আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সমবায়

2

অমল বড়ুয়া

সৃষ্টির আদিকাল থেকে মানুষ সংঘবদ্ধ জীবনযাপনে অভ্যস্ত। আদিম মানুষ জীবন ও জীবিকার তাগিদে শিকার করতো দলবদ্ধভাবে। আবাস স্থাপন ও বসবাস করতো দলবদ্ধভাবে। আর যেকোনো সমস্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যপ্রাণীর আক্রমণ কিংবা দস্যু-তস্করের আক্রমণকে ঠেকিয়েছে দলবদ্ধ হয়ে। দলবদ্ধ জীবনযাপনের প্রেক্ষিতে সৃজিত হয় সংগঠন, পরিবার ও সমাজব্যবস্থা। আর সমাজ থেকে সৃষ্টি রাষ্ট্র বা দেশ। এই দেশ ও সমাজব্যবস্থায়ও মানুষ প্রতিটি ক্ষেত্রে সংগঠিত হয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই সম্মিলিত উদ্যোগই মানুষের প্রাত্যাহিক জীবনাচারে ও কর্মপ্রচেষ্টায় অমিত শক্তির উম্মেষ ঘটায়। মানুষের সম্মিলিত উদ্যোগ থেকেই সৃষ্টি হয় সমবায়। সমবায় শব্দের আভিধানিক অর্থ- মিলন, নিত্য সম্বন্ধ, একত্র হবার বুদ্ধি ও প্রয়াস, সমবেত বা যৌথ কর্মপ্রচেষ্টা। ইংরেজীতে যা CO-OPERATIVE নামে অভিহিত। সমবায় অর্থ হলো ‘আত্মসাহায্য ও পারস্পরিক সহযোগিতা।’ সমবায়ের শাব্দিক অর্থ হলো সমিতির উদ্যোগ বা প্রচেষ্টায় কাজ করা। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা ও চিন্তা থেকেই সমবায়ের উৎপত্তি। সাধারণ অর্থে সমাজের নির্মল ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির লোকজন নিজেদের কল্যাণের লক্ষে স্বেচ্ছায় অনুপ্রাণিত হয়ে যে ব্যবসায় সংগঠন গড়ে তোলে তাকে সমবায় সমিতি বলে। আন্তর্জাতিক সমবায় মৈত্রী জোট (International Co-operative Alliance) তাদের সমবায় পরিচিতি নির্দেশিকাতে সমবায়ের সংজ্ঞা দিয়েছে এই ভাবে, ‘সমবায় হল সমমনা মানুষের স্বেচ্ছাসেবামূলক একটি স্বশাসিত সংগঠন যা নিজেদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের জন্য কাজ করে এবং এ লক্ষে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিকভাবে নিয়ন্ত্রিত ব্যবসা পরিচালনা করে।’ মুলতঃ সমবায় হচ্ছে একটি আদর্শ ও চেতনার নাম যেখানে আদর্শিকভাবে সমমানসিকতার লোকজন একত্রিত হয়ে কাজ করে।’
প্রচলিত প্রবাদে তাই বলা হয় ‘সমবায় হচ্ছে সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা অর্থাৎ সকলে মিলে মিশে কাজ করা।’ সমবায়ের মুল কথা হচ্ছে ‘দশে মিলি করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ’। সম্পদ ব্যবস্থাপনাগত দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায় ‘সমবায় হচ্ছে অর্থনীতির ভাষায় পাঁচটি মুলধন (১) অর্থনৈতিক মুলধন ((Economic Capital);); (২) মানবীয় মুলধন ((Human Capital); (৩) সামাজিক মুলধন (Social Capital); (৪) প্রাকৃতিক মুলধন (Natural Capital) এবং (৫) ভৌত মুলধনের (Physical Capital) সঠিক ব্যবহারের হাতিয়ার।
সমবায় সমিতির ইতিহাস প্রায় মানবসভ্যতার ইতিহাসের ন্যায় প্রাচীন। বর্তমানের সমবায় সমিতির সাংগঠনিক রূপ প্রতিষ্ঠিত হয় ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের কিছু পূর্বে। সপ্তদশ শতকের শেষভাগ থেকে সমবায় সংগঠনের ভাবনা দানা বাঁধলেও শিল্প বিপ্লবের শুরুর পর এ চিন্তা বাস্তব রূপ লাভ করে। ১৭৫২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে সমবায় সমিতি গঠন করেন। ১৭৬১ সালে সর্বপ্রথম ফেনউইক উইভারস সোসাইটি গঠন করা হয় স্থানীয় তাঁতীদের ঋণ-সুবিধা, শিক্ষা ও অভিবাসন সুবিধা দেবার জন্য। বৃটেনে আনুষ্ঠানিকভাবে সমবায় গঠিত হয় ১৮৪৪ সালে। এ সময়ে বৃটেনের রচডেল নামক স্থানের ২৮ জন তাঁতী মাত্র ২৮ পাউন্ড পুঁজি সহযোগে এ ধরনের ব্যবসায় গড়ে তোলে। এরপর জার্মানীতে কৃষক সমবায় সমিতি ও ফ্রান্সে উৎপাদক সমবায় সমিতি গঠিত হয়। ভারত উপমহাদেশে সমবায় প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯০৫ সালে তিনি সমবায়ভিত্তিক কালিগ্রাম কৃষি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে ২০০১ সালে প্রণীত সমবায় আইন-২০০১ (সংশোধিত-২০০২, সংশোধিত-২০১৩)-এর ১৪ ধারা অনুযায়ী সমবায় সমিতিগুলোর স্বতন্ত্র আইনগত ভিত্তি রয়েছে এবং এটি একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা। এছাড়াও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩-এর (খ) অনুচ্ছেদে সমবায়কে মালিকানার দ্বিতীয় খাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
সমবায় সমিতি এমন একটি জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক আর্থসামাজিক প্রতিষ্ঠান, যার মধ্যে থাকে গণতন্ত্র, সম্মিলিত কর্মপ্রচেষ্টা, ব্যাপক উৎপাদন কর্মযজ্ঞ এবং সদস্যদের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির প্রয়াস। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও স্বনির্ভরতা অর্জনে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শোষণ ও বৈষম্যমুক্ত জীবন উপহার দেয় সমবায়। তাই সমবায়কে ‘Citadel of the exploited’ বা ‘শোষিতদের আত্মরক্ষার দুর্গ’ হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের একটি অংশ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। এ দেশের কৃষক শ্রমিক, ক্ষুদ্র পুঁজির মালিক, কারিগর, জেলে, তাঁতী প্রভৃতি শ্রেণির লোক নানা সমস্যায় জর্জরিত। এদের আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী করে জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে সমবায় সমিতির ভূমিকা অপরিসীম। সমবায় সমিতি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত প্রতিষ্ঠান, যার প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয় অগ্রগতিতে অবদান রাখা। সমবায়ের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারীর ক্ষমতায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা সুনিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন। বাংলাদেশে প্রধানত ২৯ ধরনের সমবায় সমিতি আছে, যার মধ্যে কৃষি, মৎস্য ও পশু পালন, গৃহায়ণ, পরিবহন, দুগ্ধ উৎপাদন, ঋণ ও সঞ্চয় এবং ক্ষুদ্র-ঋণদান কর্মসূচি পরিচালনা হচ্ছে উল্লেখযোগ্য। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত সমবায় সমিতি রয়েছে এক লাখ ৭৪ হাজার ৫৩৫টি। এসব সমিতির মাধ্যমে ছয় লাখ ৮৪ হাজার ৭০ জন লোকের বা পরিবারের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া প্রায় দুই লাখ সমিতির মাধ্যমে সুবিধাভোগী পরিবারের পাশাপাশি ২৩ হাজার ১১৮টি সমবায় সমিতি ঋণদান কর্মসূচির সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। এ সকল সমিতির মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদন ও বিতরণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ ও ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে সমবায় অনবদ্য ভ‚মিকা রাখতে পারে। বিশেষ করে আর্থিক ও সেবাখাতে নতুন কার্যক্রম গ্রহণ, বিদ্যমান কার্যক্রমে গতিশীলতা আনায়ন ও সময়োপযোগীকরণের মাধ্যমে সমবায় বেশ কিছু মৌলিক লক্ষ্য অর্জনে অবদান রাখতে পারে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণ, দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা আনায়ন, প্রশিক্ষণ ও সেবাপ্রদানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, অনগ্রসর ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন এবং মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষত নারী উন্নয়নে সমবায় নিকট ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারবে। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকার প্রধান পেশা হচ্ছে কৃষিকাজ। আধুনিক কৃষির জন্য যে পুঁজি, ঝুঁকি এবং যৌথ উদ্যোগ দরকার তার জন্য প্রয়োজন গণমুখী কৃষিভিত্তিক সমবায় ব্যবস্থা। খাদ্য নিরাপত্তা ও মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে হলে কৃষি সমবায়ের কোনো বিকল্প নেই। যথাযথ নীতি, স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা এবং সার্বিক সহযোগিতা পেলে কৃষি সমবায় খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারে। দারিদ্র্য বিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধ এবং খাদ্য নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টিতে অন্যতম এবং উৎকৃষ্ট পদ্ধতি হলো সমবায়ী উদ্যোগ। সমবায়ের মাধ্যমে সামাজিক বনায়ন, পরিবেশের উন্নয়ন, তাঁত ও সেলাই, হস্তশিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ইত্যাদি উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তবে সমবায়কে উৎপাদনমুখী কার্যক্রম পরিকল্পনায় নতুন করে সাজানো প্রয়োজন। দেশে সমবায় আন্দোলন ও গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশের স্বার্থে সমগ্র গ্রাম-ইউনিয়ন পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কৃষি ও ফলমুলভিত্তিক, দুগ্ধ ও মৎস্য খামার, হাঁসমুরগি পালন, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র ব্যবসা ভিত্তিক সমবায় সমিতি গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমবায় পণ্য অত্যন্ত জনপ্রিয়; কারণ একমাত্র সমবায়েই রয়েছে ভোক্তা ও উৎপাদনকারীর অংশগ্রহণ। তাই এ দর্শনে এ দু’পক্ষই সুবিধা লাভ করতে পারে। ভারতের আমুল, ডেনমার্কের আরলা ফুড, বাংলাদেশের মিল্কভিটা সারা বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত। কারণ এ পণ্যগুলো সমবায়ী পণ্য; যেখানে উৎপাদনকারী ও ভোক্তার সংযোগ রয়েছে। দারিদ্র্য বিমোচন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী একটি পরীক্ষিত স্বীকৃত মাধ্যম হচ্ছে সমবায়। জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (২০১৫-২০৩০) সুনির্দিষ্ট ১৭টি লক্ষ্য বাস্তবায়নে সমবায়ের সম্পৃক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ক. ক্ষুধা দুরিকরণ, খ. খাদ্য-নিরাপত্তা অর্জন ও পুষ্টির উন্নয়ন, গ. কৃষির টেকসই উন্নয়ন প্রবর্তন করা, ঘ. স্থিতিশীল ও অংশগ্রহণমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা ঙ. পূর্ণকালীন উৎপাদনমূলক কর্মসংস্থানসহ উপযুক্ত কাজের পরিবেশ তৈরি করা, চ. রাষ্ট্রসমূহের অভ্যন্তরীণ ও বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যকার বৈষম্য বিলোপ করা, ছ. উৎপাদন ও ভোগ কাঠামোর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যমাত্রাগুলোকে অর্জন করতে সমবায় পদ্ধতির প্রয়োগ, অনুশীলন ও সফলতা অর্জনে বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। দেশের অর্থনীতি ও সমাজের সুষ্ঠু অগ্রগতির লক্ষ্যে টেকসই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বিকল্প নেই। দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরে সংগঠিত এ সব সমবায় সমিতির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় পৌনে দুই লক্ষ। দেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ এ সকল সমিতির সদস্য পদ গ্রহণ করে সমবায় আন্দোলনকে জোরদার করেছে। সমবায় আন্দোলন দেশের একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয় ভ‚মিকা পালন করছে। যা যুক্ত হচ্ছে দেশের জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে। তাই বলা যায়, সমবায়ে উন্নতি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট