আরশ আজিম ও আরশ কুরসি : আল্লাহপাকের কুদরতি সৃষ্টি

6

ফখরুল ইসলাম নোমানী

সমস্র জাহানের প্রতিপালক ও সংরক্ষক মহান আল্লাহ্তাআলা সপ্তাকাশের উপর অবস্থিত সুমহান আরশের উপর সমুন্নত, তাঁর ক্ষমতা অসীম ও সর্বব্যাপী। তিনি সব কিছু দেখেন ও শোনেন। কোন কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। তিনি আরশে আ’যীমে থেকেই সব কিছু সুচারুরূপে পরিচালিত করেন। মহান আল্লাহ আরশে সমাসীন। মহান আল্লাহ আরশের অধিপতি। এই নিখিল জাহান সৃষ্টি করার পর তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেননি বরং গোটা সৃষ্টিজগৎ তিনি নিজেই পরিচালনা করছেন। এই সীমাহীন রাজ্যের তিনি রাজাধিরাজ। তিনি শুধু স্রষ্টাই নন তিনি শাসকও। যিনি কোরআন নাজিল করেছেন সেই মহান আল্লাহ আরশের ওপর সমুন্নত। কিন্তু তাঁর ধরন সম্পর্কে কোনো মানুষ জানে না বরং আমরা এ বিষয়ে পূর্ববর্তী নেককার মনীষীদের মতো ঈমান আনব। সে ক্ষেত্রে আমরা কোনো বিকৃতি বা ব্যাখ্যা করব না। কোনো উপমা, উদাহরণ কিংবা আল্লাহর কোনো গুণকে বাতিল করব না, বরং আল্লাহর আরশে সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি তাঁর শান, বড়ত্বর ও মহত্ত্র অনুযায়ী হয়েছে। কোনো স্থান ও অবস্থার সঙ্গে সেটি সীমাবদ্ধ নয়। মহান আল্লাহর আরশেপাকে সমাসীন হওয়ার বিষয়ে প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের আকিদা ও বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ইমাম মালিক (রহ.)-এর একটি কথা থেকে। তিনি বলেছেন-আল্লাহতাআলার আরশে সমাসীন হওয়ার বিষয়টি (কোরআন থেকে) জানা যায় ; কিন্তু এর স্বরূপ বা অবস্থা অজানা। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত। আর এ বিষয়ে ঈমান রাখা ওয়াজিব।
আয়াতুল কুরসি কুরআনের মর্যাদাবান একটি আয়াত। আল্লাহতাআলা এ আয়াতে তার কুরসির বর্ণনা এভাবে দেন-‘ওয়াসিআ’ কুরসিয়্যুহুস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা’-তাঁর কুরসি এত বড় যে সাত আসমান ও সাত জমিন পরিবেষ্টিত করে রয়েছে। আয়াতুল কুরসির অষ্টম অংশে আল্লাহতাআলা তাঁর কুদরতি আসন ‘কুরসি’র বর্ণনা সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জগৎগুলোর সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রিজিকদাতা। তিনি তাঁর একান্ত পরিকল্পনা ও অনুগ্রহে জগতের সবকিছুই সৃষ্টি করেন। স্বীয় পরিকল্পনায় সাজিয়েছেন জগতের সবকিছু। তিনি এতই ক্ষমতাবান যে কোনো কিছু সৃষ্টির নিমিত্তে তাঁর ইচ্ছাই যথেষ্ট যখনই তিনি সৃষ্টি করতে চান তখন শুধু ‘কুন’ বা ‘হও’ নামক শব্দের উচ্চারণ করেন তখন তা তৎক্ষণাৎই হয়ে যায়। পবিত্র কুরআন মাজিদে আল্লাহ বলেন তাঁর ব্যাপার তো এই যে তিনি যখন কোনো কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন তিনি কেবল বলেন ‘হও’ ফলে তা হয়ে যায়। (সূরা ইয়াসিন : ৮২)। কী অসীম ক্ষমতা! অতুলনীয় তাঁর বাহাদুরি কত সুন্দর সৃষ্টির কারিশমা কী দারুণ সৃষ্টির রূপায়ণ। এসবই মহানজাতেপাক আল্লাহ রাব্বুলআলামিনের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
আরশে আজিম মহান আল্লাহপাকের অতুলনীয় অকল্পনীয় এক কুদরত। এটি মাখলুকাতের সর্বশ্রেষ্ঠ মাখলুকও বটে। পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে আল্লাহপাক আরশ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, এ মর্মে তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ যিনি ছয় দিনে সমস্র আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন অতঃপর ‘আরশে’ সমুন্নত হয়েছেন। দিনকে তিনি রাতের পর্দা দিয়ে ঢেকে দেন তারা একে অন্যকে দ্রæতগতিতে অনুসরণ করে এবং সূর্য, চন্দ্র, তারকা রাজি তাঁরই আজ্ঞাবহ। জেনে রেখ, সৃষ্টি তাঁর, হুকুমও (চলবে) তাঁর, বরকতময় আল্লাহ বিশ্বজগতের প্রতিপালক। (সূরা আল-আরাফ : ৫৪)। তিনি আরো বলেন নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক হলেন আল্লাহ যিনি সম¯্রআকাশ আর পৃথিবীকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি যাবতীয় বিষয় পরিচালনা করেন। তাঁর অনুমতি প্রাপ্তি ছাড়া সুপারিশ করার কেউ নেই। তিনিই হলেন আল্লাহ তোমাদের প্রতিপালক। কাজেই তোমরা তাঁরই ইবাদত করো তোমরা কি উপদেশ ¯্রহণ করবে না ? (সূরা ইউনুস : ০৩)।
আরশে আজিম বহন করার জন্য আল্লাহ রাব্বুলআলামিন একদল ফেরেশতা নিয়োজিত করে রেখেছেন। তিনি তাদেরকে আরশ বহন করার উপযোগী ধৈর্য, শক্তিসামর্থ্য, যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে বিশেষভাবে সৃষ্টি করেছেন। তাদের প্রকৃত আকৃতি, প্রকৃতি ও সংখ্যা কত ? তা কেবল তিনিই জানেন। আল্লাহপাক এসব ফেরেশতাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন তারা তাদের অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে তামিল করে যাচ্ছেন। কুরআন মাজিদে বর্ণিত হয়েছে-যারা আরশ বহন করে এবং যারা তার চার পাশে আছে তারা তাদের পালনকর্তার সূপ্রশংসা পবিত্রতা বর্ণনা করে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে এবং মুমিনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বলে হে আমাদের পালনকর্তা আপনার রহমত ও জ্ঞান সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত। অতএব যারা তাওবাহ করে এবং আপনার পথে চলে তাদের ক্ষমা করুন এবং জাহান্নামের আজাব থেকে রক্ষা করুন। মহাপ্রলয়ের দিনে পৃথিবীর সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। ভূপৃষ্ঠের সবকিছুই ধ্বংসশীল। একমাত্র আপনার মহিমায় ও মহানুভব পালনকর্তার সত্তা ছাড়া। (সূরা আর-রহমান : ২৬) মহাপ্রলয় তথা কিয়ামতের মুহূর্তে আল্লাহর আরশকে এমন আটজন ফিরিশতা বহন করবেন যাদের প্রকৃত আকৃতি,শক্তি সামর্থ্য আল্লাহই জানেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন ফেরেশতারা আকাশের প্রান্তদেশে থাকবে ও আটজন ফেরেশতা আপনার পালনকর্তার আরশকে তাদের ঊর্ধ্বে বহন করবে। (সূরা আল-হাককাহ : ১৭)

আসমান বেষ্টন করে আছে আরশে কুরসি : কুরসিও আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় সৃষ্টি। অনেকে মনে করেন, কুরসি ও আরশ এক জিনিস। আসলে দুটি এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন। কুরসি বলা হয় যেখানে আল্লাহ তায়ালার কুদরতি কদম মোবারক রাখেন। সেটা আরশের নিচে অবস্থিত। আল্লাহতায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেন তার কুরসি সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। (সুরা বাকারা : ২৫৫)। এই আয়াতের তাফসিরে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.)-থেকে বর্ণিত একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তিনি বলেন কুরসি হলো দুই পা রাখার স্থান এবং আরশের বিশালতার পরিমাণ আল্লাহ ছাড়া কেউ অনুমান করতে পারে না। হজরত আবু জর গিফারি (রা.)-থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন নবীজিকে (সা.)-কুরসি সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো। তিনি বলেন আরশের সামনে কুরসির তুলনা ভূপৃষ্ঠের কোনো ময়দানে নিক্ষিপ্ত আংটির মতো এবং কুরসির তুলনায় আরশের মর্যাদা আংটির তুলনায় ময়দানের মর্যাদার মতো। আরশের মাঝে রয়েছে আল্লাহপাকের মসনদ তথা কুরসি। কুরসি আরশের চেয়ে তুলনামূলক ছোট। এ কুরসিতে আল্লাহপাক উপবিষ্ট হন। তাঁর কুরসির পরিসীমা কুরআন মাজিদে এ মর্মে বর্ণিত রয়েছে তাঁর সিংহাসন সমস্ত আসমান ও জমিনকে পরিবেষ্টিত করে আছে। আর সেগুলোকে ধারণ করা তাঁর পক্ষে কঠিন নয়। তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান। (সূরা আল-বাকারাহ : ২৫৫)
আরশে আজিম অতি মূল্যবান স্থান। যে স্থান কেবল আল্লাহর জন্যই। মুহাক্কিক ওলামারা বলেন আরশ হলো সৃষ্টিজগতের ছাদস্বরূপ। আরশের নিচেই সবকিছু ; কেবল আল্লাহপাকই আরশের উপরে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। আরশের বিশালতা ও ব্যাপ্তি সাত আসমান, সাত জমিন ও কুরসি থেকেও বড়। আল্লাহর আরশ সাত আসমান সাত জমিন ও কুরসি সবগুলোকেই বেষ্টন করে আছে। হজরত ইবনে মাসউদ (রা.)-থেকে বর্ণিত তিনি বলেন আসমান ও জমিনের দূরত্ব পাঁচশ বছর, প্রত্যেক আসমানের দূরত্ব পাঁচশ বছর, সপ্তম আসমান ও কুরসির দূরত্ব পাঁচশ বছর, কুরসি ও পানির দূরত্ব পাঁচশ বছর, আরশ পানির ওপর, আল্লাহ আরশের ওপর। আল্লাহর কাছে তোমাদের কোনো আমল গোপন নয়। ক্ষমতাধর এ মহান প্রভুর ক্ষমতার মসনদ হলো ‘আরশে আজিম’।
মহান আল্লাহপাক আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের মধ্যে শামিল করে কিয়ামতের দিনে আরশের সুশীতল ছায়ায় অবস্থান করার সৌভাগ্য লাভ এবং আয়াতুল কুরসির মর্যাদা ও ফজিলত লাভে সুন্নাহ পদ্ধতিতে আমল করার সৌভাগ্য লাভ আবশ্যক,তাতে অর্জিত হবে মুমিনের দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ। আমিন।

লেখক : ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট