আমার গ্রাম, আমার তীর্থস্থান সারোয়াতলী

2

ইঞ্জিনিয়ার সিঞ্চন ভৌমিক

বোয়ালখালী উপজেলা ৫নং সারোয়াতলী ইউনিয়নের ৮ ও ৯নং ওয়াডের গ্রামের নামটি সুলতানী আমল, মুঘল আমল, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি আমল এমনকি বাংলাদেশ হওয়ার পরেও দীর্ঘদিন ধরে ‘সারোয়াতলী’ হিসেবে নামকরণ ছিল। আমি ছোট বেলা থেকে গ্রামটি ‘সারোয়াতলী’ হিসেবে দেখে শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। স্কুল কলেজে গ্রামের নাম ‘সারোয়াতলী’ হিসেবে লিখে আসছিলাম। হটাৎ করে ২০০৯ সালের একদিন গ্রামের একজন সচেতন ব্যক্তি প্রয়াত চিত্তরঞ্জন নাগ একদিন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আর্থনাদ করছিলেন, রাস্তায় গ্রামের কয়েকজন সম্মানিত ব্যক্তির সামনে বলতেছিল আমাদের গ্রামের নামটি পরিবর্তন হয়ে ‘কন্জুরি’ নামকরন হয়ে গেছে। আমি পেছনের দিক থেকে গিয়ে বিষয়টি শুনে ছিলাম। বিষয়টি শুনে আমর হৃদয়ে খুবই কষ্ট অনুভব করলাম, পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম। আমি গ্রামের সচেতন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছি এবং তাঁহাদের মতামত জরিপ করেছি। দেখেছি গ্রামের মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ খুবই দুঃখ প্রকাশ করল গ্রামের নামটি পরিবর্তন হওয়ার বিষয়ে। আমি নিজেও দেখলাম সত্যি সত্যি গ্রামের নামটি পরিবর্তন হয়ে গেল। ২০১২ সালে গ্রামের সকল শ্রেণী পেশার মানুষের গণ স্বাক্ষর গ্রহণ করে চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ চৌধুরীকে গ্রামের নাম পুনরায় ‘সারোয়াতলী’ নামকরণের মুখপাত্র হিসেবে আমি সিঞ্চন ভৌমিক প্রথম স্মারক লিপি প্রদান করি। কার্যকর না হওয়ায় পরবর্তীতে বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ গঠন করে পুনরায় গ্রাম বাসীদেরকে সাথে নিয়ে চেয়ারম্যান বেলাল হোসেন কে স্মারক লিপি প্রদান করি ২০১৭ সালে। বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদের এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন দেশের সকল প্রগতিশীল মানুষ লিফলেট, ব্যানার, পোস্টার, পথসভার মাধ্যমে গ্রামের নাম পুনরায় ‘সারোয়াতলী’ বাস্তবায়নের জন্য। সচেতন গ্রামবাসীদের সাথে নিয়ে আন্দোলন চলমান রাখি। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হতে থাকে। বিশিষ্ট ঢোল বাদক অর্জুন জলদাস গত ১২ বছরে ৬বারের মতো ঢোল বাজিয়ে গ্রামের জনগণকে গ্রামের নাম পুনরায় ‘সারোয়াতলী’ বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলনে যোগ দেওয়ার আহবান জানান। আমরা গ্রামবাসীদেরকে নিয়ে মিছিল করেছি ‘সারোয়াতলী আমার মা, হারিয়ে যেতে দেবো না।’ এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩০/১০/২০১৭ ইংরেজি তারিখে ইউনিয়ন পরিষদের মাসিক সভায় চেয়ারম্যান মহোদয় বিষয়টি উপস্থাপন করেন। উক্ত সভায় সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয় গ্রামের নাম ‘সারোয়াতলী’। ঠিক একইভাবে বোয়ালখালী উপজেলার মাসিক সভায় গত ১৬/১১/২০১৭ ইং তারিখে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের উপস্থিতিতে সকলের সর্বসম্মতিতে বোয়ালখালী উপজেলা ৫নং সারোয়াতলী ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডকে ‘দক্ষিণ সারোয়াতলী’ ৯নং ওয়ার্ডকে ‘উত্তর সারোয়াতলী’ নামকরণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে গত ১৫ নভেম্বর ২০১৮ ইং তারিখে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ গভর্মেন্ট প্রেস কর্তৃক সাপ্তাহিক গেজেটে ৮নং ওয়ার্ডের বর্তমান গ্রামের নাম দক্ষিণ কঞ্জুরি পরিবর্তন করে ‘দক্ষিণ সারোয়াতলী’ ৯ নং ওয়ার্ডের বর্তমান নাম উত্তর কন্জুরি পরিবর্তন করে উত্তর সারোয়াতলী নামকরণ করেন। উক্ত গেজেটে ভুলবশত এর উত্তর সারোয়াতলী স্থলে দক্ষিণ সারোয়াতলী লিপিবদ্ধ হওয়ায় গত ২৩ জানুয়ারি ২০২০ইং বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশ গভর্মেন্ট প্রেস কর্তৃক সাপ্তাহিক গেজেটে ‘উত্তর সারোয়াতলী’ লিপিবদ্ধ করে ২য় বার গেজেট প্রকাশ করেন। উক্ত গেজেটের আলোকে ২০ মে ২০২৫ ইং বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন থেকে শুরু করে সকল ক্ষেত্রে ৮ নং ওয়ার্ডের গ্রামের নাম ‘দক্ষিন সারোয়াতলী’ ৯ নং ওয়ার্ডের গ্রামের নাম ‘উত্তর সারোয়াতলী’ বাস্তবায়ন করে বর্তমান অন্তর্বর্তী কালীন সরকার। এটি গ্রামবাসী সহ দেশের প্রগতীশীল মানুষের দীর্ঘ দিনের আন্দোলনের ফসল। মাতৃতুল্য গ্রামের নাম ‘সারোয়াতলী’ কে পুনরায় বাস্তবায়ন করার জন্য সুদীর্ঘ ১২বছর লড়াই সংগ্রাম করতে হয়েছে গ্রামবাসীকে।
এর মাধ্যমে আমরা আমাদের আত্মমর্যাদা ফিরে পেয়েছি, ঠিক একই ভাবে আমাদের পূর্ব পুরুষদের পরিচয় রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি, একশত বছর পরে যে শিশুটি আমাদের গ্রামে জন্মগ্রহণ করবে তার অধিকার প্রতিষ্টা করেছি। আমাদের গ্রামের সংগ্রামী মানুষদের নিয়ে যত ইতিহাস লেখা হয়েছে সবগুলোতে তাঁহাদের পরিচয় ছিল গ্রামের নাম ‘সারোয়াতলী’। আজকে আমরা আমাদের ইতিহাসকে রক্ষা করতে পেরেছি। এই আনন্দের সংবাদটি আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ছড়িয়ে দিতে হবে। গ্রামবাসীর জন্য খুবই সম্মান ও গৌরবের বিষয়।
গ্রামের গুরুজনদের কথামতো ‘সারোয়াতলী’ নামটি নিয়ে অনেক গবেষণা করেছি, অনেক বই সংগ্রহ করেছি সাথে সাথে অনেক লেখক গবেষকেরও শরণাপন্ন হয়েছি দীর্ঘদিন ধরে। বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক জামাল উদ্দীন সুন্দর একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেন আমার কাছে। তিঁনি বলেন আমতলী, জামতলী, তুলাতলী, খেজুরতলী, বটতলী যদি গাছের নাম অনুসারে হয়ে থাকে সুতরাং ‘সারোয়া’ বৃক্ষের নাম অনুসারে ‘সারোয়াতলী’ গ্রামের নামকরণ। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, এপর্যন্ত পৃথিবী থেকে প্রায় ৬০০ প্রজাতির বৃক্ষ হারিয়ে গেছে। তার মধ্যে সমুদ্র উপকূলীয় একটি বৃক্ষের নাম হচ্ছে ‘সারোয়া’ বৃক্ষ। আমাদের দক্ষিণে ইমামুল্লারচর আর পশ্চিম-দক্ষিণে হচ্ছে খিতাপচর। এখান থেকে প্রমানিত হয় যে, এটি সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চল ছিল।
আমাদের গ্রামের মুকুটহীন সম্রাট চট্টলরত্ন চট্টগ্রামের প্রথম ব্যারিস্টার পূর্ণ চন্দ্র সেন দক্ষিণ চট্টগ্রামে ২য় মাধ্যমিক বিদ্যাপীঠ ১৮৮০ সালে সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে আমুচিয়া ইউনিয়নের ধোরলা গ্রামে ৭ একর ৬৪ শতক ভূমি নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘পূর্ণ চন্দ্র সেন সারোয়াতলী উচ্চ বিদ্যালয়’ স্কুলের নামকরণে পূর্ণ চন্দ্র সেন নিজের গ্রামের নাম ‘সারোয়াতলী’ কে স্বর্ণাক্ষরে সাজিয়ে রেখেছিলেন। এখানে প্রমানিত হই যে পূর্ণ চন্দ্র সেন গ্রামকে কতো ভালোবাসতেন, গ্রামের মানুষকে কতো ভালোবাসতেন। পূর্ণ চন্দ্র সেনের কাছে আমাদের ঋণের সীমা নেই, ঋণ অপরিশোধ্য।
আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দেবতা আমার পিতা মাস্টার বাদল ভৌমিকের শ্রীমুখে শুনেছি পূর্ণ চন্দ্র সেনকে কিশোর বয়সে তাঁর মা প্রিয় সন্তানের কাছে বলেছিলেন যদি কোনদিন বড়ো হও অএ এলাকায় একটি বিদ্যালয় স্থাপন করে দিও। তখন কার সময় স্কুলের খুবই অভাব। এলাকার গরিব মানুষের সন্তানেরা লেখা পড়া করা অসম্ভব ছিল। মায়ের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আজকে পূর্ণ চন্দ্র সেন অমরত্ব লাভ করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
আমার যে সব দিতে হবে সে তো আমি জানি –
আমার যত বিত্ত, প্রভু আমার যত বাণী।।
আমার চোখের চেয়ে দেখা, আমার কানের শোনা,
আমার হাতের নিপুণ সেবা,আমার আনাগোনা – সব দিতে হবে।।
রবিঠাকুরের অমৃত সুন্দর কথাগুলো পূর্ণ চন্দ্র সেন তাঁর জীবনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। তাই আজ সারাদেশে পূর্ণ চন্দ্র সেন স্মরণীয় বরণীয় হয়ে আছেন যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী। গ্রামের আরো একজন সেনালী সন্তান শৈবাল দাশ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী পূর্ণ চন্দ্র সেনের উত্তরসূরি হিসেবে এলাকায় গরীব মানুষের কাছে দানের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অকাতরে, তাঁকেও সশ্রদ্ধ অভিনন্দন।
আমরা পূর্ণ চন্দ্র সেনের স্বার্থক উত্তরসূরি হিসেবে পূর্ণ চন্দ্র সেনের গ্রাম পুনরায় ‘সারোয়াতলী’ নামকরণ করতে পেরেছি।
‘সারোয়াতলী’ শব্দটি আমাদের জাতীয় সম্পদ। এর সাথে আমাদের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। একজন মানুষ তাঁর জীবনের অনেক স্মৃতি ভুলে যেতে পারে কিন্তু গ্রামের নাম ভুলে যাওয়া কারো সাধ্য নেই।
জন্মভূমি, তৃষ্ণায় জল দেয়, ক্ষুধায় আহার, কষ্টে ভালোবাসা, হতাশায় স্বপ্ন দেখায়, ভাবলে যেখানেই থাকি না কেন ছুটে যায় মন আকুল করা কত সুন্দর সেই আমাদের গ্রাম, নামটি তার ‘সারোয়াতলী’।
আমার ভালোবাসা আমার গ্রাম। ভালো থাকুক আমার গ্রাম, ভালো থাকুক আমার গ্রামের মানুষ, আমার আপনজনেরা।
প্রকৃতির অপরূপে ছায়াঘেরা অনন্য সুন্দর পল্লী, নয়নলোভা সারোয়াতলী – কে সেলাম জানিয়ে শেষ করছি।
ধন্য ধন্য মাগো সারোয়াতলী তুমি,
সগৌরবে বলি মাগো আমার জন্মভূমি।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, চট্টগ্রাম