কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
আসছে ঝড়বৃষ্টি, খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগকাল। বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাংগন, খরা এদেশে নিয়মিত ঘটনা। এই যেমন এখন তাপপ্রবাহের শুরু; পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ¡াসও হতে পারে; নামবে মুষলধারে বৃষ্টিও। হতে পারে অতিবৃষ্টিতে বন্যা। কষ্টে পড়বে মানুষ। এভাবে বন্যা, খরা, নদীভাংগনসহ অন্যান্য সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রায় প্রতিবছরই আমাদের দেশে আসে। এবার গ্রীষ্মে ভয়াবহ তাপদাহের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে আগেভাগেই। এ কারণে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। মানুষের মাঝে সচেতনতা দরকার। প্রয়োজনে গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহ থেকে বাঁচতে মানুষের চলাফেরা, অফিস-আদালতে কাজকর্ম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাসের শিডিউল পরিবর্তন করার পরিকল্পনা নেয়া যেতে পারে। অসুস্থতার কথা চিন্তা করে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
সমুদ্র উপক‚লবর্তী হওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে বেঁচে থাকতে হয় দেশের অনেক মানুষকে বিশেষ করে যারা বিভিন্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চলে বসবাস করে তাদের। এ কারণে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেতে এবং এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে ব্যাপক পরিকল্পনা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাদি নেয়া হয়। আমাদের দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অনুক‚ল হওয়ায় ‘দুর্যোগকালীন’ ব্যবস্থা আগেভাগেই নিয়ে রাখতে হয়। মানুষকে সচেতন করতে হয়। এর আগে এদেশে বিভিন্নসময় ভয়াবহ কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৯১ সালের এই এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়কে। এরপরে রয়েছে সাইক্লোন সিডর। এসব ঘূর্ণিঝড়ে লাখো মানুষ, পশুপাখির মৃত্যু হয়। ঘরহারা হয় অসংখ্য লোক। যে কারণে ঘূর্ণিঝড়ের নাম শুনলেই এদেশের মানুষের বিশেষ করে সমুদ্র উপক‚লবাসীর ঘুম হারাম হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রসহ নিরাপদ স্থানে যেতে বাধ্য হয় তারা। যদিও অনেকে আছেন যারা দুর্যোগেও নিজেদের ঘরবাড়ি আঁকড়ে পড়ে থাকেন। যেতে চাননা কোথাও। ঘূর্ণিঝড়ের পাশাপাশি এর প্রভাবে প্রবল জলোচ্ছ¡াসের কারণে উপক‚লীয় অঞ্চল প্লাবিত হয়।
এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বাড়ে। ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। ঘূর্ণিঝড় পরবর্তি উদ্ধারকাজ ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সব ধরণের সাহায্য-সহযোগিতা দিতে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। ভাটির দেশ হওয়ায় এদেশে অধিক বৃষ্টিপাত এবং উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা হয়। কষ্টে পড়ে হাজার, লক্ষ মানুষ। নষ্ট হয় ফসলী জমি। এমনিতে বৈশ্বিক আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে দেশের নিম্নাঞ্চল ডুবে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায় আমাদেরকে জরুরি ভিত্তিতে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। নিতে হবে মহাপরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ। বন্যা প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে সকলকে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাথে চলমান দীর্ঘদিনের পানি সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিস্তাসহ অভিন্ন সব নদ-নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক তথা ন্যায্য হিস্যা আদায় করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনের সময় পানি না দেওয়া, বর্ষার সময় অতিরিক্ত পানি ছেড়ে দেয়ার যে মানসিকতা তা থেকে বেরিয়ে আসতে ভারতকেই উদ্যোগি হতে হবে। ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি ন্যায়সংগত ও কার্যকর চুক্তিই বাংলাদেশকে বছর বছর বন্যার হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া দেশের বহু নদী ড্রেজিং এর অভাবে ভরাট ও দখলের কারণে ছোট হয়ে আসছে। যে কারণে বাড়তি পানি দু’ক‚ল ছাপিয়ে জনপদে প্রবেশ করছে। প্লাবিত হচ্ছে সংশ্লিষ্ট এলাকা। এ বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ জরুরী। প্রভাবশালীদের খপ্পর থেকে নদীগুলোকে বাঁচাতে হবে। নিয়মিত ড্রেজিং এর মাধ্যমে নদীর গতিপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। নদীভাঙন এদেশে একটি বড় সমস্যা। প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে নদীভাঙনের আশংকা। যে কারণে নদীতীরের জনপদ নদীগর্ভেই বিলীন হওয়ার শংকায় থাকে প্রতিনিয়ত। ভিটেমাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয় সাধারণ মানুষ। প্রতিদিন দেশের কোনও না কোন নদী ভাঙছে। ভাঙনের শিকার হচ্ছে মানুষ। ভাঙছে তাদের ঘরবাড়ি, ফসলি জমি। সে সাথে ভাঙছে তাদের স্বপ্নও। কথায় আছে নদীর এ ক‚ল ভাঙে, ওক‚ল গড়ে। তারপরও আমাদের করণীয় অনেক কিছু আছে। নিতে হবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা। নদীর গ্রোতের কন্ডিশনের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ এবং নদীতীরে বৃক্ষরোপণ ও পাথরের বøক স্থাপন করতে হবে। দিতে হবে মজবুত পাকা পিলার। নদীমাতৃক এদেশ যেমন নদীর কারণে উর্বর তেমনি নদীতীরের মানুষগুলো ভাঙনের শিকার। কত মানুষ যে নদীভাংগনের শিকার হয়ে ঘরবাড়ি হারিয়ে পথে পথে যাযাবরের মতো বাস করছে তার সঠিক কোন হিসেব বোধহয় নেই!
আসলে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে ঠেকানোর কোন ক্ষমতা মানুষের নেই। যে কারণে দুর্যোগে ভয় না পেয়ে কীভাবে তা থেকে বেঁচে থাকা যায় এবং ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায় তা নিয়ে ভাবতে হবে। সম্ভাব্য সব ধরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। একটি সমন্বিত ও কার্যকর কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মোকাবেলা করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই।
লেখক: শিক্ষক ও কলামিস্ট