ডা. হাসান শহীদুল আলম
(২য় পর্ব)
পরাশক্তি ও সিআইএ এর ষড়যন্ত্রঃ বাংলাদেশে :
ক) বাংলাদেশ ভেংগে খৃষ্টান রাষ্ট্র বানানোর পরিকল্পনা : বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের একটি অংশ নিয়ে পূর্ব তিমুরের মতো খৃষ্টান দেশ বানানোর চক্রান্ত চলছে। সত্তরের দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত। পাহাড়ে শান্তি বাহিনীর যে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র আন্দোলন হয়েছিল, সেখানে মদদ দিয়েছিল অনেক বিদেশী রাষ্ট্র।তথাকথিত মানবাধিকার এবং আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার কথা বলে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উসকে দিয়েছিল এই সব রাষ্ট্র।পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এর পরে পাহাড়ে সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হয়। ধীরে ধীরে সেখানে একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ তৈরী হয়। শান্তি বাহিনীর নিরস্ত্রিকরণ প্রক্রিয়ার পর নূতন করে কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফ যে সহিংসতা শুরু করেছে তার পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে বলে প্রতিয়মান হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা হঠাৎ করে অশান্ত হয়ে উঠেছে। সশস্ত্র তৎপরতা ও সহিংসতার জন্য কেএনএফ দৃশ্যমান শক্তি হলেও এর পেছনে রয়েছে সুগভীর বিদেশী ষড়যন্ত্র। কেএনএফ একক শক্তিতে এই ধরনের সহিংস ঘটনা কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সংগঠিত করতে পারে না।একাধিক আন্তর্জাতিক খৃষ্টান সংস্থা কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি আলাদা রাষ্ট্র করার চক্রান্ত চালাচ্ছে। এই মহলের ইন্ধনেই ইন্দোনেশিয়ার বুকে খৃষ্টান রাষ্ট্র পূর্ব তিমুর বা তিমুর লেস্টে নামের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুদান ভেংগে দক্ষিণ সুদান নামের খৃষ্টান অধ্যুষিত দেশ হয়েছে। বাংলাদেশের হৃদপিন্ডল্য খনিজ সম্পদের অপার সম্ভাবনাময় এক দশমাংশ অঞ্চল তথা পার্বত্য এলাকাকে নিয়ে খৃষ্টান রাষ্ট্র তৈরীর পরিকল্পনা করেছে পশ্চিমারা। কোন কোন বিশ্লেষকের মতে, শুধু বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল নয়, ভারতের নাগাল্যান্ড, মনিপুর ও মিজোরামকে একত্র করে একটি খৃষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। কেউ কেউ মনে করে, বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও মিয়ানমারের কিছু অঞ্চল নিয়ে খৃষ্টান রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই বিদেশী রাষ্ট্রের মদদে কেএনএফ নতুন করে সহিংসতায় লিপ্ত হয়েছে।এ কথা অনস্বীকার্য যে, একটি খৃষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকাকে ঘিরে এনজিও ও আন্তর্জাতিক খৃষ্টান লবি সুদীর্ঘকালব্যাপী নানামুখী চক্রান্ত চালিয়ে আসছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, সমাজ ও মানবতার সেবার ছদ্মাবরনে তারা মূলতঃ পার্বত্য এলাকার দারিদ্র্যপীড়িত জনগোষ্ঠীকে ইউরোপীয় জীবনাচার ও দর্শনের দিকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস চালাচ্ছে।ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনামলে মিশনারীরা ভিনদেশী সংস্কৃতির বিকাশ ও ধর্মান্তরের যে প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করেছিল, পর্যায়ক্রমে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ আমলে তার ক্রমবিকাশ অব্যাহত থাকে।যে সব কারনে পশ্চিমারা খৃষ্টান মিশনারী ও এনজিওগুলোকে ব্যবহার করে একটি আশ্রিত খৃষ্টান রাষ্ট্র তৈরী করতে চায় তার মধ্যে অন্যতম হলো ঃ (১) ভূ-রাজনীতি,ভূ-অর্থনীতি ও ভূ-কৌশলগত কারণে এই অঞ্চল পশ্চিমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। খৃষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ব ও দক্ষিনপূর্ব এশিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো প্রতিরক্ষাবলয় সৃষ্টি করতে চায়। (২) ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের মিলনস্থলের কাছাকাছি বংগোপ সাগরের এমন এক স্থানে বাংলাদেশের অবস্থান যার পাশ দিয়েই রয়েছে আন্তর্জাতিক জাহাজ চলাচলের চ্যানেল। অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক বিবেচনায় দারুণ সম্ভাবনাময় ভূ-কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশের। এই অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য সেন্ট মার্টিন কিংবা হাতিয়া কিংবা বাংলাদেশের সীমান্তসংলগ্ন মিয়ানমারের কিছু অঞ্চল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। (৩) চীনকে কোনঠাসা করতে যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী গোষ্ঠীকে সহায়তার লক্ষ্যে সম্প্রতি ’বার্মা এক্ট’ প্রণয়ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশগুলো ভারত মহাসাগরে চীনের আধিপত্য কমাতে তৎপর। (৪) ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্য সংঘাত, পশ্চিমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য কমাতে চীন-রাশিয়া ও ইরানের নেতৃত্বে বহুকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থার উঁকিঝুঁকি ও চীন-তাইওয়ান উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বের চোখ রাংগানি লক্ষ্যণীয়।
খৃষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পশ্চিমাদের পরিকল্পনা হলো পার্বত্য অঞ্চলে ধর্মান্তরিত উপজাতীয়দের সংখ্যা পর্যাপ্ত পরিমানে বৃদ্ধি পেলে তাদের দিয়ে গণভোট এর দাবী তোলা হবে। পশ্চিমারা তখন জাতিসংঘে গণভোটের পক্ষে জোরালো চাপ সৃষ্টি করবে। এভাবে প্রতিষ্ঠা করা হবে তাদের স্বপ্নের স্বাধীন খৃষ্টান রাষ্ট্র।এ অবস্থায় এ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। খৃষ্টান মিশনারী, পশ্চিমা দাতাগোষ্ঠী ও এনজিও চক্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে টার্গেট করে সামনে এগুচ্ছে। পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে গোটা পার্বত্য অঞ্চল রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
খ) বাংলাদেশে এয়ার বেজ বানানোর পরিকল্পনা।
গ) স্বাধীনতাপূর্বে বাংলাদেশে সিআইএ এর ষড়যন্ত্র : (১) সেন্ট মার্টিন দ্বীপ দখলের পাঁয়তারা : ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তান দখলদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরুর দুইদিন আগে পাকিস্তানে দায়িত্বরত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড বংগবন্ধুর সাথে দেখা করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপের বিনিময়ে বংগবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন। আওয়ামী লীগের দলীয় তহবিলে মোটা অংকের ডলার প্রদানের প্রস্তাব দিযেছিলেন ফারল্যান্ড।বংগবন্ধু ফারল্যান্ডকে বলেছিলেন,’ মি. ফারল্যান্ড, আমি শিয়ালের কাছ থেকে নিয়ে দেশটা বাঘের হাতে তুলে দিতে পারবো না।’ (২) সেন্ট মার্টিন দখলে ব্যর্থ হয়ে বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা ঃ স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যূদয় ঠেকাতে পাকিস্তানকে অস্ত্র-অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংগালীদের গণহত্যাকে সমর্থন করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থনকারী রাষ্ট্রের উপর সামরিক শক্তি প্রয়োগের হুমকী দিয়েছিল। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় অর্জনকে ঠেকিয়ে দিতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ও সাধারন পরিষদে প্রস্তাব উথ্বাপন করেছিল।
ঘ) স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশে সিআইএ এর ষড়যন্ত্র : (১) স্বাধীনতা পরবর্তীতে বাংলাদেশে আইন-শৃংখলার অবনতি ঘটাতে বংগবন্ধু- বিরোধীদের অস্ত্র-অর্থ সহায়তা দেয়। (২) খাদ্যাস্ত্র ব্যবহার করে পরিকল্পিত দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে। কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনস, নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকার ১৯৭৬ জানুয়ারি সংখ্যায় এমা রথচাইল্ড ’ফুড পলিটিকস’ শিরোনামে এক প্রবন্ধ লেখেন।ঐ প্রবন্ধে তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দূর্ভিক্ষের জন্য সরাসরি মার্কিন সরকারকেই দায়ী করেন।
(৩) বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সংগে জড়িয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন। মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার এরিক হিচিন্স তাঁর ‘ট্রায়াল অব হেনরি কিসিনজার’ গ্রন্থে মুজিব হত্যায় কিসিনজারকে দায়ী করেন। পুলিৎজার বিজয়ী মার্কিন সাংবাদিক সাইমন হার্শ তাঁর ‘প্রাইস অব পাওয়ার’ গ্রন্থেও মার্কিন প্রশাসনকে অভিযুক্ত করেন। জান্নিকি অ্যারেন্স ভারতের ‘ইকনমিক এন্ড পলিটিকেল উইকলি’তে লেখেন,’ সপরিবারে মুজিব হত্যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই সিআইএ এর সহায়তায় ঘটেছে।যুক্তরাষ্ট্র্রের ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজীর অধ্যাপক ডঃ পামেরা কে গিলবার্ট তাঁর ’ইমাজিনড লন্ডনস’ বইয়ে লিখেছেন, ’সিআইএ মুজিব হত্যায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সংগে যুক্ত থাকা প্রতিক্রিয়াশীল বাঙ্গালিদের ব্যবহার করেছিল।’
ঙ) শেখ হাসিনার বার্তা : ‘দ্য প্রিন্ট বলছে, ১০ আগস্ট ২০২৪ শনিবার আওয়ামী লীগ সমর্থকদের কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছেন শেখ হাসিনা। বার্তাটি দ্য প্রিন্ট দেখেছে বলে দাবী করেছে।সেখানে হাসিনা বলছেন,’ আমি ক্ষমতায় থাকতে পারতাম যদি আমি সেন্ট মার্টিন এবং বঙ্গোপসাগর আমেরিকার কাছে ছেড়ে দিতাম(ঢাকা পোস্ট ডট কম,১১-০৮-২৪)।’ (চলবে)
লেখক: ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে ¯œাতকোত্তর প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক, চট্টগ্রাম