আবরার হত্যা, ধূলিস্যাৎ ২৬টি পরিবারের স্বপ্ন!

1

আকতার কামাল চৌধুরী

স্কুল থেকে বাসা, বাসা থেকে কোচিং সেন্টার। কোচিং সেন্টারের সামনে মায়ের ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা। বৃষ্টি-বাদলে সন্তানের জন্য ব্যাগে করে একটা ছাতা নিয়ে যাওয়া। ব্যস্ত শহরে হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় সন্তানের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা। প্রাত্যহিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বাসায় ফিরে সন্তানের মুখে কিছু দিতে ক্লান্ত-অবসন্ন দেহে মায়ের আবার রান্না ঘরে প্রবেশ করা। সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে মা-বাবার কড়া পাহারা। সাধ্যের মধ্যে প্রাইভেট টিচার রাখা,সন্তান বাজে ছেলেদের সাথে মিশছে কি না তা খেয়াল রাখা- এভাবেই বেড়ে ওঠে আমাদের আবরাররা, তাদের বুয়েটে পড়ুয়া বন্ধুরা।
ভর্তি পরীক্ষা মানে একটি কঠিন তপস্যার নাম; একজন ছাত্রের সারাজীবনের লালিত স্বপ্নের গন্তব্যে পৌঁছায় সাধনা। এ কোচিং থেকে সেই কোচিং, এ টিচার থেকে সেই টিচার,এ গাইড থেকে সেই গাইড। সব মিলিয়ে একটা যুদ্ধক্ষেত্রে নামার যোগাড়। এক মুহূর্তও নষ্ট করলে চলবে না। দিনরাত শুধু শান দেওয়া। খুন-খারাবির ভাবনা তো অচিন্তনীয়। মেয়ে সন্তান হলে মা-বাবার উৎকণ্ঠা আরও চরমে। তাদের চোখজোড়া হয়ে উঠে শক্তিশালী সিসি ক্যামেরা। আবরার আর তার হত্যাকারীরা যেদিন বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসে- তারা একা আসেনি এবং একেবারে পরীক্ষার দিন-ই আসেনি। এসেছিল আগের দিন। এসেছিল বিভিন্ন জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে। সঙ্গে ছিল তাদের অভিভাবকও। দীর্ঘ যাত্রা শেষে কোনো হোটেল কিংবা আত্মীয় স্বজনের বাসায় রাত যাপন করে একটা উৎকন্ঠা নিয়ে সঠিক সময়ে পরীক্ষার হলে পৌঁছানো। তারা শিহরিত হয়েছিল পরীক্ষার হলে ঢুকতে চোখের সামনে স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান বুয়েটের গেইট দেখে। সন্তানকে ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে একবুক আশা নিয়ে বাইরে মা-বাবার অস্থির অপেক্ষা। আবরাররা পরীক্ষা শেষে বের হয়। তাদের হাসিমাখা মুখ দেখে দীর্ঘ কষ্টের ভার ভুলে যান মা-বাবা। আশা, নিশ্চয়ই চান্স পাবে তাঁদের সন্তান।
ফলাফলের দিন আবরার ও তার হত্যাকারীদের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় তাদের পরিবারে। তারা বুয়েটে চান্স পেয়েছে। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধ-ুবান্ধবের শত শত পোস্টে ফেসবুক সয়লাব। অভিনন্দনের জোয়ারে ভাসতে থাকে তারা।
রিক্সা চালকের ছেলে বুয়েটে চান্স পেয়েছে বলে পুরো গ্রামের মানুষ আনন্দোৎসবে মেতে ওঠে। সেই রিক্সা চালক ও তাঁদের স্ত্রী স্বপ্নে বিভোর। তাঁর ছেলে দেশ সেরা ইঞ্জিনিয়ার হবে। বড়ো চাকরি করবে, আরও কত কি! এ বয়সে নিজের আর সফলতাও কী, সুখ-ও কী, সন্তানের সফলতাই তো পিতার সফলতা,পিতার সুখ। হোক না যত কষ্ট। সব ঠিকঠাক চলছিল। ছেলে মেলা-পার্বনে বাড়ি আসে। বুয়েটের ছাত্র, যেদিকে যায়, আলাদা সম্মান তার। মেধাবী বলে কথা। দু’একটা টিউশনি করে বাবার কাঁধ থেকে কিছু বোঝা কমিয়ে আনে। হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাত! আজ সেই মেধাবীরাই সদলবলে হত্যা করলো নিজেদের-ই সতীর্থ আবরারকে। হত্যা মানে হত্যা নয়, নির্মম হত্যা, পালাক্রমে পেটাতে পেটাতে হত্যা। বীরদর্পে অনুশোচনাহীন হত্যা। আবরারের এ হত্যার বিভৎসতায় পুরো জাতি আঁতকে ওঠে।
কীসের মোহে আবরারকে মারলো? এতো জিঘাংসা কীসের? তারা তো এই পরিমÐলে বড়ো হয়নি। পারিবারিক কঠোর অনুশাসন থেকে কীভাবে হঠাৎ এতো স্খলন ঘটলো? এটা কি নিজেকে জাহির করার প্রবণতা ছিল? না কি শক্তির মদমত্ততা দেখিয়ে কোনো মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের নিষ্ঠুর প্রচেষ্টা?
মহামান্য হাইকোর্ট আবরার হত্যার আপীলের রায়ে বিচারিক আদালতের রায়-ই বহাল রাখেন। অর্থাৎ, ২০ জনের মৃত্যুদন্ড আর ৫ জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড। মহামান্য আপীল বিভাগেও যদি এ রায় বহাল থাকে তবে আবরারের সাথে নিভে যাবে আরও ২০টি প্রাণ। আজীবন জেলের প্রকোষ্ঠে বন্দি থাকবে আরও ৫টি জীবন। এভাবে মোট ২৬টি পরিবার নিঃশেষ বলতে হবে।আবরারের পরিবার শোক-দুঃখের মাঝেও পুরো জাতির সহানুভূতি পাচ্ছে। সবাই আজ পুত্রহারা মা-বাবার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।আবরারকে মরনোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হচ্ছে। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ নিপীড়িতের পক্ষে। এটাই মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা। ন্যায়-অন্যায় বিচারবোধ মানুষের মজ্জাগত। এই বোধ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে বিচারালয়।
অন্যদিকে শাস্তিপ্রাপ্ত বুয়েটের ২৫ ছাত্রের পরিবারের অবস্থা কেমন? তাদের বাড়িতেও আজ কান্নার রোল। তারাও আজ বিধ্বস্ত-বিপন্ন। আদরের সন্তানের ফাঁসির রায় শোনে কার মা-বাবা স্বাভাবিক থাকতে পারে! সন্তানের এই পরিনতি তাঁদের কল্পনারও অতীত। এরজন্যে তো তারা সন্তানকে লালন করেনি।
তাদের মায়েদের অবস্থা আরও শোচনীয়! নিজের বুকের দুধ খাইয়ে, নিজের হাতে ডলে-মেজে গোসল করিয়ে, নিজের হাতে হাত ধরে স্কুলে নিয়ে গিয়ে বড়ো করা সন্তান আজ ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে যাচ্ছে। পৃথিবীর কোনো মায়ের পক্ষেই এ দৃশ্য কল্পনা করা অকল্পনীয়। মায়ের বুকের তাপে বেড়ে ওঠা সেই একফোঁটা শিশু-ই আজ বুয়েটে পড়তে গিয়ে ফাঁসির সামনে দাঁড়িয়ে। আহা!
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। তারা তো তাদের সন্তানকে খুনি বানায়নি,খুন করার প্ররোচনায়ও দেয়নি,এমন শিক্ষাও দেয়নি। অন্য সবার মত তারাও সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়তে চেয়েছিল। খুন তো দূরের কথা, খুনের প্রতিবাদ করতেই বরং শিখিয়েছিল। সেই সাধনার ধারাবাহিকতায় তারা নিজেদের সর্বোচ্চ ত্যাগ করে সন্তানকে বুয়েটের মতো যায়গায় নিয়ে এসেছিল। অথচ আজ তাঁদের মাথায় বাজ পড়েছে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার হবে,বড়ো চাকরি করবে- সেটা এখন মরিচীকা। সেই স্বপ্ন আজ চূর্ণবিচূর্ণ। ইঞ্জিনিয়ার হওয়া তো নয়-ই,আপাতত সন্তানের প্রাণ বাঁচানোই তাঁদের দিনরাতের ভাবনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যে সন্তানের গায়ে ফুলের টোকা পড়েনি,যারা আদরে-আহ্লাদে বড়ো হয়েছে, সেই সন্তান সারারাত ধরে বন্ধুর নির্মম আঘাতে আঘাতে প্রাণ দিল। আর একইভাবে বড়ো হওয়া হত্যাকারীরা এখন নিরব-নিস্তব্ধ পরিবেশে ফাঁসির সেলে দিন কাটাচ্ছে। নিজের পরিবার, মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, বাড়ির পুকুর, খেলার মাঠ- এভাবে কত স্মৃতি প্রতি মুহূর্তে হু হু করে চোখের উপর ভেসে উঠছে তাদের।
এতদিন যে ফাঁসির খবর তারা টিভিতে দেখেছে,পত্রিকায় পড়েছে-কঠিন বাস্তবতা হলো, সেই ফাঁসির রুজ্জুর সামনে আজ তারা নিজেরাই দাঁড়িয়ে। আবরার কিংবা তার হত্যাকারীদের বয়স কম নাহলেও খুব বেশিও নয়। এটা আবেগের বয়স। এই বয়সে সবাই একটা ঘোরের মধ্যে থাকে। জানি না,এই বয়সটাই তাদের কাল হলো কি না।
আজ যে প্রশ্নটি মোক্ষম, তা হলো, পারিবারিক সুশিক্ষাপ্রাপ্ত এই ছাত্রদের খুনি বানালো কারা? আজীবন মেধার সাগরে সাঁতার কাটা ছাত্ররা মাত্র দু’এক বছরে এতো নিষ্ঠুর, এতো দুর্বিনীত হলো কীসের মোহে? কারা সেই প্রভাবক,যারা এই উঠতি বয়সের একঝাঁক তরুণকে পঙ্কিল পথে নিয়ে আসলো?
আবরারের মৃত্যু, ২০ জনের ফাঁসি ও ৫ জনের যাবজ্জীবন- ইতিহাসে এ এক নির্মম ট্রেজেডি। অথচ এই ট্রেজেডির দায় আজ কেউ-ই নিচ্ছে না। এর পুরো দায় চেপেছে ছাত্রদের কাঁধের উপর,তাদের পরিবারের উপর। আজ তারাই দায় শোধ করছে ফাঁসির কাষ্টে জীবন দিয়ে। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন অনেকের মতো আবরার ও তার হত্যাকারীদের চোখ দিয়েও অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। সে অশ্রু আনন্দের। আজ যে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে তা বুকফাটা কান্নার, এই কান্না কারো সন্তান হারানোর আর কারো ফাঁসির দড়িতে সন্তানকে তুলে দেওয়ার।
পাতালের গভীরতা থেকে আসা এ কান্নার অশ্রু কখনো শেষ হওয়ার নয়।এ কষ্টের বোঝা বহন করা কোনো মা-বাবার পক্ষেই সম্ভব না। পুরো হিমালয় পাহাড় আজ তাঁদের কাঁধে ওঠে বসেছে। মানুষের পক্ষে এ বোঝা বহন করা অসম্ভব। কিন্তু অসম্ভব-সম্ভব বলতে প্রকৃতিতে কিছুই নাই। শত চেষ্টায়ও প্রকৃতি এ হিমালয়সম পাহাড়কে পাশ কাটানোর সুযোগ দেয় না।এটাই নিয়তি। কিন্তু বিচারালয়গুলো খোলা রাখা চাই। নতুবা অপরাধ ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে ওঠবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক