আগামী সাধারণ নির্বাচন নিয়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে আলোচনা চলছে তা সম্প্রতি তা আরা জোরদার হচ্ছে বলে মনে হয়। কোথাও কোথাও এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভাজনের দেয়াল তৈরি হচ্ছে, যা সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে প্রতিয়মান হওয়া যায়। সরকার কর্তৃক বার বার বলা হচ্ছে, এবছর ডিসেম্বর না হয়, আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। এমনকি প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই ডিসেম্বর বা জুনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলে যাচ্ছেন। সরকারের জাতীয় বক্তব্যে দেশের বর্তমান সক্রিয় প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলো অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছে। তারা সরকারের নিকট ডিসেম্বরের মধ্যে দ্রæত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা এমনও ইঙ্গিত দিচ্ছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে এ দাবি আদায়ে প্রয়োজনে রাজপথে আন্দোলনে নামবে। গত মাসে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দেয়ার দাবি পুনঃব্যক্ত করেছেন মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একইদিনে জামায়াতে ইসলামের আমির ডা. শফিকুল ইসলাম আগামী রমজানের আগে নির্বাচনের দাবি করেন। এদিকে বামপন্থী বেশকিছু দলও ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দাবি করেছে। অপরদিকে সরকার তাদের আগের বক্তব্যে অটুট থেকে ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে যেকোন সময় নির্বাচনের আয়োজন করা হবে বলে বিএনপিকে জানিয়ে দেন। বিএনপি ও সরকারের অবস্থানের ফাঁকে জামায়াতে ইসলামের আগামী রমজানের আগে নির্বাচনের দাবি রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হচ্ছে বলে অনেকে ধারণা করেছিলেন। অনেকে মনে করেছিলেন, জামায়াতের আমিরের লন্ডন সফর শেষে দেশে ফিরে রোজার আগে নির্বাচনের দাবিকে রাজনৈতিক ঐক্যের ইতিবাচক দিক হিসেবে বিশ্লেষণ করেন। কিন্তু কয়দিন পরই জামায়াতের আমির তাদের আগের বক্তব্যে ফিরে যান। তাদের ভাষায়, আগে সংস্কার ও স্থানীয় সরকারের নির্বাচন পরে জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। জামায়াতের এ দাবি আগে থেকে ছিল, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্রনেতাদের নিয়ে গঠিত এনসিপিও একই দাবি করছে। এতোদিন জামায়াত, এনসিপি ও তাদের সমমনা দলগুলো আগে সংস্কার, পতিত সরকারের বিচার সম্পন্ন করেই পরে নির্বাচনের কথা বলে আসছিলেন। কিন্তু হঠাৎ জামায়াতের নির্বাচনমুখী বক্তব্য এবং রমজানের আগে করার দাবি করায় দেশের সাধারণ মানুষ কিছুটা হলেও আশাবাদি হয়েছিল। কিন্তু এ আশাবাদ অমূলকই মনে হচ্ছে। আমরা জানি, আমাদের দেশে নির্বাচন মানেই অনেকটা উৎসবের আমেজ। সংগতকারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কখন নির্বাচন হবে- তা নিয়ে মুখিয়ে আছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। দেশের মানুষ ২০১৪ সাল থেকে তিনটি নির্বাচন প্রত্যক্ষ করলেও ওই নির্বাচনগুলো ছিলনা অংশগ্রহণমূলক। সাধারণ মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি। দিনের ভোট রাতে হয়ে যাওয়ারও বিরল ঘটনা ঘটেছে অতীতে। এসব কারণে দেশের মানুষ নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে সংসদে পাঠাতে চায়। এজন্য যত দ্রæত সম্ভব নির্বাচনের আয়েজন করলে, সরকার, দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গল হবে।
দৈনিক পূর্বদেশসহ সহযোগি সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত মাসে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) প্রতিনিধিদের বৈঠক হয়েছিল। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত বৈঠকে নির্বাচন ছাড়াও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার, শেখ হাসিনার বিচারপ্রক্রিয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশের পরিস্থিতি কী হতে পারে বৈঠকে তা তুলে ধরেন বিএনপি নেতারা। বিএনপির পক্ষ থেকে বৈঠকে বলা হয়, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে রমজান, তারপর এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এবং পরে থাকবে বর্ষাকাল। তাই ডিসেম্বরে নির্বাচন না হলে পরে প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হতে হবে। বিএনপির এ বক্তব্য যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয়েছে আমাদের। সরকার যৌক্তিক বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখলে কোন রকম বাধাবিপত্তি ছাড়াই ডিসেম্বরে নির্বাচন করা যেতে পারে। এতে দেশের মানুষ কিছুটা হলেও স্বস্তি পাবে।
কিন্তু ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে যেকোন সময় নির্বাচন হবে প্রধান উপদেষ্টার এমন বক্তব্যে হতাশা ব্যক্ত করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে তিনি নির্বাচন শেষ করতে চান। আমরা তাঁর (প্রধান উপদেষ্টার) বক্তব্যে একেবারেই সন্তুষ্ট নই। আমরা পরিষ্কার করেই বলেছি যে আমরা ডিসেম্বরের যে কাট অব টাইম, এর মধ্যেই নির্বাচন যদি না হয়, তাহলে দেশের যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও সামাজিক পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে এবং সেটা তখন নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন হবে।’ বৈঠকের পর আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘আমরা বিএনপিকে ক্যাটাগরিক্যালি বলেছি, নির্বাচন কোনোভাবেই জুনের পরে যাবে না।’ প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ আগামী জুলাই মাসে ঘোষণা করা হবে বলে গত বুধবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার।
অন্যদিকে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্রনেতাদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) চায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে সংস্কারের রোডম্যাপ ও গণপরিষদ নির্বাচন। এছাড়া ড. মোহাম্মদ ইউনূসের সরকার পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকুক একজন উপদেষ্টার এমন বক্তব্যও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মুখর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়াসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আমরা মনে করি, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে আরো সুস্পষ্ট ঘোষণা দিক। ধ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হলে দেশের মানুষ স্বস্তিবোধ করবে। দেশে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক, এটা কারো কাম্য নয়। আমরা সরকারের দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করি।