আর কালক্ষেপণ নয়

2

অবশেষে কর্ণফুলী নদীর উপর নতুনভাবে নির্মাণ হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত কালুরঘাট সেতু। গত সোমবার একনেকের সভায় সেতু নির্মাণের ব্যয় নির্ধারণ ও অনুমোদন হয়। গতকাল মঙ্গলবার দৈনিক পূর্বদেশসহ স্থানীয ও জাতীয় সহযোগী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানা যায়, কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন পেয়েছে। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ও একনেক চেয়ারপার্সন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১১ হাজার ৫৬০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সাত হাজার ১২৫ কোটি ১৫ লাখ টাকা ঋণ দিবে দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল ও ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি। বাকি চার হাজার ৪৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকা দিবে বাংলাদেশ সরকার। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের টার্গেট নেয়া হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে ২৭ জুন ২০২৪ খ্রি. তারিখে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোরিয়ান ব্যাংকের সাথে ঋণচুক্তি হয়। কালুরঘাট পয়েন্টে ‘কনস্ট্রাকশন অব রেলওয়ে কাম রোড ব্রিজ অ্যাক্রোশ দ্য রিভার কর্ণফুলী’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাংলাদেশ রেলওয়ে বাস্তবায়ন করবে।
কালুরঘাট সেতু প্রকল্পের ফোকাল পারসন ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘যাচাই বাছাই শেষে প্রকল্পটি একনেক সভায় তোলা হলে সেটি অনুমোদন দেয়া হয়। আগামী বছরের শুরুতে কাজের টেন্ডার শুরু হবে। টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হলেই কাজ শুরু হবে। এ সেতুটি বাস্তবায়ন হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ কক্সবাজারের মানুষ উপকৃত হবে।’স ডিপিপি সূত্র জানায়, বর্তমানে কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপরে যে পুরনো সেতু রয়েছে তার ঠিক ৭০ মিটার উজানে এই প্রস্তাবিত নতুন সেতু নির্মিত হবে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য হবে ৭০০ মিটার আর এতে নেভিগেশন হাইট বা উচ্চতা হবে ১২ দশমিক ২ মিটার আর এ জন্য দুই প্রান্তে সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে ২ দশমিক ৫০ মিটার করে। সমীক্ষা অনুযায়ী নতুন সেতু হচ্ছে ৭০ ফুট। এর মধ্যে ৫০ ফুটে হবে ডাবল গেজ ও মিটার গেজ (এমজি ও বিজি) ডাবল ট্র্যাক। ২০ ফুটের মধ্যে দুই লেনের সড়ক পথ তৈরি করা হবে। প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ব্যয় হবে দুই হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সেতুটি নির্মিত হলে এই সেতু দিয়ে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রতিদিন ২০ জোড়া ট্রেন পরিচালনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে রেলওয়ে।
এর আগে ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট একবার একনেক সভায় প্রকল্পটি তোলা হলেও ডিজাইন সংশোধন করে পুনরায় একনেক সভায় তোলার নির্দেশনা দিয়ে সেটি ফেরত দেয়া হয়। পরে বিআইডবিøউটিএ কর্ণফুলী নদীর উপর এ সেতু নির্মাণ নিয়ে আপত্তি তোলে। তারা সেতুটি নির্মাণে ১২ দশমিক ২ মিটার উচ্চতা রাখার জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব দেয়। এরপর সেতু নির্মাণে পুনরায় পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ফিজিবিলিটি স্টাডি দাখিল করে। এতে কর্ণফুলী নদীর উপর ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন ও দুই লেন বিশিষ্ট সড়ক পথের সুবিধা রেখে সেতু নির্মাণে প্রকল্প প্রস্তুত করা হয়। সেতুটির উচ্চতা বাড়ার কারণে প্রায় দশ গুন ব্যয় বেড়ে যায়।
উল্লেখ্য যে, ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে রেল যোগাযোগের জন্য বর্তমানে কালুরঘাট সেতুটি নির্মিত হয়। পরে ১৯৫৮ সালে এ সেতুটি সব ধরনের যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হয়। নব্বইয়ের দশকে চট্টগ্রাম দোহাজারী রুটে ট্রেন চলাচল সীমিত হয়ে পড়লে কালুরঘাট সেতুতে যান চলাচলে চাপ বাড়ে। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ে দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু ভেঙে গেলে কালুরঘাট সেতু হয়ে পড়ে নগরীর সাথে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ছয়টি উপজেলা ও কক্সবাজার, বান্দরবান জেলার যোগাযোগের অন্যতম রাস্তা। ২০০১ সালে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করার পর ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় এ সেতুটি বন্ধ রেখে সংস্কার কাজ করেছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। কক্সবাজারের পথে রেল চালুর জন্য কালুরঘাট সেতু সংস্কারের জন্য গত বছরের ১ আগস্ট থেকে যান চলাচল বন্ধ হয়। এখনো সেতুর সংস্কার কাজ শেষ হয়নি। গত বছরের ৫ নভেম্বর কক্সবাজারের পথে রেল চলাচল শুরু হয়। জরাজীর্ণ সেতুটি ধরেই কক্সবাজারে ট্রেন চলাচল করছে। এদিকে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীতে নতুন সেতু নির্মাণ কার্যক্রমের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় আর যেন কালক্ষেপণ না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে বোয়ালখালী-কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ। একই সঙ্গে একনেকে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়ায় তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন সংগঠনটির নেতারা। গত সোমবার গণমাধ্যমে এক বিবৃতিতে এ অনুরোধ জানান সংগঠনের আহব্বায়ক মো. আব্দুল মোমিন, যুগ্ম আহব্বায়ক মুস্তফা নঈম এবং সদস্য সচিব রমেন দাশগুপ্ত। বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, অনাকাক্সিক্ষত কোনো বাধাবিঘ্ন, বিলম্ব সৃষ্টি না হয়, সেতু বাস্তবায়নের কার্যক্রমে সৃষ্ট প্রত্যাশিত গতি যেন বহাল থাকে, দরপত্রসহ আনুষাঙ্গিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই যেন সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হয়। বোয়ালখালী-পটিয়াসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে যে প্রাণসঞ্চার হয়েছে, মানুষ যেভাবে আশায় বুক বেঁধেছে, অনাকাঙ্খিত জটিলতা কিংবা কালক্ষেপণের কারণে সেটি যেন চরম হতাশায় পরিণত না হয়, সেদিকে দৃষ্টি রেখে সজাগ থাকার জন্য আমরা অনুরোধ জানাচ্ছি। প্রধান উপদেষ্টা এবং রেলপথ উপদেষ্টা, উভয়ে চট্টগ্রামের সুযোগ্য সন্তান, সেতু নির্মাণের প্রাকপ্রক্রিয়ায় আমরা তাঁদের আন্তরিক নজরদারি প্রত্যাশা করছি। আমরাও বোয়ালখালী বাসীসহ দক্ষিন চট্টগ্রামের সকল জনগোষ্ঠীর সাথে সহমত পোষণ করছি। এবার কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়নে আর কোন ধরনের কালক্ষেপণ হবে না-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।