দেশের মাটিতে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এখন একধরনের অভিশাপে পরিণত হতে যাচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে হাজারো সমস্যার সমাধান হচ্ছে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত কিন্তু মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে বিতাড়িত ও পলাতক রোহিঙ্গাদের যে অংশটি বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে আশ্রিত, তাদের সংকটের কোন সমাধান হচ্ছে না। বরং দিনের পর দিন এ সংকট আরো ঘনীভুত হচ্ছে। এরমধ্যে রোহিঙ্গাদের উপর ভর করে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরোধের বোঝা বাংলাদেশের সীমান্তে এসে পড়েছে। আন্তর্জাতিক মহলও এ নিয়ে চক কষছে, আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সংঘাত সংঘর্ষের মধ্যে রাখাইনসহ অন্যান্য রাজ্যে আটকেপড়া মানুষের জন্য মানবিক সহায়তার প্রদানের লক্ষে বাংলাদেশ সীমান্তে মানবিক করিডোরের প্রস্তাব দিয়েছে জাতিসংঘ। এতে সরকারের কিছুটা নমনিয়তা প্রত্যক্ষ করা গেলেও প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিসহ অন্যান্য দল ও মতের মানুষ করিডোর প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করছেন। তারা এক্ষেত্রে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তুলেছেন। একইসাথে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার সরকারের মধ্যে চলমান সংঘাতে বাংলাদেশ যেন জড়িয়ে না পড়ে সেই দিকে সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেছেন্। বর্তমান নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে শুরু থেকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে আসলেও মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক আন্তোষ, আরাকান আর্মির সাথে দেশটির জান্তা সরকারের যুদ্ধাবস্থা বস্তুত রোহিঙ্গা সংকটকে আরো গভীরে নিয়ে যাচ্ছে। ইতোম্যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, একলাখের অধিক রোহিঙ্গা নতুন করে অনুপ্রবেশ করেছে কক্সবাজার ও বান্দরবানের ক্যাম্পসমূহে। এ ঘটনা শোনার পর দেশের অভ্যন্তরে সর্বশ্রেণির মানুষ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। জানা যায়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির জান্তা সরকারের সঙ্গে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সংঘর্ষ যতই তীব্র হচ্ছে, ততই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। দুই পক্ষের সংঘর্ষের জাঁতাকলে পড়ে বিপর্যস্ত রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে ঢুকছে বাংলাদেশে সীমান্ত পেরিয়ে। একটা হিসাবে দেখা যায়, প্রতি মাসে গড়ে ৬ হাজারের মতো অনুপ্রবেশ ঘটছে। বর্তমান পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। একদিকে বাড়তি রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থলের সংকট, অন্যদিকে মানবিক করিডোরসংক্রান্ত জাতিসংঘের আহŸান, দু’য়ে মিলে বাড়ছে উদ্বেগের মাত্রা। সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ আবারও আন্তর্জাতিক চাপ ও চক্রান্তের শিকার হতে যাচ্ছে কি না, সেই প্রশ্নও দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা সম্প্রতি জাতিসংঘের মানবিক করিডোর প্রস্তাবকে না করার আহবান জানিয়ে সতর্ক করেন যে, এ জাতীয় উদ্যোগ বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যেতে পারে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল ইসলাম একটি জাতীয় দৈনিককে বলেছেন, নতুন করে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় এবং ‘খাদ্য সহায়তা’র নামে মানবিক করিডোর চালু করার প্রস্তাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারে। করিডোরের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে এটি কেবল মানবিক ইস্যুই থাকবে না, বরং বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তার জন্য তা বড় হুমকি হয়ে পড়বে।
ওদিকে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান স্পষ্ট করেই বলছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বড় আকার ধারণ করবে। রোহিঙ্গা পরিস্থিতির সবশেষ চিত্র হলো, আগের ১০ লাখ ৩৬ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সঙ্গে নতুন ১ লাখ ১৫ হাজার যোগ হয়ে নিবন্ধিত রোহিঙ্গা সংখ্যা এখন ১১ লাখ ৫১ হাজার। সংখ্যাটা বিশাল। এত বিপুলসংখ্যক আশ্রিত রোহিঙ্গার জীবন নির্বাহে সহায়তা করা বাংলাদেশের পক্ষে এক কঠিন বাস্তবে পরিণত হয়েছে। এই গুরুদায়িত্ব আমরা আর কতদিন পালন করতে পারব, তা বলা মুশকিল। উপরন্তু মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া মানবিক করিডোরের আহবানে সাড়া দিলে নতুন কোনো বিপদ দেখা দিতে পারে কিনা, সে প্রশ্নও রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় রাখাইনের রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত গণহত্যা সংঘটিত করে তাদের দেশ ছাড়া করে। এতে আবারও সাড়ে চার লাখের উপর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশে করে। এরপর থেকেই আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পৌনঃপুনিক আহবান জানিয়ে এসেছি, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তারা যেন আমাদের সহযোগিতা করেন। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। মিয়ানমার, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকও হয়েছে। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আমরা পুনর্বার এ সংকট থেকে আমাদের উদ্ধারের জন্য সংশ্লিষ্ট সব দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে আবেদন জানাই। মানবিক করিডোরের বিষয়টিও যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর ঐক্যমত্যের উপর জোর দিতে হবে। আমরা যাই করিনা কেন, রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানই হতে হবে আমাদের প্রধান প্রস্তাব। এক্ষেত্রে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতা আরো বেশি জোরদার করতে হবে।