আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার : একটি পর্যালোচনা

1

জসিম উদ্দিন মনছুরি

২০২৪ সালের জুলাই গণহত্যার পর ছাত্র জনতার আন্দোলনে বিগত স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পলায়ন করলে তার দীর্ঘ ১৬ বছরের স্বৈরাশাসনের অবসান ঘটে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র জনতার উপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞে অংশ নেয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকার ও তার অনুগত সশস্ত্র বাহিনী। ৫ আগস্ট ২০২৪ সালে স্বৈরাশাসনের অবসান ঘটলে ৮ আগস্ট নোবেল জয়ী ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হলে ব্যাপক সংস্কার ও গণহত্যার বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ঢেলে সাজানো হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর টিমের প্রধান করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা পরিচালনারী অভিজ্ঞ আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে। দায়িত্বভার গ্রহণ করে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম বিগত স্বৈরাচার শাসনামলে সংগঠিত হত্যা, গুম ও অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের উপর চালানো হত্যাযজ্ঞের তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু করেন। এর জেরে শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ ও ক্ষমতাসীনদের অপরাধ বিষয়ে তদন্ত প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে ৩৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম জানান, চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এখন পর্যন্ত ৫ শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। যেখানে আইসিটি বিডি কেস হিসেবে ৫ মামলায় বিচার চলছে। বিচারাধীন ৫ মামলায় আসামি সংখ্যা ৬২ জন। তিনি বলেন, আরও ২৬ টি মামলা মিস কেস রয়েছে। এ প্রসিকিউটর জানান, তিনটি মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। মামলা তিনটি হলো- শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে একটি, চানখাঁরপুলে ৬ জনকে হত্যা মামলা এবং রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে গুলি করে হত্যা মামলা।চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন একই মামলার আসামি। তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল মামুন কারাগারে, অন্য দুজন পলাতক।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ছয় জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আট আসামির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয় এবং একই তারিখে নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার নিয়োগ পান। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ওই দিন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে প্রথম মামলাটি (মিস কেস বা বিবিধ মামলা) হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আরও দুটি মামলা চলমান রয়েছে। যার মধ্যে একটি আওয়ামী লীগ শাসনামলের সাড়ে ১৫ বছরে গুম-খুনের ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছে। অন্যটি রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে হত্যাকাÐের মামলা। মামলা ও বিচারের অগ্রগতি প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বাসসকে বলেন, বিচারপ্রার্থীর প্রত্যাশা, আইন, আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড, আসামির অধিকার, যথাযথ তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণ, আইনি প্রসিডিউর অনুসরণসহ সার্বিক বিষয়গুলো সমন্বয় করতে হয় প্রসিকিউশনকে।
তিনি বলেন, চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়ে যেন পৃথিবীর কোথাও কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে না পারে, সে বিষয়ে আমরা বদ্ধপরিকর। প্রথমবারের মতো ইতিহাসে বিচার কার্যক্রম টেলিভিশনে লাইভ সম্প্রসার করা হচ্ছে।চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে যেটা হয়েছে, সেটা হলো সাধারণ মার্ডার থেকে আকাশ-পাতাল তফাত। একজন মানুষ খুন করে, সেটা অনুসন্ধান করে। আর এখানে দেড় হাজার লোক খুন হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হয়নি। ফ্যামিলি মেম্বারদের খবর দেওয়ার সুযোগ তারা দেয়নি। বলেছে, কেউ যদি নিয়ে যাওয়ার মতো থাকে, নিয়ে যাক। অজ্ঞাত পরিচয়ে লাশ হিসেবে দাফন করে ফেলতে হবে। সেখানে শহিদের সহযোগী ও পরিবারের সদস্যদের রাতে মানুষের অজান্তে কবর দিতে হয়েছে। তাই এসব মামলার তদন্ত অত্যন্ত জটিল। ইতোমধ্যে অকাট্য প্রমাণ হাতে এসেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও অপরাধের প্রমাণ উঠে এসেছে।চিফ প্রসিকিউটর বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন-১৯৭৩ সংশোধন করা হয়েছে।গত ১০ ফেব্রুয়ারি ও ১০ মে ২০২৫ তারিখে দুটি পৃথক অধ্যাদেশের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে যুগোপযোগী ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা হয়েছে। গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন টিম ও ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রাপ্ত অভিযোগ ও অভিযুক্তের সংখ্যা, দ্রæত বিচার-নিষ্পত্তির প্রয়োজন, কাজের চাপ ইত্যাদি বিবেচনায় গত ৮ মে ২০২৫ তারিখে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার এবং একই প্রজ্ঞাপনে ১৪ অক্টোবর ২০২৪ তারিখে গঠিত ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের এক মামলায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পর সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। ওই মামলার অন্যতম আসামি পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ট্রাইব্যুনালে বক্তব্য দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি ‘অ্যাপ্রুভার’ (দোষ স্বীকার করে ঘটনার সত্য বিবরণ প্রকাশ করেন যে আসামি; সাধারণত তিনি রাজসাক্ষী হিসেবে পরিচিত) হিসেবেও ট্রাইব্যুনালে আবেদন করেন গত ১০ জুলাই। সাবেক আইজিপি’র এমন বক্তব্যের পর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। একই সঙ্গে সাবেক আইজিপি মামুন নিজেকে ‘অ্যাপ্রুভার’ হিসেবে যে আবেদন করেছেন, তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।
চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে কারাগারে থাকা আসামিদের মধ্যে রয়েছেন- ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেকমন্ত্রী আনিসুল হক, আমির হোসেন আমু, মো. আব্দুর রাজ্জাক, কামরুল ইসলাম, মুহাম্মদ ফারুক খান, ডা. দীপু মনি, গোলাম দস্তগীর গাজী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক মন্ত্রী ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার ও জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক এবং ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান।
প্রায় ৩৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে শেখ হাসিনার বিচারের রায় আগামী ১৩ ই নভেম্বর কখন হবে জানা যেতে পারে। বিচার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ রাখতে শেখ হাসিনার পক্ষে সরকার পক্ষ থেকে আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। আইনজীবী তার স্বাধীন মতামত ও হাসিনার পক্ষে যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। দীর্ঘ শুনানির পর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ২০২৪ এর গণহত্যার বিচার নিয়ে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়েছে। ইতোমধ্যে হত্যা ও গুমের সাথে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলে সেনা সদর দপ্তর ১৫ জন সেনা সদস্যকে সেনা হেফাজতে নেন। সেনানিবাসের একটি কক্ষকে সাবজেল ঘোষণা করে সেখানে তাদেরকে রাখা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের এই হেফাজতে নেওয়া কে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেননি। ফলশ্রুতিতে অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামের জোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে অবশেষে ২২ অক্টোবর ২০২৫ অভিযুক্ত ১৫ জন সেনা সদস্যকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।এভাবে সেনা সদস্যদেরকেও আইনের আওতায় আনা হবে তা ছিল প্রশ্নাতীত। কিন্তু সকল জল্পনা ও কল্পনার অবসান ঘটিয়ে সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পর্যায়ের সহযোগিতার ফলে অপরাধী সেনা সদস্যদের চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হলে জনগণের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়।
যেহেতু আইন সবার জন্য সমান। তাঁরই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীর সদস্যরা বেপরোয়া অন্যায় কর্মকাÐ করে পার পেতে পারেন না তা প্রমাণিত হয়েছে সেনাবাহিনীর সদস্যদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করার মধ্য দিয়ে। সেনাবাহিনীর প্রতি জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা অবিচল থাকায় কতিপয় অপরাধী সেনা সদস্যের দ্বারা সেনাবাহিনী কলঙ্কিত হতে পারেনা। সেনাবাহিনীকে কলঙ্ক মুক্ত রাখতে সেনা সদরের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সহযোগিতার ফলে অবশেষে সেনা সদস্যরাও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উঠতে বাধ্য হয়। এটা প্রমাণ করে আইনের শাসনের ঊর্ধ্বে নয় দেশের কোন নাগরিক। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কিংবা সেনাবাহিনী পর্যন্ত আইনের দৃষ্টিতে সমান। প্রসঙ্গত বিগত শেখ হাসিনা সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে অসংখ্যৎমানুষ হত্যা ও গুমের শিকার হন। আয়নাঘর তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। আয়নাঘরে সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আজমি, ব্যারিস্টার আরমান ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর সুযোগ্য পুত্র হুম্মাম কাদের চৌধুরী পর্যন্ত বাদ যায়নি। ইলিয়াস আলীর মত দেশ প্রেমিককে গুম করে হত্যা করা হয়। সব হত্যাকান্ডের বিচার জনগণের কাক্সিক্ষত ও প্রত্যাশিত ছিল। অবশেষে ধারাবাহিকভাবে শেখ হাসিনার বিচারসহ সকল অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এবার দেখার বিষয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে কি রায় আসে। যদিও তাজুল ইসলাম বলেছেন আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে।
আওয়ামী শাসনামলে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইবুনাল) আইন, ১৯৭৩-এর ৬ ধারার অধীনে গঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এবং এর চেয়ারম্যান ছিলেন বিচারপতি মো. নিজামুল হক। এ অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়ে গেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য শেখ হাসিনা সরকার সাক্ষীদের সাক্ষ্যের তোয়াক্কা না করে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃবৃন্দকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে চরম অন্যায় করেছে বলে ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। এটিএম আযহারুল ইসলাম ফাঁসির রায় মাথায় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দী থাকার পর অবশেষে রিভিউ আবেদনে তিনি বেকসুর খালাস পান। সাবেক প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা আক্রোশের বশবর্তী হয়ে সাঈদী সাহেবের মামলার রায় প্রদানের জন্য বিচারপতিকে চাপ প্রয়োগের বিষয়টি তখনকার জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম আমার দেশে প্রকাশিত হলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মানদন্ড ও সত্যতা নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দেয়।বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের স্কাইপি কেলেঙ্কারিও সাহসিকতার সাথে আমার দেশ পত্রিকা প্রকাশ করলে বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন থেকে আইন সংশোধন করে মৃত্যুদন্ড প্রদানের বিষয়টি পৃথিবীর ইতিহাসে নিন্দিত নজির হিসেবে গণ্য করা হয়। এরপর একে একে জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতা মতিউর রহমান নেজামী, মীর কাশেম আলী, কামরুজ্জামানসহ পাঁচজনকে ফাঁসিরকাষ্ঠে ঝুলিয়ে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়। আমৃত্যু কারাদন্ডপ্রাপ্ত ইসলামী স্কলার মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চিকিৎসার নাম দিয়ে ফিজিতে এনে হত্যা করা হয়েছে বলে কথিত আছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন এবং একের পর এক মৃত্যুদন্ড নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন দেখা দিলেও শেখ হাসিনা সরকার তার কোন তোয়াক্কা করেনি।
অবশেষে এটিএম আজাহারের রায়ের সময় সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গবেঞ্চ ক্ষমা প্রার্থনা করছেন।প্রধান বিচারপতি বলেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল নিরপেক্ষ বিচার পরিচালনা করতে সক্ষম হননি। আসামীদের প্রতি জুলুম করা হয়েছে। বিচারপতি গোলাম মোর্তোজার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন টিম পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে হাসিনাসহ শীর্ষ অপরাধীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। প্রথম বিচারের রায় হিসেবে শেখ হাসিনার বিচারের রায়টি জনগণের প্রত্যাশিত।
আগামী ১৩ ই নভেম্বর জানা যাবে রায়ের তারিখ। সেনা সদস্য ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ রেবের তৎকালীন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এভাবে আইনের আওতায় আনা সহজ ছিল না। কিন্তু স্ট্রংলি চিফ প্রসিকিউটর এডভোকেট তাজুল ইসলামের সাহসিকতা ও দৃঢ়চেতার কারণে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের উপস্থাপন ও বিচার প্রক্রিয়ার জন্য তিনি দেশবাসীর কাছে সত্যিকারের নায়ক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। এবার দেখার বিষয় স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেড় হাজার হত্যাযজ্ঞ ও অসংখ্য হত্যা ও গুমের বিচার প্রক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন হয়। দেশের জনগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় রয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাক্সিক্ষত রায়ের প্রতীক্ষায়। যাতে কেউ যেন অন্যায়- জুলুম করে পার পেয় যেতে না পারে। দেশের প্রধানমন্ত্রী হোক কিংবা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি হোক। জনগণের প্রত্যাশা সকল হত্যা, গুম ও জুলুমের বিচার হোক। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশ কলঙ্কমুক্ত হোক।
লেখক : গবেষক, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক