আলোর মুখ দেখবে তো?

3

পটিয়া প্রতিনিধি

চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে নিত্য যানজট ও একের পর এক দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। ফলে সময়ের সাথে সাথে এ সড়কটি প্রশস্তকরণের দাবি জোরালো হচ্ছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাসিন্দাদের মাঝে। এরই মধ্যে গেল ঈদুল ফিতরের দিন থেকে টানা তিন দিনে ভয়াবহ পৃথক তিনটি দুর্ঘটনায় ১৫ জনের প্রাণহানির পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্তকরণের জোরালো দাবি করেছে বিভিন্ন সংগঠন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ৪ লেনে উন্নীত করার প্রায় এক যুগ পর চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কও চার লেনে প্রশস্তকরণ করার ঘোষণা আসে সরকারের পক্ষ হতে। সে হিসেবে আগামী বছর জানুয়ারিতেই সড়কটি প্রশস্তকরণ কাজ শুরু করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। সড়কটি প্রশস্ত হলে শুধু যানজট নয়, দুর্ঘটনাও কমে আসবে। বদলে যাবে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের জীবনযাত্রা ও দেশের অর্থনীতি।
এদিকে, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক দেশের ব্যস্ততম মহাসড়কের একটি। এর বেশির ভাগ অংশের প্রশস্ততা মাত্র ১৮-৩৪ ফুট। ফলে দূরপাল্লার গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না। ১৪৮ কিলোমিটার পথ বাসে যেতে সময় লাগে ৫ থেকে ৬ ঘণ্টা। অতিরিক্ত বাঁক, সাইড রোড থেকে যখন তখন গাড়ি মহাসড়কে উঠে আসার কারণে সড়কটি হয়ে উঠেছে দুর্ঘটনাপ্রবণ। এছাড়াও পলিথিন ছাড়া লবণ পরিবহনের কারণে সড়ক পিচ্ছিল হওয়ায় আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।

চার লেনে উন্নীতকরণের কথা জানিয়েছে সওজ : চট্টগ্রাম দক্ষিণ সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী পিন্টু চাকমা বলেন, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার অর্থায়নে ১৪৮ কিলোমিটার দীর্ঘ চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক প্রশস্তকরণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ চলছে। আগামী সেপ্টেম্বরে এ কাজ শেষ হলে প্রকল্প প্রস্তুত করে দরপত্র আহবান করা হবে। ২০২৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে সড়কটি চার লেনে প্রশস্তকরণ কাজ শুরু হতে পারে।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের বৃহত্তম মহাসড়ক (এন-১) ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। নানা কারণে সড়কটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে কক্সবাজারের মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল, মহেশখালী পাওয়ার হাব, মাতারবাড়ি পাওয়ার হাব, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরসহ বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প রয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থানের কারণে কক্সবাজারের বিদেশি ক‚টনীতিক, দাতা সংস্থা ও পর্যটকদের যাতায়াত বেড়েছে কয়েকগুণ। মহাসড়কের পটিয়া থেকে চকরিয়া পর্যন্ত অংশে রয়েছে ৫০টির বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক। এই বাঁকগুলোকেই দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছেন সওজের প্রকৌশলী ও হাইওয়ে পুলিশের কর্মকর্তারা।
জানা যায়, পর্যটনের গুরুত্ব বিবেচনায় ২০১৩ সালে মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে একটি সমীক্ষা শুরু করে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) অর্থায়নে এই সমীক্ষা শেষ হয় ২০১৫ সালে। তবে অদৃশ্য হাতের ইশারায় সওজ অধিদপ্তরে ফাইলেই আটকে থাকে এক যুগ ধরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের উন্নয়নকাজ।
সওজ অধিদপ্তরের তথ্য সূত্রে আরও জানা যায়, ২০১৩-১৫ সময়ে সুইডিশ কনসালট্যান্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে সমীক্ষা চালায়। সমীক্ষা প্রতিবেদনে ২২৫ কিলোমিটার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতের সুপারিশ করা হয়। এজন্য ওই সময় প্রাক্কলন ব্যয় ধরা হয় প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় এটি ‘কন্ট্রোলড-অ্যাকসেস হাইওয়ে’ হিসেবে নির্মাণের পরিকল্পনা শুরু করে সওজ অধিদপ্তর। এতে কমে যায় মহাসড়কটির দৈর্ঘ্যও। পরিবর্তিত দৈর্ঘ্য ধরা হয় ১৩৬ কিলোমিটার। এজন্য ১৩ হাজার ৮৬৬ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবও (ডিপিপি) প্রস্তুত করা হয়। নতুন নকশায় মহাসড়কটির প্রশস্ততা ধরা হয় ৮২ ফুট। সে সময়ে জি-টু-জি ভিত্তিতে মহাসড়কটি চার লেনে উন্নীত করতে সমীক্ষা করছিলেন জাপানের মারুবেনি। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। সেসময় প্রকল্পটির ডিপিপি পরিকল্পনা কমিশনে জমা দিয়েছিল সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
এর আগে, সড়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামশুল হককে প্রকল্পটির কনসালটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার নেতৃত্বে বুয়েটের একদল প্রকৌশলী প্রকল্পটির সমীক্ষা শুরু করেছিলেন। কয়েকবার প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনও করেছেন তারা। সে সময়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার একটি ডিপিপি মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে এক্সপ্রেসওয়ে করার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ফলে চার লেন প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় নি।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ১৫০ কিলোমিটার দূরত্বের এই মহাসড়কে প্রতিদিন চলাচল করছে ২০ হাজারেরও বেশি যানবাহন। একাধিক কারণে এ মহাসড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা। তবে দুর্ঘটনা কমাতে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চারলেনে উন্নীত করা ছাড়া বিকল্প নেই।