আবারও খালে পড়ে শিশুর মৃত্যু

2

চট্টগ্রাম নগরীর নতুন আতঙ্ক খালে, ড্রেনে কিংবা নালায় পড়ে কখন মৃত্যু হয়! খাল পাড় দিয়ে হাঁটতে গিয়ে, রিকশা বা টেক্সিতে চড়তে গিয়ে চট্টগ্রামে খাল, নর্দমা, নালায় পড়ে থামছে না মৃত্যু। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় হঠাৎ কালবৈশাখি ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হলে চকবাজার এলাকায় খাল পারাপারের সময় দ্রুতগামী মটর রিকশা পানির স্রোতে খালে পড়ে যায়। এসময় যাত্রী মা ও ছয়মাসের শিশু খালে পড়ে গেলে মাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা সম্ভব হলেও শিশুটি পানির স্রোতে হারিয়ে যায়। সর্বশেষ শনিবার ১৪ ঘণ্টা পর সেই শিশুর মরদেহ ভেসে উঠে ঘটনাস্থল থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে চাক্তাই খালে। যেখানে মরদেহ ভেসে উঠেছে তার কাছেই সেহরিসের বাড়ি। খালে পড়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনায় নগরবাসী ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। শিশু সেহরিসসহ গত চার বছরে অন্তত সাত জনের মৃত্যু হয়েছে খালে পড়ে। দেড় বছর বিরতির পর সবশেষ শুক্রবার রাতে খালে পড়ে মৃত্যু হয় ছয় মাস বয়সি কন্যা শিশু সেহরিসের।
শিশু সেহরিস এর মৃত্যুর দায় নিয়ে আবার উঠেছে নানা প্রশ্ন-সমালোচনা। এ নিয়ে পরস্পর দোষ চাপালেও গতকাল রবিবার খালে পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় জনৈক সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেন। উল্লেখ্য যে, জলাবদ্ধতা নিরসর প্রকল্প শুরুর পর থেকে খালগুলোতে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়ার দাবি উঠে। এরপর চশমা খাল, মুরাদপুর ও আগ্রাবাদের দুর্ঘটনার পর এ দাবি আরো জোরদার হলেও সিডিএ বা সিটি কর্পোরেশন অথবা জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বেষ্টনি নির্মাণ করা হয়নি। যার পরিণতি ছয়মাসের শিশুর জীবনহরণ হয়েছে। তবে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বলছে, নগরীর ১৯ খালে রেলিং দেওয়া হয়েছে। অর্থ বরাদ্দ না থাকায় হিজরা খালসহ কয়েকটি খালে রেলিং দেওয়া হয়নি। রেলিং থাকলে রিকশা উল্টে দুর্ঘটনা ঘটত না।
উল্লেখ্য যে, ২০০৭ সালের ১১ জুন ভারী বর্ষণে চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে এক দিনে ১২৫ জনের মৃত্যু হয়। এটি ছিল চট্টগ্রামের ইতিহাসে প্রাকৃতিক দুর্যোগে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা। পাহাড়ের পাদদেশে বেশিরভাগের মৃত্যু হলেও ওই দিন খালে তলিয়ে যায় অন্তত চারজন। গত চার বছরে কোনো ধরনের বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া শুধু অনিরাপদ খালে পড়ে মারা যায় সাতজন। এর মধ্যে ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট ভারী বর্ষণে সময় মুরাদপুর মোড়ে টইটম্বুর খাল পাড়ে সবজি বিক্রেতা সালেহ আহমেদ খালে পড়ে নিখোঁজ হন। তাকে উদ্ধারে দীর্ঘ সময় ধরে চলে অভিযান। শেষ পর্যন্ত তার মরদেহের খোঁজ মেলেনি। মাত্র এক মাসের ব্যবধানে একই বছর ২৭ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এলাকায় হাঁটার সময় নালায় পড়ে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সেহেরীন মাহবুব সাদিয়া মারা যান। সে সময় প্রচন্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে নগরবাসী। ক্ষোভ প্রশমনে তড়িঘড়ি করে সেই খাল পাড়ে দেয়ালের পাশাপাশি ঘেরা দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০২২ সালে ষোলশহর এলাকায় শিশু কামাল নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। তিন দিন পর মুরাদপুরে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট আগ্রাবাদ রঙ্গীপাড়া এলাকায় ১৮ মাসের শিশু ইয়াছিন আরাফাত নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। সর্বশেষ গতবছর ২৭ মে নগরের আসাদগঞ্জের কলাবাগিচা খালে পড়ে ২৫ বছর বয়সি এক যুবকের মৃত্যু হয়। একই বছর জুনে গোসাইলডাঙ্গা এলাকায় সাত বছরের শিশু সাইদুল ইসলাম নালায় পড়ে নিখোঁজ হয়। সবশেষ শুক্রবার রাতে চকবাজারের হিজরা খালে রিকশা উল্টে পড়ে যায় শিশু সেহরিস।
চট্টগ্রাম শহরে খোলা নালা ও ড্রেনের কারণে একের পর এক প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প কাজ চলাকালে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাল-নালা সংস্কারের সময় নিরাপত্তার প্রচলিত নিয়মগুলো উপক্ষো করা হয়। এতে একের পর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রতিটি কাজের জন্য নিরাপত্তা একটা বড় বিষয়। আমরা বলি সেফটি ফার্স্ট। কিন্তু খাল খননের মতো মহাকর্মযজ্ঞে সেফটি বলতে কিছুই নেই। তারা শুরু থেকেই সেফটি নিদের্শনা ফলো করছে না। হিজরা খালে কেন একটা রিকশা পড়ে যাবে। এর পুরো দায়ভার যারা উন্নয়ন কাজের সঙ্গে জড়িত সেসব সংস্থার। তাদের গাফিলতির কারণে খালে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা আগেও ঘটেছে। এখনও ঘটছে। অপরদিকে চট্টগ্রাম পরিবেশ ফোরাম মনে করে, এই দুর্ঘটনা এবং দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অনেক দায় আছে। তারা ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করছে না। ব্যাটারিচালিত রিকশা উল্টে শুক্রবার রাতে খালে পড়ে যায় শিশু সেহরিস। সিটি করপোরেশন যদি ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করত তবে এই মৃত্যু হতো না। এসব রিকশা বন্ধ না করলে সামনের বর্ষা মৌসুমে রিকশা উল্টে খালে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা আরও ঘটবে। আমরা মনে করি, এভাবে অপরিকল্পিত উন্নয়নের নামে মানুষ হত্যার ফাঁদ সৃষ্টির দায় চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলেকে নিতে হবে। এ বিষয়ে সিডিএ ও সিটি কর্পোরেশনকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।