রোমেনা আফরোজ
একটা দেশের যেমন বিভিন্ন রকম সংকট থাকে, সৃষ্টি হয় একাত্তর, জুলাই; অনুরূপভাবে ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেও সংকট তৈরি হতে পারে। সাধারণত বাঙালিরা ব্যক্তিগত সংকটকে (অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন) প্রাধান্য না দিলেও আমাকে আমলে নিতে হয়েছিল। আমি যন্ত্রণার গহীন সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। নিজেকে প্রকাশ করার একটা মাধ্যম হিসেবে কবিতাকে চিহ্নিত করে আশ্রয় নিয়েছিলাম সাহিত্যজগতে। এর সদস্যরা আমাকে গ্রহণ না করলেও কবিতা বুক পেতে দিয়েছিল। কলম ধরেছিলাম নিজের জন্য। আস্তেধীরে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। একসময় অনুধাবন করেছি, সমাজের মধ্যেই ব্যক্তি সুরক্ষিত। এই পথে ব্যক্তিবাদী প্রতিষ্ঠান বা দল ফায়দা লুটতে পারে না। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বা ভোগবাদী পথে একাকীত্ব ভোগার সম্ভাবনা তৈরি হয়। পদে পদে অনুভূত হয় শূন্যতা।
পূর্বে ভেবেছিলাম, সাহিত্যজগতের মানুষজন সাধারণ থেকে ভিন্ন। তারা অযথা বাকবিতন্ডা পরিহার করেন। তারা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি এবং দলের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের স্বার্থে বিরুদ্ধতায় লিপ্ত হন কিংবা বিভিন্ন মতানৈক্যকে একপাশে রেখে মিলিত হন সবার সাথে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে তেমন উদারতা চোখে পড়েনি, বরং উল্টো চিত্রই পরিলক্ষিত হয়েছে বারবার। কবিদের মধ্যে ‘মুই কী হনুরে’ ভাব লক্ষ্য করে বিস্মিত হয়েছি। আমার মনে হয়, লেখালেখির ক্ষেত্রে যুক্তিবোধ অত্যন্ত জরুরি বিষয়। বস্তুত মানুষের অনিয়ন্ত্রিত আবেগ মুক্তচিন্তা সৃষ্টিতে বাধা প্রদান করে থাকে।
পনেরো সালের দিকে নতুন পথে যাত্রা করে টলমলে পায়ে সমুখে এগিয়েছি। হোঁচট খেয়েছি অসংখ্যবার। নিজেই উঠে দাঁড়িয়েছি আবার। এ সময় কদাচিৎ অনুভব করেছি একজন পথ প্রদর্শকের, যিনি ব্যক্তিগত মতবাদকে চাপিয়ে না দিয়ে নতুন পথের নির্দেশনা দেবেন, যার পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে উন্মুক্তভাবে প্রকাশ করা যাবে। সম্ভবত প্রার্থনার প্রতিত্তুরে দু’জন মানুষ এগিয়ে এসেছেন। প্রথমদিকে ওমর কায়সার ‘খড়কুটো’ পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এরপর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন শক্তি ও বিনয়ের সাথে। তবে তিনি মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনার বিরুদ্ধে ছিলেন। শুধু তিনি নন, গতানুগতিক ধারার বাইরে পড়াশোনা করার জন্য বিভিন্ন আড্ডা এবং অনুষ্ঠান থেকেও আমাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অনেক কটাক্ষের স্বীকার হতে হয়েছে হিজাবের জন্য। যারা কটাক্ষ করেছেন তারা নিজেদের প্রগতিশীল এবং মুক্তচিন্তক হিসেবে দাবি করেছেন। অথচ ব্যক্তিগত অভিরুচি নিয়ে কথা বলা সম্পূর্ণভাবে মুক্তচিন্তার বিপরীত। তাদের অবহেলা বুকে তীরের মতো বিঁধেছে। কারবালার মতো রক্তাক্ত হয়েছি; অনুভব করেছি একাপনা। তবুও প্রার্থনা করেছি, আমি যেন তাদের একজন হয়ে উঠতে পারি। সম্ভবত সার্ভাইভাল রেজিস্টেন্সের নামে সেসব বাধাকে বাদ দিয়ে তাদের সাথে দলে মিশে যাবার প্রবৃত্তিও জেগেছে। অনেকের বিরুদ্ধতা সত্তে¡ও শামসুল আরেফীন পাশে দাঁড়িয়েছে বটবৃক্ষের মতো। ধর্ম বিষয়ে আমাদের মতবিরোধ থাকলেও বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে তা বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অথচ মতাদর্শের বিরুদ্ধতাকে অনেকেই বন্ধনের ক্ষেত্রে বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে আমার লেখালেখি এবং আমাকে এড়িয়ে চলেন।
তখন ধারণা জন্মেছিল, একা পথ চলা সম্ভব নয়। মানুষকে বিবর্তনের পথে দলবদ্ধভাবে অগ্রসর হতে হয়। আমার ধারণা ঠিকই ছিল, কিন্তু সময় পাল্টেছে। বিদ্যমান সময়ে দলবদ্ধভাবে চলাচল করলে নিয়ন্ত্রিত (এ নিয়ে গ্রুপ সাইকোলজিতে আলোচনা করা হয়েছে) হবার আশঙ্কা তৈরি হয়। সেদিনের অবহেলা, বিরুদ্ধতাই মূলত সামগ্রিক চিন্তাভাবনার পথকে প্রশস্ত করেছে। তাই বর্তমানে দলের ঊর্ধ্বে উঠে চিন্তাভাবনা করা সম্ভব হচ্ছে।
সহকর্মী হিসেবে কবি-লেখকরা আমাকে গ্রহণ না করলেও অনেকে প্রত্যাশা করেছেন নারী হিসেবে। অনেকে মানসিক বিকৃতি লুকিয়ে রেখেছেন। অনেকে আবার অস্পষ্ট বয়ানে জাহির করেছেন তাদের মনোবাসনা। কদাচিৎ মনে হয়েছে, নারী কবিকে পাওয়ার জন্য পুরুষদের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রতিযোগিতা চলছে, যা ভোগবাদী মানসিকতার প্রতিচ্ছবি। এরা অনেকে লেখালেখির চেয়ে ব্যক্তিগত লিপ্সা দ্বারা প্ররোচিত। এই প্রবণতা সৃজনশীলতার পথে নারীর অংশগ্রহণকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করছে।
পুরুষদের উপেক্ষায় যতটা না কষ্ট পেয়েছি, তারচেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছি নারীদের প্রত্যাখ্যানে। আমি ভেবেছিলাম, এই জগতের নারীরা আমাকে স্বাদরে গ্রহণ করবে। কিন্তু আমার আস্তিকতা বাধার মহাপ্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাদের মতানৈক্যকে আমি সহজভাবে গ্রহণ করলেও তারা আমার চিন্তাভাবনাকে আকার দিতে চেয়েছেন। সাহিত্যের বিস্তৃত ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা দলীয় চিন্তাভাবনা বাধা হবার কথা নয়। তারপরেও বিভিন্নজন বাধার দেয়াল তুলে সামগ্রিকতার পথকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন।
এতক্ষণ সাহিত্যজগতে পদার্পণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত সংকট নিয়ে কথা বললাম। এবার কবিতা এবং লেখালেখি নিয়ে কথা বলবো। বাংলাদেশের দু’একজন কবি বেশ ভালো লিখেন। নৈরিৎ ইমু, মুয়িন পারভেজ, মন্দিরা এষ, ত্রিশাখ জলদাস এমন অনেকের কবিতায় বারবার মুগ্ধ হয়েছি। তবে বেশিরভাগের কবিতা একটা নির্দিষ্ট স্তরে যেয়ে থমকে যায়। সম্ভবত তারা কবিতাকে সহজ মাধ্যম হিসেবে গণ্য করে দলের বৃত্তে বন্দি হয়ে যান। এতে সাধনা বা কবিতার মধ্যে যাপন করা সম্ভব হয় না।
আমি খেয়াল করেছি, সাধারণ মানুষ এবং সাহিত্যজগতের মানুষজনের চিন্তাভাবনার মধ্যে তেমন ফারাক নেই। আমাদের দেশে ধর্মীয় বিদ্বেষকে অনেকে মুক্তভাবে জাহির করলেও, তারা পুঁজিবাদ, সামাজিক অবকাঠামো এবং যৌনতা নিয়ে কলম ধরাকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারেন না। মূলত বেশিরভাগ লেখকের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার মাইন্ডসেট বিদ্যমান। অনেকে ধর্মের বিরুদ্ধতাকে প্রগতিশীলতা বা আধুনিকতা বলে গণ্য করেন। অনেকে বিজ্ঞানচর্চার বিপক্ষে। নারীদের মধ্যেও বিভিন্ন রকম সংস্কার রয়েছে। তাদের লেখালেখির মধ্যে দীনতার ছাপ স্পষ্ট। দু’একজন পুরুষ লেখক হাত খুলে লিখলেও বেশিরভাগের চিন্তাশক্তি একটা নির্দিষ্ট বৃত্তে আবদ্ধ। অনেকে যৌনতা ও পুঁজিবাদ নিয়ে আমার লেখালেখির বিরোধিতা করেছেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে এসব ক্ষুদ্রতা বিসর্জন দিয়ে উদার হওয়া জরুরি। তবে মুক্ত হওয়ার অর্থ অপ্রাসঙ্গিক কিংবা আরোপিত লেখা নয়।
বর্তমানে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করেন তাদের বেশিরভাগ কলম ধরেন দলের পক্ষে। এই ভঙ্গুর সময়ে সমাজ এবং দেশের স্বার্থে কাজ করা বেশি প্রয়োজন। প্রকৃতপক্ষে চিন্তাভাবনার ক্ষুদ্রতার জন্য আমাদের বুদ্ধিজীবী সংকট তৈরি হয়েছে। তাই কোয়ান্টাম পলিটিক্সের প্রতি আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। টমাস এল ফ্রিডম্যান (Thomas L. Friedman-Amwrican Journalist and author) বলেন, আমাদের ঐতিহ্যগত রাজনৈতিক ব্যবস্থা মূলত বাম এবং ডান পন্থার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। কিন্তু বিশ্বায়ন, নতুন প্রযুক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের অস্থিরতার সময়ে দ্বিমেরুকরণ রাজনীতি পর্যাপ্ত নয়। আমাদের এমন এক সিস্টেম দরকার যা আরও বেশি অভিযোজিত। তিনি একে কোয়ান্টাম পলিটিক্স (Quantum Politics) বলে অভিহিত করেছেন। এটা এমন এক সিস্টেম যেখানে লোকেরা দুই মেরুতে অবস্থান না করে একসাথে একাধিক জায়গায় থাকতে পারে।
প্রায় দশ বছর অসংখ্য বিরোধিতা ও বৈরিতা নিয়ে পথ চলছি। আজও পরিস্থিতির তেমন একটা পরিবর্তন ঘটেনি। শুধু যে সাহিত্যজগতের ব্যক্তিদের সাথে অভিযোজনের ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে তা নয়, তখন নিজস্ব অসচেতনতার বীজ ঔপনিবেশিক দৈত্যের মতো রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসতি গেঁড়েছিল। সেসব অসচেতনতাকে চিহ্নিত করে, প্রতিমুহূর্তে নিড়ানি দিতে হয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা শুধু সাহিত্যজগত নয়, বরং বিশ্বের প্রতিটি মানুষকে অস্থির করে তুলেছে। তাই ব্যক্তি এবং দলগত বিরুদ্ধতাকে বাদ দিয়ে সাহিত্যে এমনভাবে আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে বুদ্ধিজীবী সংকট দূর হয়, যাতে উপর থেকে নিচের দিকে দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে তৈরি হয় সামগ্রিকতা।
লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট