আল্লামা মীর মাহবুবুল আলম মুনিরী (রহ) কীর্তিমান আধ্যাত্মিক মনীষী

5

আ ব ম খোরশিদ আলম খান

মহান আল্লাহর নৈকট্যধন্য নবী রাসূলের কর্মধারা ও দ্বীন প্রচারের মিশন সমাপ্তির পর দ্বীন প্রচারের জিম্মাদারি এখন অর্পিত আউলিয়ায়ে কেরামের ওপর। আল্লাহ পাকের প্রিয় বান্দাহ এই ওলী বুজুর্গগণই যুগে যুগে মানুষকে দ্বীন ধর্মের দিকে ডেকে আনেন। তাঁদের অসাধারণ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা, ব্যক্তিত্বের মহিমা ও চারিত্রিক গুণ-বৈশিষ্ট্য দেখে সর্বস্তরের মানুষ তাঁদের দিকে ঝুঁকে পড়েন। এমন একজন কামেল বুজুর্গ ব্যক্তিত্বই হলেন পীরে তরিকত শাহসূফি আল্লামা মীর মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম মুনিরী (রহ)।
তিনি চট্টগ্রাম হাটহাজারী ধলইস্থ মীর মুনিরিয়া মাহবুবীয়া দরবার শরিফের মহান আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব। এ অঞ্চলে ইসলামী শিক্ষা সংস্কৃতির বিকাশ এবং ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবধারায় জনমানস গঠনে তিনি আজীবন নিজেকে নিবেদিত রেখেছিলেন। তিনি একজন তরিকতের শায়খ ও পীর ছিলেন। কিন্তু পীরগিরীর আড়ালে বৈষয়িক লাভালাভের বিষয় তাঁর মাঝে দেখা যায়নি। নিজের কামালিয়ত, আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও বুজুর্গি দ্বারা ফরিয়াদি ভক্ত জনতার কল্যাণই করে গেছেন আজীবন। আল্লামা মীর মাহবুবুল আলম মুনিরী (রহ) এর জন্ম ১৯৩২ সনে চট্টগ্রাম হাটহাজারী উপজেলা ধলই এলাকার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। তাঁর পিতা মরহুম মীর আহমদ মিয়া এবং মাতা মরহুমা আলবেলা খাতুন। বাল্যকালে তিনি গ্রামের মক্তবে কুরআন মজিদের শিক্ষা গ্রহণ করেন। মক্তবের শিক্ষক তাঁর তীক্ষ্ণ মেধাশক্তি দেখে অভিভূত ও মুগ্ধ হন। তিনি যে একদিন একজন মহান বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব হবেন তা বাল্যকালেই অনেকে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাঁর সুমধুর আচার আচরণ, উন্নত স্বভাব, সরলতা, সাদাসিধে জীবন যাপন দেখে যে কেউ অভিভূত হতেন। মক্তবের শিক্ষক তাঁকে নিয়ে যান আরেক শীর্ষস্থানীয় বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব ও আধ্যাত্মিক পুরুষ আল্লামা সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদী (রহ) এর কাছে। ফরহাদাবাদী হুজুর (রহ) তাঁকে মাদ্রাসায় পড়াশোনার জন্য পরামর্শ দেন। তিনি তাঁকে তাঁর পীরভাই নাজিরহাট জামিয়া মিল্লিয়া আহমদিয়া আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা আল্লামা কাজী আবদুল হালিম (রহ) এর কাছে পাঠিয়ে এ মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। ১৯৫৪ সনে তিনি এ মাদ্রাসা হতে ফাযিল পাস করেন। তৎকালীন স্বনামখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান এই জামিয়া মিল্লিয়া মাদ্রাসাতেই তিনি কুরআন, হাদিস, ফিকহ, আরবি, ফার্সি ও উর্দুসহ বিভিন্ন ভাষা ও বিষয়ে পান্ডিত্য ও ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তাঁর অসাধারণ মেধা, ধীশক্তি ও চরিত্র মাধুর্য ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে থাকে। মাদ্রাসা থেকে ফাযিল পাস করার পর নাজিরহাট জামিয়া মিল্লিয়া মাদ্রাসায় তাঁর কর্মজীবন তথা শিক্ষকতা শুরু হয়। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘ধলই মুনিরীয়া হাফেজিয়া মাদ্রাসা ও এতিমখানা’। ১৯৮১ সনে প্রতিষ্ঠিত এ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হাটহাজারীর তৃণমূল এলাকায় কুরআন মজিদ শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। আজ প্রায় অর্ধশতাধিক এতিম অসহায় শিক্ষার্থীর ঠিকানা এই হেফজখানা ও এতিমখানা। এছাড়া কোমলমতি কচিকাচা শিশুদের জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ধলই মুনিরীয়া মাহবুবীয়া ফোরকানিয়া মাদ্রাসা’। মাদ্রাসার পাশেই তিনি ‘ধলই মুনিরীয়া জামে মসজিদ’ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এভাবে দ্বীনি শিক্ষা বিস্তার, সুন্নিয়ত ও তরিকতের খেদমত এবং জনসেবায় আজীবন তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর ইবাদত বন্দেগি, রিয়াজত সাধনা সবই ছিল উঁচু মার্গের। তিনি সাধারণের মতো জীবন যাপন করলেও আদতে ছিলেন অসাধারণ কীর্তিমান আধ্যাত্মিক মনীষী।
পীরে কামেল শাহসূফি আল্লামা মীর মুহাম্মদ মাহবুবুল আলম মুনিরী (রহ) এর সংসার জীবন শুরু হয় ১৯৫০ সনে। তাঁর সাত ছেলে এবং পাঁচ মেয়ের সবাই উচ্চশিক্ষিত ও নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে পীরে তরিকত আল্লামা মীর মুহাম্মদ আবদুর রহিম মুনিরী (মজিআ) চট্টগ্রামের একটি প্রসিদ্ধ কলেজের অধ্যাপক। বুজুর্গ পিতার কাছ থেকে তিনি ৩১.১১.১৯৯১ সনে পিতাকতৃক খেলাফত লাভ করেন এবং মীর মুনিরীয়া মাহবুবীয়া দরবার শরিফের জিম্মাদারি লাভ করেন। তাঁর সন্তানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ, মমতা, সম্প্রীতি ও পরস্পর ভালোবাসার গুণ-বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়। দরবারের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে যে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি বা সীমালংঘন তাঁরা সকলেই এড়িয়ে চলেন। এজন্যই ভক্ত জনতার কাছ থেকে তাঁরা সম্মান ও শ্রদ্ধা অর্জনে সক্ষম হচ্ছেন।
ওলী বুজুর্গগণ অসীম আধ্যাত্মিকতার অধিকারী হলেও তাঁরা কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা প্রকাশ করতে চান না। তবুও তাঁদের কাছ থেকে নানা কারামত প্রকাশ হয়ে পড়ে। এমন অনেক কারামত লক্ষ্য করা যায় শাহসূফি আল্লামা মীর মাহবুবুল আলম মুনিরী (রহ) এর জীবনেও। তিনি নিজের অসীম আধ্যাত্মিক শক্তি দ্বারা আজীবন মানুষের কল্যাণে উৎসর্গীত ছিলেন। এটাই তাঁর জীবনের বড় বৈশিষ্ট্য। ১৯৯১ সনে হাটহাজারীর ধলই ও ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ধানখেতে বিষাক্ত পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। উৎপাদিত ফসল নিয়ে এলাকার মানুষ উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত হয়ে পড়ে। তখন এলাকার কৃষকরা তাঁর কাছে দোয়া নিতে আসে। মুনিরী হুজুর (রহ) তাদের বলেন, পানি নিয়ে আসতে। পানির বোতলে তিনি দোয়া পড়ে ফুঁক দিয়ে বললেন, পানিগুলো বিলের চারপাশে ছিটিয়ে দিতে। অবাক ব্যাপার যে, পরবর্তীতে দেখা গেল ধানখেতের সব আগ্রাসী পোকা মাকড় উধাও। এরপর থেকে ধানখেতে পোকার উপদ্রব দেখা দিলে এলাকার লোকজন তাঁর কাছে ছুটে আসতো। তিনি পানি পড়া দিয়ে কৃষকদের উপকার করতেন।
এ মহান কীর্তিমান যশস্বী বুজুর্গ ব্যক্তিত্ব ২০০২ সনের ২০ মে দুনিয়া থেকে প্রস্থান করলেও তাঁর সুমহান কীর্তিই তাঁকে অক্ষয়-অমর করে রেখেছে। প্রতি বছর ১৯ ও ২০ মে দ্বীনি ও নানা সেবামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে ধলই মীর মুনিরীয়া মাহবুবীয়া দরবার শরিফে তাঁর বার্ষিক ওরশ শরিফ অনুষ্ঠিত হয়। এ মহান বুজুর্গ ব্যক্তিত্বের উসিলায় আমাদের জীবন ধন্য ও আলোকিত হোক এই প্রার্থনা।

লেখক : সাংবাদিক, ইসলামী চিন্তাবিদ