‘আয়েশী জীবনের’ গরু-ছাগল অতি ধনীরাই ক্রেতা

1

আবু মোশাররফ রাসেল

ওদের প্রত্যেকের জন্য আলাদা করে খাবারের বড়সড় ‘ডেক’ বা পাতিল তৈরি করা আছে, মুখের কাছেই সেই পাতিল, সেখানে নানা ধরনের খাবারে পরিপূর্ণ। প্রত্যেকের শরীরের ওপরে ঘুরছে একটি করে সিলিং ফ্যান, পায়ের নিচে আরাম করা কার্পেট, বিদ্যুৎ চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে যায় জেনারেটর, চলে আসে বিদ্যুৎ। পানির লাইনে সব সময় স্বচ্ছ জলধারা- ইচ্ছে হলেই খাবারে মুখ ডুবিয়ে দিচ্ছে, ইচ্ছে করলেই কার্পেটের উপর আরামসে লুটিয়ে থাকছে। কোনো কিছুরই যেন অভাব নেই, আরাম-আয়েশের সব ব্যবস্থাই রাখা হয়েছেÑ স্ট্যান্ডবাই টুয়েন্টিফোর আওয়ার। নাহ, এই আয়েশী জীবনের বর্ণনা কোনো মানুষের বলে ভুল করবেন না, এই জীবন গরুদের-ছাগলের, মহিষের-গারলের।
এখানেই শেষ নয়, তাদের ‘সেবায়’ যেন কোনো ধরনের ছেদ না পড়ে সে জন্য নিয়োজিত আছেন অনেক ‘সেবক লোকজন’। তারা ঘুরে ঘুরে দেখেন কার কী অসুবিধা, কার কী দরকার। হ্যাঁ, খামারের গরু-ছাগলদের জীবন এমনই। বড় আরাম-আয়েশে, নানা ধরনের পুষ্টিকর খাবার খেয়ে তারা বেড়ে উঠে, স্পষ্টতঃ তাদের শরীরের মাংস বাড়ে।
এই দেশে গরু-ছাগলদের এমন আয়েশী জীবনের ইতিহাস বেশিদিনের নয়। ১০-১৫ বছর আগেও গ্রামের কৃষকের ঘরে, কৃষিকাজ কিংবা ‘কিছু টাকা’ অতিরিক্ত আয়ের আশায় গরু লালন-পালন করা হতো। বিলে-ঝিলে চরে বেড়াতে বেড়াতে গরু-ছাগলরা মাঠের ‘বিনামূল্যের ঘাস’ খেয়ে পেট ভরিয়ে নিত। সন্ধ্যা হলে গৃহস্থের গোয়ালঘরে ঠাঁই হতো। কৃষক সকালে হাল নিয়ে যেতেন, হালে কম হাঁটলে শক্তি যোগানোর জন্য কখনো সখনো ধানের কুঁড়া পানিতে মিশিয়ে গরুকে খাওয়ানো হতো। সেই গ্রামীণ জনপদের গরিব কৃষকের হাতের সম্বল গরু-ছাগল এখন শহরের আধুনিক ছাউনির খামারে খামারে আয়েশি জীবনে, নানা পুষ্টিকর খাবার-দাবারে বড় হচ্ছে।
গরুদের এই আয়েশি জীবনের প্রেক্ষাপটটি একটু বলি- ২০১৪ সালের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে কোরবানির সময়ে অতিরিক্ত যে পশুর চাহিদা তৈরি হতো তা পার্শ্ববর্তী দু’টি দেশ থেকে আমদানি হতো। ২০১৪ সালে ভারত সরকার বাংলাদেশে গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ করে। রপ্তানি বন্ধের আগের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল ২৩ লাখ। ভারতের সেই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য ‘শাপে বর’ হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে তৈরি হয় শত শত খামার। খামারগুলোতে গরু মোটাতাজাকরণ থেকে ছোট গরু পেলে-পুষে বড় হতে থাকে। দেশের খামারিদের উদ্যোগে দ্রুতই দেশ গরু-ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যায়। সেই থেকে কোরবানির চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে বড় অবদান রাখছে এই খামারগুলো।
অবশ্য খামারে আয়েশী জীবনে বড় হওয়া গরু-ছাগলের দাম শুনলে সাধারণ মানুষ কিছুটা বিস্মিত হতে পারেন। কারণ, গরুর জাত আর ওজন ভেদে সবনিম্ন দাম দেড় লাখের নিচে নয় এবং সর্বোচ্চ ১০/১২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এ অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায় এসব গরুর ক্রেতা উচ্চবিত্ত, অতি ধনী মানুষরাই।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে ইতোমধ্যে চট্টগ্রামের স্থায়ী-অস্থায়ী পশুরহাটের পাশাপাশি খামারগুলোও ক্রেতা সমাগমে জমজমাট। উচ্চবিত্ত ক্রেতারা নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশে কোরবানির পশু কেনার জন্য খামারের ওপরই নির্ভর করেন।
গত শনিবার দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়েছিলাম নগরীর চান্দগাঁও থানাধীন ছোট বাকলিয়ার চাঁদের বাড়ি এলাকার ‘আছিয়া এগ্রো ফার্মে।’ খামারটির মালিক স্থানীয় বাসিন্দা, সুইজারল্যান্ড প্রবাসী মোহাম্মদ মহসিন। খামারে বেশ কয়েকজন ক্রেতা আলাদা শেডে গরু এনে পছন্দ আর দরদাম করছিলেন। এক পর্যায়ে খামারটির স্বত্তাধিকারী মহসিন বলে উঠলেন, ‘এত দরদাম হবে না ভাই, গরু পেলে লাভ নাই, শুধু শখের কারবার’।
তিনি বলেন, ‘শখের বশে খামার করেছি, গরু-ছাগল লালন পালনে যে খরচ তা এখন বিক্রি করে পোষায় না, উল্টো লস দিতে হয়’। কারণ কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খামারের গরু-মহিষদের মানুষের চেয়েও বেশি যত্ন-আত্তি করতে হয়, নয়তো গরু মোটাতাজা তো দূরে থাক মরে পড়ার আশঙ্কা থাকে’।
‘গরু পেলে লাভ নেই’ কথাটির ব্যাখ্যা জানতে চাইলে আছিয়া এগ্রো ফার্ম এর এমডি মো. রাশেদ উদ্দিন রোহাত একটি হিসাব তুলে ধরলেন- ‘ব্রাহমা প্রজাতির একটি ৬ মাসের বাচ্চা কিনতে হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকায়। সেই গরুটি টানা দুই বছর লালন পালনের পর ১০-১২ মণ ওজনের হয়ে থাকে। বর্তমানে সেই আকারের একটি গরু বিক্রি হচ্ছে ৫ থেকে সাড়ে ৫ লাখ টাকায়। অথচ একটি গরুর পেছে প্রতিদিন খাবার খরচ পড়ে গড়ে ৭০০ টাকা এবং বিদ্যুৎ বিল, কর্মীর হিসেবে প্রতিটি গরুর পেছনে দৈনিক আরও দুইশ টাকা খরচ পড়ে। সে হিসেবে একটি গরু ১০-১২ মণের ওজনের বড় করতে খামারিরা খরচ পড়ে ৬ লাখ টাকার ওপরে। অথচ বিক্রি করতে হচ্ছে সর্বোচ্চ সাড়ে ৫ লাখ টাকায়’।
তিনি জানান, ‘শখের খামার বলেই আছিয়া এগ্রো ফার্মের পশুগুলো একটু ব্যতিক্রমই। এখানে বিদেশি ১০টিরও বেশি প্রজাতির গরু-মহিষ আছে। ছাগল, ভেড়া ছাড়াও আছে গারলও (ছাগলের মতোই আরেকটি বিশেষ বিদেশি প্রজাতি)। এখানে আছে পাকিস্তানি ও থাইল্যান্ডের পিংক এলভিনো প্রজাতির মহিষ, আমেরিকান জাতের গরু-মহিষ, পাকিস্তানি নীলাভী পাকরা, নীলীরাভি প্রজাতির মহিষ’।
আছিয়া এগ্রো ফার্মে গরু কিনতে আসা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রোটারিয়ান শফি উল্লাহ পূর্বদেশকে বলেন, ‘খামারে গরু-ছাগলকে ভালো খাবার দিয়ে বড় করা হয়। সে জন্য আমার আস্থা খামারের গরুর প্রতি বেশি। এখান থেকে আগেও একবার গরু কিনেছিলাম, দামের সাথে মানানসই গরু পাওয়া যায় বলে এখানে আসি’।
খামারে গরু কিনতে আসা আরেক ক্রেতা, ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘হাটে-বাজারে গিয়ে কোরবানির গরু দেখা-দরদাম করা ঝামেলা মনে হয়। তাই খামারে আসি, এখানে নির্ঝঞ্ঝাট পরিবেশে গরু পছন্দ করে কিনতে পারি। তাছাড়া এখানে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনাও কম থাকে।
জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চট্টগ্রাম নগরী ও জেলায় ছোট-বড় অন্তত ১২ হাজার খামার রয়েছে। এসব খামার গড়ে উঠেছে গত ১০ বছরের মধ্যে। এর মধ্যে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মাঝারি ও বড় মানের খামার রয়েছে। গত ৫ বছর ধরে চট্টগ্রামের বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও পশু খামারে বিনিয়োগ করেছে।
ডেইরি খামার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘এক সময় কেবল গৃহস্থ পর্যায়ে গরু, মহিষ ও ছাগলসহ বিভিন্ন পশু লালন-পালন করা হতো। কিন্তু এখন এটি একটি ব্যবসা সফল খাতে পরিণত হয়েছে। ফলে ব্যক্তি পর্যায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্প গ্রুপও এ খাতে বিনিয়োগ করে এগ্রো খামার গড়ে তুলছেন। সরকারি নানা উদ্যোগ, প্রণোদনা ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে গৃহস্থ পর্যায়েও গবাদি পশুর লালন-পালন বেড়েছে’।