গাজী মোহাম্মদ নুরউদ্দিন
বাংলাদেশে স্থানীয় ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের অবদান অনস্বীকার্য। চট্টগ্রাম বা তৎসন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে যাঁরা কাজ করেছেন তাঁদের মধ্যে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ, ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, ড. আহমদ শরীফ, ড. আবদুল করিম, সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম, সৈয়দ মুর্তজা আলী, ড. আলমগীর মোহম্মদ সিরাজুদ্দীন, ড. সুনীতিভূষণ কানুনগো, ওহীদুল আলম, আবদুল হক চৌধুরী প্রমুখ খ্যাতি অর্জন করেছেন। এঁদের মধ্যে আবদুল হক চৌধুরী ব্যতিত অনেকেই কম বেশি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, উচ্চতর গবেষণা ও প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু উচ্চতর ডিগ্রি বা গবেষণা প্রশিক্ষণ ছাড়া শুধুমাত্র ব্যক্তিগত উদ্যোগ, ঐকান্তিক আগ্রহ, অনুসন্ধিৎসু মন, সাধনা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার তাগিদে ইতিহাস লেখার স্বীকৃত নিয়মনীতি উপেক্ষা করে স্থানীয় ইতিহাস চর্চায় প্রবৃত্ত হন চট্টগ্রামের রাউজানের স্কুল শিক্ষক আবদুল হক চৌধুরী। পরিণত বয়সে আবদুল হক চৌধুরী লেখালেখি শুরু করেন।এ উদ্দেশ্যে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ইতিহাসের আকর উপাদান, ধ্বংসাবশেষ ও পুরাকীর্তি সংগ্রহে মনযোগ দেন। চট্টগ্রাম সম্পর্কে ইতিহাসের অনেক অজানা অধ্যায় উন্মোচন করতে গিয়ে আবদুল হক চৌধুরীকে বহু চড়াই উৎরাই পার করতে হয়েছিল। এমনকি ষাটোর্ধ্ব বয়সে শারীরিক বাধা সত্তে¡ও তিনি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গেছেন।তাঁর সময়কার যোগাযোগব্যবস্থা আজকের মতো এতটা সহজসাধ্যও ছিল না। এখানেই তার কাজের বিশেষত্ব। নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও ধারণাকে সমাজের অন্য দশজনের সঙ্গে মিলিয়ে যাচাই-বাছাই পদ্ধতির মধ্য দিয়ে প্রকৃত সত্যকে গ্রহণ করার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। এমন দৃষ্টান্ত বহু ছড়িয়ে আছে তাঁর গ্রন্থে।
চট্টলতত্ত¡বিদ হিসেবে খ্যাত আবদুল হক চৌধুরী চিরস্মরণীয় তাঁর গবেষণার জন্য। শুধু চট্টগ্রাম ভূখÐের জন্ম-ইতিহাসের অনুসন্ধান তিনি করেননি, একই সঙ্গে এ অঞ্চলের সমাজ-সংস্কৃতি, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনাচার, ভাষা, ধর্ম প্রভৃতি বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। অনেকটা নিজ গরজেই তিনি এসব তথ্য অনুসন্ধান করে হয়েছেন ইতিহাসের বরপুত্র। অথচ অষ্টম শ্রেণি পাস করেছিলেন তিনি। এরপর আর পড়াশোনা এগোয়নি। তবে তাঁর তথ্যানুসন্ধানের গভীরতা ছাড়িয়ে গেছে অন্য অনেককেই। এ সবুজ-শ্যামল চট্টগ্রামের কৃতী সন্তান আবদুল হক চৌধুরী জন্মেছিলেন দেশ ভাগের বহু আগে, ১৯২২ সালের ২৪ আগস্ট। এই নগর-শহর-গ্রাম তখন ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ছিল। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান থানার নোয়াজিশপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এরপর তিনি বহু অঞ্চল পরিভ্রমণ করেছেন। জোগাড় করেছেন নানা অজানা তথ্য। যা পরবর্তী সময়ে ইতিহাসের পাতায় পাতায় জায়গা করে নেয়।
আবদুল হক চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন ১৯৯৪ সালের ২৬ অক্টোবর। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ১৯ বছর পর বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় আবদুল হক চৌধুরী রচনাবলি। এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আবদুল করিম। তিনি তাঁর লেখায় বলেন, ‘চট্টগ্রাম-আরাকান-সিলেটের ইতিহাস ঐতিহ্যই ছিল আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণার ক্ষেত্র। তিনি আমাদের মধ্যে নেই। কিন্তু নতুন এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তিনি রেখে গেছেন তাঁর অমূল্য কীর্তি।’
বলা বাহুল্য, ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন ভ্রমণপিপাসু। শৈশবেই বিভিন্ন পাড়া-মহল্লা দাপিয়ে বেড়াতেন। বন্ধুবান্ধব মিলে চলে যেতেন দূরের কোনো গ্রামে। তাঁর পিতা মোহাম্মদ সরফুদ্দিন দানশীল ব্যক্তি হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন। আবদুল হক চৌধুরী যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছেন, তখন বাবা মোহাম্মদ সরফুদ্দিন কাজের জন্য রেঙ্গুনে (বর্তমানে মিয়ানমার) ছিলেন। ঠিক ওই সময়েই তিনি রেঙ্গুনের পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এরপর অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালে এক সহপাঠীর সঙ্গে চলে যান কলকাতায়। এরপর আরও নানা জায়গায় ভ্রমণ করেন তিনি। আর ভ্রমণ করতে গিয়েই পুঁথি সংগ্রহের কথা মাথায় চলে আসে তাঁর। প্রথমেই তিনি প্রাচীন পুঁথি জোগাড়ে নেমে যান। ড.আবদুল করিম লিখেছিলেন, ‘প্রাচীন পুঁথির চর্চা করতে গিয়েই আবদুল হক চৌধুরী ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হন। জন্মস্থান রাউজান, পার্শ্ববর্তী হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকার নামকরণ, ইতিহাস ও ভূগোল, প্রাচীন জমিদার ও ভূস্বামীদের খননকৃত দিঘি, নির্মিত মসজিদের ইতিহাস তাঁর গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।’ পুঁথিচর্চার পরপরই তিনি চট্টগ্রামের সমাজ-সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সাহিত্য নিয়ে জানতে আটঘাট বেঁধে কাজে নেমে যান। হাজির করেন একের পর এক নতুন তথ্য। আর এ কাজ করতে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ দারুণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর সাহচর্যে আসার পর আবদুল হক চৌধুরী ইতিহাসচর্চায় আরও ঝুঁকে পড়েন।
আবদুল হক চৌধুরীর ইতিহাস রচনাকে স্বাগত জানিয়ে কথাসাহিত্যিক আবুল ফজল লিখেন – ‘এ ইতিহাস জনগণের ইতিহাস, তাদের পরিচিতি গ্রাম-বাংলার ইতিহাস, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও আচার আচরণের ইতিহাস।এ এক নতুন ধরনের ইতিহাস।’ বাংলা একাডেমি প্রকাশিত চারটিসহ তাঁর ১২ টি গবেষণামূলক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এসব গ্রন্থে চট্টগ্রামের বহু প্রাচীন কীর্তি ও নিদর্শনের পরিচিতিমূলক বিবরণ, চট্টগ্রামের মুসলমানদের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা, পাঁচ শতাধিক কবি সাহিত্যিক-গবেষকের পরিচিতি, প্রাত্যহিক জীবনের ওপর নৃতাত্তি¡ক ও ঐতিহাসিক গবেষণা, চট্টগ্রাম ও আরাকানের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাস ইত্যাদি প্রকাশ পেয়েছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে সিলেটের একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্রের সন্ধান করেছিলন আবদুল হক চৌধুরী। তাই তিনি ১৯৭৩-৭৭ সালের মধ্যে বিভিন্ন সময় সিলেট অঞ্চলে ঘুরে বহু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে ‘সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ (১৯৮১), নামে একটি গ্রন্থও লিখেছেন। তাঁর অন্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে : চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ- (১ম ও ২য় খÐ একত্রে) ১৯৭৬, চট্টগ্রামের চরিতাভিধান-১৯৭৯, চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি-১৯৮০, শহর চট্টগ্রামের ইতিকথা-১৯৮৫, চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা-১৯৮৮, বাংলা একাডেমী, চট্টগ্রাম আরাকান-১৯৮৯, চট্টগ্রামের ইতিহাস বিষয়ক প্রবন্ধ-১৯৯২, প্রাচীন আরাকান রোয়াইঙ্গা হিন্দু ও বড়–য়া বৌদ্ধ অধিবাসী, বাংলা একাডেমী-১৯৯৪, বন্দর শহর চট্টগ্রাম-বাংলা একাডেমী-১৯৯৪, প্রবন্ধ বিচিত্রাঃ ইতিহাস ও সাহিত্য-বাংলা একাডেমী-১৯৯৫। তাঁর বহু প্রবন্ধ নিবন্ধ সাক্ষাৎকার পত্র-পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ বেতারের বেতার কথিকা লেখক ও বিশেষজ্ঞ বক্তা হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল। আবদুল হক চৌধুরী রচিত ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস’ প্রসঙ্গ (১ম ও ২য় খÐ) এবং ‘চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থ দুটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত¡ বিভাগের সহায়ক গ্রন্থ হিসেবে পাঠ্যক্রমভুক্ত। তার রচনা দেশে বিদেশে লাভ করেছে অনেক খ্যাতি এবং সম্মাননা।
আমৃত্যু তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্য ছিলেন। গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি নতুন সিংহ স্মৃতিপদক (১৯৮৪), চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ প্রদত্ত পদক ও সংবর্ধনা (১৯৮৬) এবং লেখিকা সংঘ (১৯৮৭) সহ বেশকিছু সংগঠন পদক ও সংবর্ধনা দিয়েছে। ২০১১ সালে সরকার প্রদত্ত তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক (গবেষণায়) ভূষিত করে।
লেখক : গবেষক, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার