদোৎসব যেমন গুরত্বপূর্ণ, তেমনি বাঙ্গালি হিন্দু সম্প্রদায়ের শারদীয় দুর্গোৎসবও সমান গুরুত্ব বহন করে। এই দুটি উৎসব বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। উৎসব মূলত সকলে মিলে উদযাপন করার বিষয়। সেদিক থেকে দেখলে উৎসব চরিত্রগতভাবে সেক্যুলার। উৎসবে ধর্মের সম্পৃক্ততা থাকবে না এমনটি নয়, এবং তা উল্লিখিত উৎসব দু’টিতে বিদ্যমান। তবে এই উৎসবসমূহে ধর্মীয় করণক্রিয়া মুখ্য বা কেন্দ্রীয় বিষয় হলেও এর আনুষঙ্গিকতাও কম নয়।
দেখা যায় এসব উৎসবে সামাজিক ও আন্তঃধর্ম সম্প্রদায়গত অংশগ্রহণের চাপ এতটাই বেশি হয় যে, এতে তখন ধর্মীয় করণক্রিয়া বা কেন্দ্রীয় বিষয় আর মুখ্য বা আধিপত্যবাদী অবস্থানে থাকেনা, হয়ে ওঠে সার্বজনীন। তাই শারদীয়া দুর্গাপূজা হলো সার্বজনীন উৎসব। এ পূজা এখন শুধু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসব নয়, এ এখন সকল বাঙালির সাংস্কৃতিক উৎসবে রূপান্তরিত হয়েছে। দুর্গার প্রতিমার সামনে দাড়ালে শুধু একটি মাটির মূর্তি নয়, চোখে ফুটে উঠে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও নিরাপত্তার প্রতিচ্ছবি। শ্রীশ্রীচÐী গ্রন্থে বর্ণিত দেবী দুর্গার কাহিনিগুলির মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় আবার গ্রন্থের মধ্যম চরিত্র বা দ্বিতীয় খÐে উল্লেখিত মহিষাসুর বধের কাহিনিটি। এই কাহিনি অনুসারে, পুরাকালে মহিষাসুর দেবগণকে একশতবর্ষব্যাপী এক যুদ্ধে পরাস্ত করে স্বর্গের অধিকার কেড়ে নিলে, বিতাড়িত দেবগণ প্রথমে প্রজাপতি ব্রহ্মা এবং পরে তাঁকে মুখপাত্র করে শিব ও নারায়ণের সমীপে উপস্থিত হন। মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শ্রবণ করে তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হন। সেই ক্রোধে তাঁদের মুখমন্ডল ভীষণাকার ধারণ করে।
প্রথমে বিষু ও পরে শিব ও ব্রহ্মার মুখমন্ডল হতে এক মহাতেজ নির্গত হয়। সেই সঙ্গে ইন্দ্রাদি অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকেও সুবিপুল তেজ নির্গত হয়ে সেই মহাতেজের সঙ্গে মিলিত হয়। সু-উচ্চ হিমালয়ে স্থিত ঋষি কাত্যায়নের আশ্রমে সেই বিরাট তেজঃপুঞ্জ একত্রিত হয়ে এক নারীমূর্তি ধারণ করল। কাত্যায়নের আশ্রমে আবির্ভূত হওয়ায় এই দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হলেন। আবার অন্য ধর্ম গ্রন্থ থেকে জানা যায়, আশি¡ন মাসের কৃষা চতুর্দশী তিথিতে দেবী কাত্যায়নী আবির্ভূতা হয়েছিলেন, শুক্লা সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে কাত্যায়ন দেবীকে পূজা করেন এবং দশমীতে দেবী মহিষাসুর বধ করেন।
যাই হোক, এক এক দেবের প্রভাবে দেবীর এক এক অঙ্গ উৎপন্ন হল। প্রত্যেক দেবতা তাঁদের আয়ূধ বা অস্ত্র দেবীকে দান করলেন। হিমালয় দেবীকে তাঁর বাহন সিংহ দান করলেন। এই দেবীই অষ্টাদশভূজা মহালক্ষী রূপে মহিষাসুর বধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন (শ্রীশ্রীচন্ডী অনুসারে, মহালক্ষী দেবী মহিষাসুর বধ করেন। ইনিই দুর্গা। তবে বাঙালিরা এঁকে দশভূজারূপে পূজা করে থাকেন)। দেবী ও তাঁর বাহনের সিংহনাদে ত্রিভুবন কম্পিত হতে লাগল। মহিষাসুর সেই প্রকম্পনে ভীত হয়ে প্রথমে তাঁর সেনাদলের বীরযোদ্ধাদের পাঠাতে শুরু করলেন। দেবী ও তাঁর বাহন সিংহ প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করে একে একে সকল যোদ্ধা ও অসুরসেনাকে বিনষ্ট করলেন। তখন মহিষাসুর স্বয়ং দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ শুরু করলেন। যুদ্ধকালে ঐন্দ্রজালিক মহিষাসুর নানা রূপ ধারণ করে দেবীকে ভীত বা বিমোহিত করার প্রচেষ্টায় রত হলেন, কিন্তু দেবী সেই সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিলেন। তখন অসুর অহঙ্কারে মত্ত হয়ে প্রবল গর্জন করল। দেবী বললেন- রে মূঢ়, যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন করে নে। আমি তোকে বধ করলেই দেবতারা এখানে শীঘ্রই গর্জন করবেন। এই বলে দেবী লাফ দিয়ে মহিষাসুরের উপর চড়ে তাঁর কন্ঠে পা দিয়ে শূলদ্বারা বক্ষ বিদীর্ণ করে তাকে বধ করলেন। অসুরসেনা হাহাকার করতে করতে পলায়ন করল এবং দেবতারা স্বর্গের অধিকার ফিরে পেয়ে আনন্দধ্বনি করতে লাগলেন। বাংলায় দেবী দুর্গার যে মূর্তিটি সচরাচর দেখা যায় সেটি পরিবারসমন্বিতা বা সপরিবার দুর্গার মূর্তি। এই মূর্তির মধ্যস্থলে দেবী দুর্গা সিংহবাহিনী ও মহিষাসুরমর্দিনী। তাঁর ডানপাশে উপরে দেবী লক্ষী ও নিচে গণেশ। বামপাশে উপরে দেবী সরস্বতী ও নিচে কার্তিকেয়।
জানা যায়, কলকাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী ১৬১০ সালে এই সপরিবার দুর্গার প্রচলন করেন । তাঁরা কার্তিকেয় রূপ দেন জমিদারপুত্রের, যা তৎপূর্ব ছিল সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আদলে যুদ্ধের দেবতা রূপে । এছাড়াও বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর সংলগ্ন অঞ্চলে দেবী দুর্গা এক বিশেষ মূর্তি দেখা যায়। সেখানে দেবীর ডানপাশে উপরে গণেশ ও নিচে লক্ষী বামে উপরে কার্তিকেয় ও নিচে সরস্বতী এবং কাঠামোর উপরে নন্দী-ভৃঙ্গীসহ বৃষভবাহন শিব ও দুইপাশে দেবীর দুই সখী জয়া ও বিজয়া অবস্থান করেন। শারদীয় দুর্গোৎসব বাঙ্গালি হিন্দুধর্মাবলম্বীসহ সকল বাঙ্গালির জীবনে বয়ে আনুক অনাবিল আনন্দ। এই উৎসব পালিত হোক শান্তিপূর্ণভাবে। আমাদের এই বর্তমান অবক্ষয়িত সমাজের সকল দানবীয় শক্তির বিনাশ হোক, এ সমাজ আবার ভরে উঠুক শান্তি আর মঙ্গলময়ে। অশুভ, অসত্য, সকল অকল্যাণ ও দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার কৃপায় আমাদের এই প্রিয় মাতৃভূমিসহ সমগ্র বিশ্ব সকল অসুরবৃত্তির ধ্বংসসাধন পূর্বক শুভ, সত্য, এবং শান্তিতে পরিপূর্ণ হোক আমাদের এ জন্মভূমি।
লেখক : প্রাবন্ধিক