রূপম চক্রবর্ত্তী
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ন্যাক্কারজনক রাজনীতির কারণে আমাদেরকে ভাষার জন্য আত্মাহুতি দিতে হয়েছিল। সুতরাং রাজনৈতিক সংস্কৃতি হতে হবে মৌলিক মূল্যবোধসম্পন্ন। সময়ের প্রয়োজনে একুশের চেতনায় আমাদের রাজনৈতিক শুদ্ধাচার খুব বেশি প্রয়োজন। যে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে রাজনৈতিক সম্মেলন হলে আমরা প্রায় দেখি অনেক বক্তা সম্মেলনের বিষয়বস্তু দেশপ্রেমের কথা ভুলে গিয়ে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দোষারোপ করার পায়তারায় মত্ত থাকেন। সুতরাং একুশের চেতনার বাস্তবায়ন হচ্ছে না রাজনৈতিক ময়দানে। পেশাগত বৈচিত্র্যতায় লক্ষ্য করা যায়, আর্থিক অসামঞ্জ্যতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে পেশাগত বৈচিত্র্যতায়। প্রত্যেকটা পেশাই যে গুরুত্বপূর্ণ এবং একে অন্যকে সম্মানের সহিত সম্বোদন করা উচিত সে বিষয়টি আমরা বেমালুম ভুলে যাই। অনেক উচ্চশিক্ষিতরা কম যোগ্যতাসম্পন্ন পেশাধারীকে মূল্যায়ন করতে হীনমন্যতায় ভোগে থাকেন যা স্পষ্টতই একুশের চেতনার পরিপন্থী।
কয়েকবছর আগে চট্টগ্রাম শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে একজন অতিথি বক্তব্য রাখছিলেন। বাংলা ভাষার প্রতি তার যে প্রেম সেই কথা তিনি বক্তব্য দিতে গিয়ে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। উনি যখন বক্তব্য রাখছিলেন আমার পাশের জন বলে উঠলেন দাদা আপনি কি জানেন এই আলোচকের তিন ছেলেমেয়ের কেউ দেশে লেখাপড়া করেনা। তারা সবাই বিদেশে থাকে এবং ইংরেজিতে কথা বলে। এই ধরনের অনেক মানুষ পাওয়া যাবে যারা নিজের পরিবাররের ভিতর সঠিক বাংলা চর্চা করছেননা। আমরা মনের ভাব ভাষা দিয়েই প্রকাশ করি। ভাব থেকেই ভাষার উদ্ভব। আবার, ভাবপ্রকাশের প্রধান মাধ্যম ভাষাই। তাই ভাব ও ভাষার সম্পর্ক গভীর এবং অবিচ্ছেদ্য। অন্যান্য প্রাণীর থেকে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব হিসেবে মানুষের উন্নত অবস্থান অনেকাংশে ভাষার সূত্রেই। মনুষ্য সমাজের অন্যতম সংযোজক সূত্র ভাষা। তাই সমাজ পরিবর্তনের ছাপ ভাষা ধারণ করবে, সেটিই স্বাভাবিক। ভাষা বিশ্লেষণ করে একটি সমাজ বা গোষ্ঠীর চারিত্রিক বিশ্লেষণও নিপুণ ভাবে করা সম্ভব। মানবগোষ্ঠীর মতো ভাষাও নানা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন নিজের অবয়বে গ্রহণ ও আত্তীকরণ করেই সমৃদ্ধ আর সচল থাকে। পৃথিবীতে যে কোনও শক্তিশালী ভাষার ক্ষেত্রে এমনটাই হয়ে থাকে। কিন্তু ভাষার যে মৌলিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাকে অক্ষুণ্ণ ও বহমান রাখার দায়ও তার উপর বর্তায়। এ দায় আমাদেরই। যে কোনও ভাষারই সহজাত প্রবণতা ও ক্ষমতা থাকে অন্য ভাষা থেকে শব্দ আত্মসাৎ করার, ঋণ গ্রহণ করার। কিন্তু সেই প্রবণতায় নিয়ন্ত্রণ না থাকলে নিজেরই ক্ষতি হয় বেশি। সংস্কৃত ব্যাকরণ রীতি পাঠ করেই বাংলা লিখিত ভাষার চর্চা শুরু হয়েছিল। উইলিয়াম কেরি বাংলা ভাষার যে সর্বসম্মত ব্যাকরণ লিখেছিলেন, তা মূলত সাধু ভাষার ব্যাকরণ। কিন্তু কথ্য বাংলা ভাষার কোনও নির্দিষ্ট একটি চেহারা নেই এবং হতেও পারে না। ভাষা রাজনৈতিক মানচিত্রের সীমারেখা মেনে চলে না। ভাষা আঞ্চলিক কথন-কাঠামোয় প্রভাবিত প্রবহমাণ ঐতিহ্য। তাই বাংলাদেশের সব অঞ্চলের ভাষার বিচিত্র তারতম্য মিলেমিশে তৈরি করেছে বাংলা ভাষার অবয়ব। এ ভাবেই বাংলা ভাষার বহমানতা, সমৃদ্ধি, ব্যাপ্তি ও বিকাশ লাভ করেছে বিভিন্ন সময়। বাংলা ভাষার বিকাশ লাভের বিভিন্ন পর্যায়ে অশুভ শক্তির আঘাত এসেছে। বাংলার দামাল ছেলেরা তা প্রতিহত করেছে। ১৯৪৮ সাল, ২৫ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে গণপরিষদের অধিবেশন চলছিল। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের স্পিকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সেদিন বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার প্রথম প্রস্তাব দেন। ধীরেন্দ্রনাথ সেদিন বলেছিলেন, ‘গণপরিষদে যে কার্যবিবরণী লেখা হয় তা ইংরেজি ও উর্দু ভাষায়। সমগ্র পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলেন। তাই ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব করছি। ’ এতে প্রথম ক্ষিপ্ত হন তখনকার পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’র দাবিতে প্রতিবাদী ভূমিকার জন্য পাক্-সরকারের রোষাণলে পড়েন ধীরেন্দ্র নাথ। এক পর্যায়ে তিনি করাচি ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। বিমানবন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেয়। বলা হয় সেখান থেকেই মূলত ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চের জনসভায় এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’- তখন বাংলার ছাত্রসমাজ এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এরপর ১৯৫২ সনের ৩০ জানুয়ারি আবার ঢাকায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন এক জনসভায় উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ’৫২-তে ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট, ১১ ফেব্রুয়ারি সারা প্রদেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্নে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গ্রেফতার, লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস কোন কিছুই ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি। ছাত্ররা পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে অটল থাকে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের গেট দিয়ে সবাই রাজপথে বের হয়ে আসে। আরম্ভ হয় পুলিশের বেপোরোয়া গুলিবর্ষণ। রক্তরঞ্জিত দেহে ধূলোয় লুটিয়ে পড়েন সালাম, বরকত, রফিক এবং আরো অনেকে। তাঁদের অনমনীয় দৃঢ়তা আর আত্মত্যাগের ফলেই বাংলাভাষা লাভ করে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা। এই মর্যাদাকে আমরা কিভাবে নিজেদের জীবনে প্রতিফলিত করছি তাই বিবেচনার বিষয়।
আমরা এই ভাষা সংগ্রামের চেতনাকে অনুসরণ করতে না পারি তাহলে সামগ্রিকভাবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় কোন জাতীয় সমস্যার সমাধান করতে পারবো না। আর সেটি জাতির জন্য অত্যন্ত হতাশার এবং বিষাদের। ভাষার মাসে আরও যেন কটাক্ষ বেড়ে যায় ভাষার প্রতি। মাসের শুরুতেই অনেকেই ভিন্ন ভাষার সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে পাবলিক অনুষ্ঠান করে থাকেন। গত কিছুদিন আগে আমাদের পাশে কলকাতা শহরের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিল বোর্ড টানানোর ব্যাপারে সতর্কতা জারি করেছিলেন এবং পাশাপাশি বেশ কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করেছিলেন। আসলে কিছু বিষয় আছে যা কখনো জোর করে কিংবা আইনের আশ্রয় নিয়ে অন্যের উপর প্রয়োগ করার বিষয় নয়। দেশপ্রেম মূলত আত্মস্থ ও রপ্ত করার কৌশলের মাধ্যমে বজায় থাকে। আর এর জন্য ভাষাভিত্তিক ও ঐতিহ্যভিত্তিক চেতনাকে লালন করার জন্য চর্চা করতে হবে। চর্চা কেন্দ্র হিসেবে পরিবারই মূলত মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিবার থেকেই শিশুদেরকে যথাযথ শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে দেশপ্রেমের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলতে হবে। একটি দেশের উন্নয়নে সে দেশের দেশপ্রেম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
চেতনাকে লালন করার ইচ্ছা নিজের ভালোবাসা থেকে সৃষ্টি হতে হবে। একুশের চেতনা বলতে স্বাভাবিকভাবে বোঝায়, বাঙালি জাতিগোষ্ঠীর জন্য তাৎপর্যামন্ডিত ও বাঙালির অধিকার সমুন্নত রক্ষার জন্য বাঙালি জাতি কর্তৃক গৃহীত ও মনোবাসিত কর্মপদ্ধতিকেই বুঝানো হয়ে থাকে। যে চেতনায় বাঙালির আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও পেশাগত সম্পর্কের ইতিবাচকতাকেই বোঝানো হয়ে থাকে তথা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে গঠনমূলক ও পরিবর্তনশীল পরিবর্তন প্রাধান্য পায়। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বলতে সমাজের প্রত্যেকটি মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়নকে বুঝানো হয়। একশ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নয়ন কখনোই একুশের চেতনার ধারক নয় কিন্তু আমাদের সমাজে বৈষম্য স্পষ্ট। কিছু মানুষের কাছে দেশের সম্পদের একটা বিরাট অংশ পড়ে রয়েছে এবং অন্যদিকে সাধারণ মানুষের বেশিরভাগই বিভিন্নভাবে শোষণ ও বঞ্চনার স্বীকার হচ্ছেন। দেশের সব মানুষের ভালো থাকার মাঝে একুশের চেতনা জাগ্রত হবে।
একুশের বই মেলাকে সামনে রেখে বাংলা গল্প কবিতা প্রবন্ধের বই ছাপা হচ্ছে না তাও তো নয়। বইমেলার প্রাক্কালে সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন নতুন প্রকাশনী এবং নতুন বইয়ের বিজ্ঞাপনের ঘনঘটা। দেখা যাচ্ছে, বাংলায় শিশু ও কিশোর সাহিত্য এখনও টুনটুনির গল্প, ক্ষীরের পুতুল বা চাঁদের পাহাড়েই থমকে আছে। কিন্তু ধামা, কুলো, ঢেঁকি, গোলা, কুয়ো, নরুন, কলসি, কোদাল, হেঁসো, কুমোর, কামার, ভিস্তি— চেনা বাঙালি বাচ্চা ওইসব সাহিত্যের সঙ্গে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না। সাহিত্য পদবাচ্য অনূদিত কার্টুন সাহিত্য টিনটিনের পর আর হয়নি। সিরিয়াস অনুবাদ সাহিত্য তো মূল রচনার প্রতি বিরাগ উদ্রেককারী অতি দুর্বল সৃষ্টি বিশেষ। যে ভাষায় শিশুপাঠ্য সময়োপযোগী উন্নত সাহিত্য রচনা হয়না, তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ তো বন্ধ্যা হবেই। এই প্রজন্ম না চিনছে শ্রীকান্তকে, না বুঝছে ম্যাকবেথকে। এরা বহুলাংশে ফেসবুক মিমকে ঘিরেই আবর্তিত হয়।
ফেসবুকে নামহীন একজন লেখক লিখলেন ভীতিজনক এটাই যে, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারাও আজকের ইন্টারনেট দুনিয়ায় নিজেদের বর্তমানের উপযুক্ত করে তুলতে বাংলাকে অবহেলা করে নির্দ্বিধায় ভুল ইংরিজিকে আশ্রয় করেন। সে ক্ষেত্রে প্রার্থনা করতেই হয় এঁদের ‘চৈতন্য হোক’— সবার আত্মোপলব্ধি হোক, সবাই মাইকেলত্বপ্রাপ্ত হোন! হে শিক্ষক-শিক্ষার্থী তথা অভিভাবককুল, ইংরেজি, বাংলা দুটোই সঠিক জানুন। নিজের বাঙালি পরিচয়ে শ্লাঘা বোধ করুন। বাংলা বাঁচুক। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ঢাকা হবে বাংলা ভাষার রাজধানী। তিনি কী ভেবে বলেছিলেন জানি না। তবে অমূলক বলেননি। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী চন্দ্রিল ভট্টাচার্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন- ‘একটি দেশে বা শহরে কোন ভাষা চলবে তা ঠিক করে সেখানকার উচ্চকোটির মানুষেরা।’ আমার কথা হল ফেসবুক ব্যবহার করি অথবা ইন্টারনেট ব্যবহার করি আমাদের মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে একুশের চেতনা আমাদের জাতীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যাচ্ছে। বাঙালির জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কারে একুশের অবদান অসামান্য। ভাষা আন্দোলনের ভেতর দিয়ে সংকীর্ণ ধর্মাচ্ছন্নতাকে ছাপিয়ে উঠেছিল জাতিগত চেতনা। সেই চেতনা আমাদের এই মর্মে সচেতন করেছে যে, আমরা বাঙালি। আমরা জেনেছি, বাংলা ভাষা আমাদের অস্তিত্বের অঙ্গীকার, বাংলাদেশ আমাদের দেশ। একুশের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা ছেষট্টি, ঊনসত্তর ও একাত্তরে আমাদের আত্মপরিচয়, আমাদের ঠিকানা ও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য লড়াই করেছি। একুশের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা। পুঁজিপতি, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরাই আদতে ভাষার ক্ষেত্রে মূল নিয়ামক শক্তি। কারণ পুঁজি তাদের কাছে, তাই ক্ষমতাও তাদের হাতেই। দেশের সমাজপতি আর বিত্তবান শ্রেণি বাংলা ভাষা প্রচার এবং প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা না রাখে তাহলে ভবিষ্যতে অনেক সমস্যা দেখা যাবে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেন এ কথা সত্য হতে চলেছে। যেভাবে দেশে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার হিড়িক পড়েছে তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে বাংলাদেশেও পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি তৈরি হতে বেশিদিন লাগবে না। দেশের উঠতি বড়লোক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখন তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে অতি আগ্রহী। সবাইকে এখন থেকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী-পুরুষ বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করবে; প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহৃত হবে। উচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার প্রচলন হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বাঙালির হাতেই বাংলা ভাষা উপেক্ষার শিকার হচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ও অফিস-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, গণমাধ্যম ও বিজ্ঞাপনে ইংরেজি ভাষার দখলদারি ক্রমপ্রসারিত হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্রমবিস্তার, সাধারণ শিক্ষায় ইংরেজি পাঠ চালু করার ফলে বাংলার গুরুত্ব ক্রমেই কমছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের মানসিকতায় বিদেশিয়ানার প্রভাব বাড়ছে। তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণে বিদেশি ভাষার আশ্রয় নেয়ায়, বিয়ে বা জন্মদিনের আমন্ত্রণপত্রে বিদেশি ভাষার ব্যবহারে, দৈনন্দিন বোলচালে বিদেশি বুলির মিশ্রণে, বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তিফলকে বিদেশি ভাষাকে প্রাধান্য দেয়ায়। ঢাকার অনেক শিক্ষিত ধনী মানুষ তাদের সন্তানদের নামকরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। অনেকে বাংলায় কথা বলতে ভয় পাচ্ছেন।
বিশ্বায়নের কারণে ইংরেজি ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনেকাংশে বেড়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যাবে না। একটি আন্তর্জাতিক ভাষা শিখেও মাতৃভাষা চর্চা করা যায়। ইউরোপের প্রায় সব জাতির মানুষ নিজের ভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা শেখেন। চীনের দিকে তাকালে আমরা দেখি মাতৃভাষাকে প্রাধান্য দিয়ে তারা বিশ্বজয়ের দ্বারপ্রান্তে। প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে আসে একুশে ফেব্রæয়ারি সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে। কিন্তু দেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিবেশে একুশ নতুন আবেদন নিয়ে ধরা দেয়। শহীদ মিনারের পাদপীঠে দাঁড়িয়ে মুক্তিকামী মানুষ প্রতিটি একুশে ফেব্রæয়ারিতেই দুর্জয় শপথ গ্রহণ করে- শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অঙ্গীকার, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা অবসানের অঙ্গীকার। এ থেকেই অনুধাবন করা যায় মহান একুশের চেতনা আমাদের জগত ও জীবনকে কতখানি আন্দোলিত করে। শপথ অনেক সময় শপথের জায়গায় থেকে যায়। শপথের পরের দিন আবার অনেকেই ঘুষ খেতে থাকেন।
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্য দিয়ে আমরা পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে পরাজিত করতে সক্ষম হলেও সম্পূর্ণরূপে পাকিস্তান প্রেম নির্মূল করতে পারিনি। ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা এবং পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি বিদ্বেষ ছিল পাকিস্তানি ভাবাদর্শের মূলকথা। যেটা এখনো অনেকের ভিতর মাঝেমধ্যে দেখা যায়। কিছু মানুষ পাবেন যারা পয়লা বৈশাখকে বাঙালির সর্বজনীন উৎসবরূপে না দেখে এর ভেতর হিন্দুয়ানির চেহারা দেখেন। অনেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের আড়ালে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতির মধ্যে ধর্মীয় রং লাগাতে চায়। তাই একুশের সংগ্রাম এখনো অব্যাহত আছে। তবে আশার কথা এই যে একুশের মধ্যে যে বাঙালি জাতীয় চেতনা ও আবেগ আছে, তা প্রচÐ শক্তি হিসেবে একদিন কাজ করবে। কবির ভাষায়, মোদের গরব, মোদের আশা, আ মরি বাংলাভাষা! তোমার কোলে, তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা। ’ মাতৃভাষা মা ও মাতৃভূমির মতই প্রিয়- তাই এদের উপর যখন আঘাত আসে, তখন এদেশের দামাল ছেলে মেয়েরা সর্বশক্তি দিয়ে তাকে প্রতিহত করে। ইতিহাস পড়লেই দেখা যাবে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তি অনেক বার জেগে উঠেছিল এই বাংলায়। কারণ মাতৃভাষা নিঃশ্বাস বায়ুর মত আমাদের মানবিক সত্তার এক অপরিহার্য অংশ। তাকে অমর্যাদায় দূরে রেখে আমরা কখনও সুস্থজীবন গড়ে তোলার আশা করতে পারি না। তাই চলুন মহান একুশের চেতনাকে নিজের অন্তর দিয়ে লালন করি। সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে জয় বাংলা শ্লোগানে চারদিক মুখরিত করে তুলি।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট