ডা. হাসান শহীদুল আলম
(শেষ র্পব)
আরব বসন্ত কি ? ২০১০ খৃষ্টাব্দের শেষের দিকে শুরু হওয়া আরব রাষ্ট্রগুলোর জনগণের বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন সংঘটিত হয় বলে এটি আরব বসন্ত বা আর রবিউল আরাবি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়ে উঠে। আর এই পরিচিতিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলো।
আরব বসন্ত কিভাবে শুরু হয় ? গণবিপ্লবের শুরু তিউনিসিয়ায়। এরপর তা মিশরে, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন সহ বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে যায়। প্রথমে মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনে মুবারকের পতন হয়। পরে লিবিয়ায় মুয়াম্মার আল গাদ্দাফি জমানার অবসান হয়। যে সমস্ত বিষয়সমূহ ইস্যু করে আরব বসন্ত গড়ে উঠে ঃ শাসক শ্রেনীর স্বেচ্ছাচারিতা, কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র, চরম দরিদ্রতা, সরকারী দুর্নীতি, মানবাধিকার লংঘন, মূল্যস্ফীতি, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের সাথে সরকারের আঁতাত, সাম্প্রদায়িকতা, বেকারত্ব। যে সমস্ত বিষয়সমূহ আন্দোরনের লক্ষ্য ছিল : গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন। যে সমস্ত পদ্ধতিতে আরব বসন্ত গড়ে উঠে ঃ আইন অমান্য, বেসামরিক প্রতিরোধ, অনলাইন সক্রিয়তা, প্রতিবাদ শিবির, দ্রোহ, বিপ্লব, আত্মবলিদান, ধর্মঘট জারি, বিদ্রোহ, শহুরে যুদ্ধ। এসব বিদ্রোহে প্রতিবাদের ভাষারূপে গণবিদ্রোহের অংশ হিসাবে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন, জনসভা, র্যালী প্রভৃতি কর্মসূচি দেয়া হয়। দেশব্যাপী সাংগঠনিক কাজ, যোগাযোগ এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারণার থেকে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ এর ওয়েবসাইট ব্যবহৃত হয়। আরব বসন্ত সংঘটনে পরাশক্তি : আরব বিশ্বের এই গণঅভ্যুত্থান সংঘটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত সহচর রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করে এবং সরাসরি আঘাত হেনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কের পতন ঘটায়।
নিউইয়র্কে আরব বসন্ত : ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘ওয়াল ষ্ট্রীট দখল করো’ আন্দোলন শুরু হয়। নিউইয়র্ক শহরে শুরু হয়ে এই আন্দোলন শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শতাধিক শহরে নয়, ইউরোপের বিভিন্ন রাজধানী ও গুরুত্বপুর্ণ শহর এবং বিশ্বের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছিল। এই আন্দোলনের আওয়াজ ছিল; ‘আমরাই ৯৯ শতাংশ, পুঁজিবাদ ধবংস হোক’। এই আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিতে সম্ভাব্য সবই করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ক্যাম্পাসে পুলিশ ডাকা, নির্বিচার বলপ্রয়োগ, টিয়ার গ্যাস ও টিজার ব্যবহার করা, ব্যাপক ধরপাকড়, এমনকি শিক্ষকদেরও বলপূর্বক গ্রেফতার।
আরব বসন্তের ফল কি হয়েছিল ? (ক) মানুষের অভূতপূর্ব জাগরনগুলো যেভাবে শাসককে উপড়ে ফেলে দিয়েছে, একই কায়দায় তারা প্রতিবিপ্লবী বা সুযোগসন্ধানী গোষ্ঠীর আঘাত রুখতে পারেনি। আর এভাবে ক্ষমতার মসনদে পুনর্বাসন ঘটেছে প্রতিক্রিয়াশীল, দক্ষিণপন্থী ও তাঁবেদার গোষ্ঠীর। (খ) আফ্রিকার দেশে দেশে নানা বৈদেশিক শক্তির মদদে সরকার ভাংগা গড়ার খেলা দেখা গেছে। (গ) কট্টরপন্থী মৌলবাদী শক্তি হাইজ্যাক করেছিল সেই আন্দোলনকে। মধ্যপ্রাচ্য তলিয়ে গেছে গৃহযুদ্ধ ও অশেষ রক্তপাতের গহŸরে।
বাংলা বসন্ত কি : ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সংগঠিত কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যাহা পরবর্তীতে সরকারবিরোধী আন্দোরনে রুপ নেয় এবং শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটায় সেই আন্দোলনকে বাংলা বসন্ত নামে আখ্যায়িত করেছিলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জুনাইদ সাকী তাহার ১৯-১২-২৩ এর ভবিষ্যৎবানীতে। যে সমস্ত পদ্মতিতে আরব বসন্ত গড়ে উঠেছিল সে একই পদ্ধতিতে বাংলা বসন্ত গড়ে উঠেছিলÑ যেমন, আইন অমান্য, বেসামরিক প্রতিরোধ, অনলাইন সক্রিয়তা, প্রতিবাদ শিবির, দ্রোহ, বিপ্লব, আত্মবলিদান, ধর্মঘট জারি, বিদ্রোহ, শহুরে যুদ্ধ। এ সব বিদ্রোহে প্রতিবাদের ভাষারুপে গণবিদ্রোহের অংশ হিসাবে হরতাল, বিক্ষোভ প্রদর্শন, র্যালী প্রভৃতি কর্মসূচি দেয়া হয়। দেশব্যাপী সাংগঠনিক কাজ, যোগাযোগ এবং রাষ্ট্রীয় প্রচারনার থেকে জনগণের মধ্যে সচেতনতা গড়ে তুলতে ফেসবুক, হোয়াটস এপ ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগ এর ওয়েবসাইট ব্যবহৃত হয় যেমনটি আরব বসন্তে ব্যবহৃত হয়েছিল। বাংলাদেশের এই ছাত্রঅভ্যুত্থান সংঘটনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর সিআইএ এবং পাকিস্তানের আইএসআই প্রশিক্ষিত এজেন্টদের অস্ত্র সরবরাহ করে এবং শত শত হত্যাকান্ড ঘটায় এবং সরাসরি আঘাত হেনে সরকারী গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসমূহে ধ্বংসলীলা চালায়। যেমনটি আরব বিশ্বে সংঘটিত আরববসন্তে মার্কিন সিআইএ এবং ইউরোপীয় ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলো অস্ত্র সরবরাহ করেছিল এবং ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রনায়কদের পতন ঘটিয়েছিল।
‘বাংলা বসন্ত’ সংঘটনের উদ্দেশ্য : (ক) বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকলে সেন্ট মার্টিন বা হাতিয়া পশ্চিমাদের হস্তগত হওয়া সূদূর পরাহত। তাই সিআইএ হাসিনা সরকারের পতন চায়। (খ) সূত্রের খবর, পাকিস্তান সেনা ও আইএসআই এর পরিকল্পনা ছিল শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করা ও পাকিস্তানপন্থী বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানো। গ) জামাত ও ইসলামী ছাত্র শিবির চায় বাংলাদেশে তালেবানের মতো সরকার গড়ে উঠুক। তাদের এই কাজে পূর্ণ সহযোগিতা করে পাকিস্তান। টানা দুই বছরের রূপরেখা নিয়ে জামাতের প্ল্যান ছিল। (ঘ) বাংলাদেশী তালেবানরা এবং আইএসআই চেয়েছিল দেশের সমস্ত জাদুঘর, ভাস্কর্য, ছবি, বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও স্মৃতি, বীরশ্রেষ্ঠদের যা কিছু স্মৃতি, স্মৃতিস্তম্ভ, মিউজিয়াম, সব ভেংগে গুঁড়ো করা।
আরব বসন্ত পরবর্তী ঘটনাসমূহের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে বাংলাদেশে : লিবিয়ায় যা ঘটেছিল তাসংক্ষেপে নিম্নরূপ। সম্পদশালী দেশ লিবিয়ার জনগণ কর্নেল গাদ্দাফির শাসনের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল না। দেশটির আভ্যন্তরীন বাস্তবতার এই চিত্র আরব বসন্তের অন্তরালের কুশীলবদের জানা ছিল যে কারণে মুষ্টিমেয় লিবিয়ান জনগণকে সশস্ত্র প্রক্রিয়ায় আন্দোলনে নিযুক্ত করা হয়। লিবিয়ায় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিবর্তে সামরিক উসকানির প্রকাশ্য প্রবনতা লক্ষ্য করা গেছে। বস্তুত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের প্রত্যক্ষ ইন্ধনে লিবিয়ায় বহু সশস্ত্র গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। এই সশস্ত্র গ্রুপসমূহের এলোপাথারি কর্মকাÐ শেষ পর্যন্ত লিবিয়াতে ন্যাটোর সামরিক হস্তক্ষেপের পথ পরিষ্কার করে। আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে পড়লে আন্তর্জাতিক মতামত উপেক্ষা করে লিবিয়া আক্রমন করে বসে ন্যাটো জোট। এর মধ্য দিয়ে গাদ্দাফির পতন ঘটলেও লিবীয় জনগণ মুক্তি পায়নি। লিবীয় জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি আরব বসন্ত। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের অভিপ্রায় পূরণ হয়েছে ঠিকই।জ্বালানীসমৃদ্ধ লিবিয়ার জাতীয় সম্পদে মার্কিন কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভূমধ্যসাগরে অতিরিক্ত মার্কিন সামরিক উপস্থিতিকে বাস্তবসম্মত করে। এই প্রক্রিয়া কার্যত আরবদের অবশিষ্ট প্রতিরোধ ব্যবস্থাও দুর্বল করে দেয়। পরবর্তীতে সিরিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পেলে আঞ্চলিক সামরিক সমীকরনে ভারসাম্য ফিরে আসে।
‘বাংলা বসন্ত’ এর পরিনাম : (ক) মার্কিন মদদপুষ্ট সরকার বসবে, (খ) মার্কিন মদদ পুষ্ট সরকার বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠনের মিশন চালু করবে, (গ) গণতন্ত্র নির্বাসিত হবে, (ঘ) অভিজ্ঞমহলের মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এবং আগেও নিজেদেরকে গণতন্ত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রবক্তা হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা করে। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ২৭টি দেশে মিলিটারী ডিক্টেটর-ফান্ডামেন্টালিস্টদের ক্ষমতায় বসিয়েছে গণতন্ত্রের কোন ধার না ধেরে। বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলিতে তারা যখনই গণতন্ত্রের নামে একটা শক্তিশালী স্থানীয় সরকারের পতন ঘটাবার চেষ্টা করেছে বা করতে পেরেছে সেই সুযোগটা সবচেয়ে বেশি ফান্ডামেন্টালিস্টরা নিয়েছে। বাংলাদেশেও ঠিক তাই ঘটবে।
বাংলাদেশের ভবিষ্যত পরিস্থিতির অস্থিতিশীল হবার আশংকা : আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিশ্লেষন অনুযায়ী বাংলাদেশকে ঘিরে চীন ও মার্কিন পক্ষের বিদ্যমান কৌশলের প্রভাবের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারতের অবস্থান আগামীর চালচিত্রকে সরলরৈখিক হিসাবে তুলে ধরছে না। এখানে পরাশক্তিদের জারিজুরি বড় জায়গা দখল করতে পারে। বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর ত্রিমাত্রিক দ্বন্দ্বে বাংলাদেশকে অন্যায়ভাবে টেনে আনা হয়েছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনার পতনের পর বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমের গতিপ্রকৃতি বাংলাদেশের সামনে জটিল ভূরাজনৈতিক খেলার ইংগিত দিচ্ছে। পাকিস্তান তাদের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এর মাধ্যমে বাংলাদেশে তাদের কার্যকলাপ সম্প্রসারণ করবে।এই ভাবে বাংলাদেশের উগ্রবাদী সংগঠনসমুহকে যে কোন জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। চীনের অবকাঠামোগত বিনিয়োগ, ভারতের দীর্ঘদিনের প্রভাব এবং আসন্ন সরকারের নতুন কোন বৈদেশিক অংশীদারিত্ব এই ত্রয়ীর হিসাব নিকাশ করছে। পরাশক্তি ভারত যেহেতু এগুলোর পরিপ্রেক্ষিতে বসে থাকবে না সেহেতু বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে যাবে এবং সিরিয়ার মতো দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণে দেখা যাচ্ছে, এক লুটপাট চক্রের বিদায়ের পর আরেক সংঘবদ্ধ লুটেরার আবির্ভাব ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। পুঁজিবাদী উদারবাদী অর্থনীতির এটাই নিয়ম। বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ এর জালে নিপতিত হয়ে দেশ তথাকথিত উদারবাদী অর্থনীতির বল্গাহারা উপত্যকায় পরিনত হতে পারে। এটা আমাদের কাম্য হতে পারে না। সবশেষে বলছি, একটি সুস্থ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং সাংবিধানিক ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ বন্দোবস্ত তৈরীর পথ চিরতরে হারালে তা হবে চূড়ান্ত পরিতাপের বিষয়। (সমাপ্ত)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে স্নাতকোত্তর
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম