ফখরুল ইসলাম নোমানী
মহান আল্লাহর ভয়ে কান্না করা নবী-রাসুল ও সালফে সালেহিনের বৈশিষ্ট্য। ইসলামে এর মর্যাদা অনন্য। আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারী মুমিনের জন্য রয়েছে আল্লাহর সন্তুষ্টি পরকালে মর্যাদাপূর্ণ স্থান ও সুখময় জান্নাতের প্রতিশ্রুতি। পৃথিবীর সব মানুষের প্রথম ভাষা কান্না। কান্নার ভাষা সর্বজনীন। সব জায়গা ও সব ভাষার মানুষ কাঁদে। মানুষের কান্নার ভাষা পৃথিবীর সব ভাষাভাষী বোঝে। একজন নবজাতকও দুনিয়াতে নিজের আগমন ও অস্তিত্বের জানান এই কান্নার ভাষায় দিয়ে থাকে। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন প্রত্যেক নবজাতককে জন্মের সময় শয়তান খোঁচা দেয় ফলে সে শয়তানের খোঁচায় চিৎকার করে। সাধারণত কান্নার শব্দ শুনলে আমরা মনে করি লোকটা বড় কষ্ট ও বিপদের মধ্যে আছে। আসলে কি তাই ? কান্নায় কি কেবল মনের দুঃখ-কষ্টের প্রকাশ ঘটে না অন্য কিছুও থাকে ? আসলে কান্নার আছে অনেক প্রকার :
১. বিপদের কান্না : এটা সবাই জানেন বিপদে পড়লে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সবাই কান্না করে থাকে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর শিশুপুত্র ইবরাহিমের মৃত্যুর সময় কান্নারত অবস্থায় বলেছেন চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরে হৃদয় ব্যথিত হয়। তবে আমরা তাই বলি-যার ওপর আমাদের সব সন্তুষ্টি। আর তোমার বিচ্ছেদে আমরা ব্যথিত।
২. বিচ্ছেদের কান্না : আপনজন ও প্রিয়জনের বিচ্ছেদে মানুষ কান্না করে থাকে। হজরত ইয়াকুব (আ.) আপন সন্তান ইউসুফ (আ.) এর বিচ্ছেদে কান্না করেছেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে আর তার চোখ দুটি কাঁপতে কাঁপতে সাদা হয়ে গিয়েছিল এবং তার হৃদয় চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। (সুরা ইউসুফ : ৮৪)
৩. তিলাওয়াতের কান্না : এমন অনেক সৌভাগ্যবান ব্যক্তি আছেন যারা কোরআন তিলাওয়াতের সময় কান্না করেন। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তোমরা কেঁদে কেঁদে কোরআন তিলাওয়াত করো। যদি কান্না না আসে তা হলে কান্নার ভান ধরো। ইমাম গাজ্জালি (রহ.) বলেন সাহাবায়ে কেরামের কোরআন তেলাওয়াতের সময় আশ্চার্যজনক অবস্থা সৃষ্টি হতো সাহাবিদের ভেতর কেউ তেলাওয়াতের সময় কান্না করতেন কেউবা আবার বেহুঁশ হয়ে যেতেন আবার কেউ এই বেহুঁশের মধ্যেই চির বিদায় হয়ে যেতেন।
৪. গুনাহের কথা স্মরণ করে কান্না : যাপিত জীবনে কমবেশি সবাই গুনাহ করে থাকে তবে গুনাহের কথা স্মরণ করে কান্না করা এক অনন্য গুণ। যে ব্যক্তি আপন গুনাহের কথা স্মরণ করে কান্না করে আল্লাহতাআলা তার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। এ সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন আল্লাহতাআলার কাছে দুই ফোঁটা অত্যন্ত প্রিয়। এক. আল্লাহতাআলার ভয়ে যে অশ্রু ফোঁটা ঝরে। দুই. আল্লাহতাআলার রাস্তায় যে অশ্রু ফোঁটা ঝরে।
৫. আল্লাহর ভয়ে কান্না : চোখের সদ্ব্যবহারের একটি অনন্য দিক হলো আল্লাহর ভয়ে কাঁদা। আল্লাহর ভয়ে কাঁদা মোমিনের একটি বিশেষ গুণ এবং একনিষ্ঠতার বড় প্রমাণ। আল্লাহর ভয় ইমানের অপরিহার্য উপাদান। কেননা ইমান হলো আশা ও ভয়ের ভেতরে। নবী-রাসুলদের বৈশিষ্ট্যের ব্যাপারে আল্লাহতাআলা ঘোষণা করেন এরা সৎ কাজে ছিল ক্ষিপ্রগতি। তারা আমাকে ডাকত আশা নিয়ে ও ভীত হয়ে। আর তারা ছিল আমার প্রতি বিনয়ী। (সুরা আম্বিয়া : ৯০)
৬.শুকরিয়ার কান্না : মানুষ কখনো নিজের আপনজন হারিয়ে বা প্রত্যাশিত জিনিস পাওয়ার আনন্দে কান্না করে থাকে। এ রকম অনেক কারণে মানুষ কান্না করে এবং অশ্রু পাত করে। এসবের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে তাঁর জন্য অশ্রুপাত করা। হাশরের ময়দানে এ প্রকারের কান্না ও অশ্রু অমূল্য সম্পদ হয়ে বান্দাকে আনন্দিত করবে এবং মুখে হাসি ফোটাবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের তাঁর জন্য কান্না ও অশ্রুপাত করে চিরস্থায়ী জীবনের সফলতা অর্জন করার তওফিক দান করুন।
৭. সমস্যা সমাধানে কান্নামাখা দোয়া : বালা-মসিবত দূরীকরণ মনের আশা পূরণ এবং জীবনের লক্ষ্য অর্জনে বর্তমানে মানুষ কত কিছুই না করে ! কত অবর্ণনীয় ত্যাগ-তীতিক্ষা স্বীকার করে ক্যারিয়ার গঠনে। কত নির্ঘুম রাত জাগে আজন্ম লালিত স্বপ্ন পূরণে। নানান টিপস, বই-পুস্তক রচনা, কোর্স প্রশিক্ষণ, মনোবিজ্ঞান ও দার্শনিকদের দর্শন, সাইকোলজিস্টের প্রেসক্রিপশন, কবিরাজদের কারসাজি, এমনকি তাবিজ-কবজ- এককথায় কোনো কিছুই বাদ রাখে না মানুষ উদ্দেশ্য সাধনে। কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় করে হলেও এসবের বাজার গরম রাখে। দুঃখজনকভাবে যে বাজারটা ঠান্ডা রাখে সেটা হলো বিনামূল্যে রবের দরবারে কান্নার বাজার। অদ্ভুত সত্যিই অদ্ভুত! যিনি সব ক্ষমতার উৎস যা-ই চান তা-ই করতে সক্ষম সেই মহান রাজাধিরাজ রবের কাছে ধর্না না দিয়ে মাখলুকের দুয়ারে দুয়ারে ঘোরা বোকামি নয় কি ? মানুষ যতদিন এ কথা হৃদয়ে বদ্ধমূল করবে না যে সব সমস্যার সমাধানকারী একমাত্র আল্লাহ ততদিন প্রকৃত সুখের নাগাল পাবে না।
জীবনের সব ক্ষেত্রে মহান আল্লাহকে ভয় করতে হবে। আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করা যাবে না। অনেক কারণে মানুষ কান্না করে এবং অশ্রুপাত করে। এসবের মধ্যে আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে তাঁর ভয়ে কান্না করা। হাশরের ময়দানে এ প্রকারের কান্না ও অশ্রু অমূল্য সম্পদ হয়ে বান্দাকে আনন্দিত করবে এবং মুখে হাসি ফোটাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন তিনটি চোখ জাহান্নামের আগুন দেখবে না। যে চোখ আল্লাহর রাস্তায় পাহারাদারি করে যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কাঁদে যে চোখ আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ জিনিস দেখে ক্ষুব্ধ হয়। ইবনু আববাস (রা.) বলেন আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি জাহান্নামের আগুন দু’টি চোখকে স্পর্শ করবে না। এক-আল্লাহর ভয়ে যে চোখ ক্রন্দন করে এবং দুই-আল্লাহর রাস্তায় যে চোখ পাহারা দিয়ে বিনিদ্র রাত অতিবাহিত করে। বুখারীর আরেকটি প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে যে আল্লাহকে স্মরণ করেছে এবং তার ভয়ে কান্না করেছে তাকে আল্লাহর আরশের নিছে স্থান করে দিবেন। হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট শুনেছি তিনি বলেছেন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহতাআলা সেদিন তাঁর (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তার ছায়া ব্যতীত অন্য কোনো ছায়া থাকবে না। তন্মধ্যে ওই ব্যক্তি একজন যে নির্জনে আল্লাহতাআলাকে স্মরণ করে আর তার চোখ থেকে পানি ঝরে। হজরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন দুটি চোখকে দোজখের আগুন স্পর্শ করবে না প্রথম হলো সেই চোখ যা আল্লাহর ভয়ে কাঁদে। আর দ্বিতীয় হলো সেই চোখ যা আল্লাহর পথে (জিহাদে) পাহারায় রাতযাপন করে। আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীর জন্যে উচ্চ মর্যাদা রয়েছে। এটি হৃদয়ে ঈমান ও আল্লাহর প্রতি ভয়ের নিদর্শন। আমরা কুরআন তেলাওয়াত করি জাহান্নাম ও আল্লাহর শাস্তি সম্পর্কে আলোচনা শুনি। কিন্তু আমাদের হৃদয়ে আল্লাহর ভীতি আসে না। তাঁর ভয়ে দুচোখ দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয় না। এরূপ পাষাণ হৃদয়ের অধিকারী হওয়া মুমিনের বৈশিষ্ট্য নয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দনকারীর জন্য পরকালে মর্যাদাপূর্ণ স্থান ও সুখময় জান্নাত রয়েছে।
আবু মুসা আশয়ারী (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন রাসুল (সা.) বলেছেন অবশ্যই জাহান্নামবাসীরা কাঁদতে থাকবে। তাদের চোখের পানি এত বেশি হবে যে এর ওপরে জাহাজ চালানো সম্ভব হবে। জাহান্নামবাসীদের চোখের পানি শেষ হওয়ার পর তারা রক্ত দিয়ে কাঁদতে থাকবে। তাই দুনিয়ায় সময় থাকতে আমাদের অধিক পরিমাণে কান্না করে চোখের পানি ফেলতে হবে। তবেই আমরা হয়তো এই চোখের পানির ওসিলায় জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারব। তাই আল্লাহভীতি জাগ্রত করতে হবে। আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করে তওবা করতে হবে। আমরা অনেকে মনে করি আমরা পাপের সাগরে ডুবে গেছি আল্লাহ আমাদের হয়তো ক্ষমা করবেন না এগুলো ভুল ধারণা। তিনি দয়ার সাগর। বান্দার এক বিন্দু অনুশোচনার অশ্রু তিনি সহ্য করতে পারেন না। তাই এক ফোঁটা অশ্রু দিয়েই তিনি বান্দার জীবনের সকল গুনাহ ধুয়ে সাফ করে দেন। জাহান্নামকে চিরতরে হারাম করে দেন। আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে ক্রন্দন করা নবী-রাসূল, ছাহাবী, তাবেঈ ও মুমিনদের বৈশিষ্ট্য। আমাদের উচিত এই গুণটি হাছিল করে ইহকাল ও পরকালে সাফল্য লাভ করা। রাসুল (সা.) হৃদয়ের কঠোরতা থেকে মুক্তি চেয়ে দোয়া করতেন হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই এমন জ্ঞান থেকে যা কোনো উপকারে আসে না, এমন হৃদয় থেকে যা ভীত হয় না এমন আত্মা থেকে যা তৃপ্ত হয় না এবং এমন আহ্বান থেকে যাতে সাড়া দেওয়া হয় না। আল্লাহ আমাদেরকে তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতি দান করুন-আমীন!
লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট