ইতিহাসবেত্তা, মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের গবেষক। ধ্রুপদী আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষ ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে তিনি অন্যতম। এ জ্ঞানের মাধ্যমে আবদুল করিম ইতিহাসের মূল উৎস অনুসন্ধান করেছেন যা মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি মুদ্রা ও শিলালিপি নিয়ে গভীর অধ্যয়ন করেন এবং মুসলিম লিপিকলা ও মুদ্রাবিদ্যা আয়ত্ত করেন। তাঁর এ গবেষণার মাধ্যমে তিনি যেমন মৌলিক অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন তেমনি মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের নতুন নতুন গবেষণার ক্ষেত্র উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। আবদুল করিমের জন্ম ১৯২৮ সালের ১ জুন চট্টগ্রামে। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গ্রামের মাদ্রাসায়। তিনি ১৯৪৪ সালে হাই মাদ্রাসা পাস করেন। পরে মাদ্রাসা শিক্ষা ছেড়ে তিনি সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি আই এ পাস করেন এবং একই বছর ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ে ভর্তি হন। ১৯৪৯ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে বি.এ (সম্মান) এবং ১৯৫০ সালে একই বিভাগ থেকে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি উক্ত বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন।
আবদুল করিম অধ্যাপক আহমদ হাসান দানীর অনুপ্রেরণায় গবেষণা কর্ম শুরু করেন। ড. দানীর তত্ত¡াবধানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল Social History of the Muslims in Bengal’ যা পরে পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি (বর্তমানে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি) থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৬০-৬১ সালে আবদুল করিম লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের School of Oriental and African Studies থেকে ‘Murshid Quli Khan and His Times’ শিরোনামে দ্বিতীয় পিএইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এটিও পরে পাকিস্তান এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক আবদুল করিম ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৭৫-১৯৮১ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য্যরে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ এ সিনিয়র ফেলো হিসেবে যোগ দেন। এ সময়ে (১৯৮৯-১৯৯০) তিনি দুই খন্ডে বাংলায় মুগলদের ইতিহাস রচনা করেন যা পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক আবদুল করিমের পান্ডিত্য এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানের জন্য ২০০১ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক অধ্যাপক ইমেরিটাস নিযুক্ত করে।
অধ্যাপক আবদুল করিমের মধ্যযুগের মুদ্রাবিদ্যায় দক্ষতা ও পান্ডিত্যের জন্যNumismatic Society of India ১৯৬১ সালে তাঁকে AkbarÕs Silver Medal প্রদান করে। ইতিহাস গবেষণায় তাঁর অবদানের জন্য বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি ২০০৬ সালে তাঁকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। বাংলা ভাষায় তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হলো বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল)।
এছাড়া History of Bengal, Mughal Period গ্রন্থের বাংলা সংস্করণ (দুই খন্ড) প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় (২০০৩) অধ্যাপক আবদুল করিমের শতাধিক ভুক্তি রয়েছে। এর বাইরে তিনি বিভিন্ন সেমিনার প্রবন্ধ এবং জার্নালে নিবন্ধ লেখেন। তাঁর প্রবন্ধগুলি পরবর্তীকালের গবেষকদের নতুন নতুন চিন্তা ও প্রশ্নের জন্ম দেয়। ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই চট্টগ্রামে এই গবেষকের মৃত্যু হয়। সূত্র: বাংলাপিডিয়া