‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে’ যাওয়ার পরামর্শ

1

জুলাই হত্যাকান্ড ও আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনামলে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার দল ও সমমনস্ক ব্যক্তিদের বিচারের জন্য হেগে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে’ যাওয়ার পরামর্শ এসেছে একটি আলোচনা সভা থেকে। একই সঙ্গে আলোচকরা এই হত্যাকান্ড, আওয়ামী লীগ সরকারের ধারাবাহিক ও পদ্ধতিগত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন।
গতকাল রবিবার বিকালে ‘জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং প্রতিবেদন: জুলাই হত্যাকান্ডের ব্যবচ্ছেদ, দায় ও বিচার’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয় নাগরিক কমিটি।২০২৪ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া সরকারি কোটা সংস্কারের আন্দোলন সংহিসতার জেরে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলন ঠেকাতে ব্যাপক দমন পীড়ন চালায় আওয়ামী লীগ সরকার। তীব্র আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। খবর বিডিনিউজের
প্রথম ধাপে জুলাই আন্দোলনে প্রায় ৮৫০ ‘শহীদের’ গেজেট প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। জুলাই হত্যাকান্ড নিয়ে জাতিসংঘের তদন্ত দল অনুসন্ধান চালায়। ১৩ ফেব্রুয়ারি সেই তথ্যানুসন্ধানের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দ্বারা সংগঠিত বিচারবহির্ভুত হত্যাকান্ড, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগের মতো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা উঠে এসেছে।
এসব ঘটনায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন গোষ্ঠী, সংগঠন, বিভিন্ন নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জড়িত ছিলেন বলে প্রতিবেদনটিতে তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ার পর বাংলাদেশে এ নিয়ে তোলপাড় হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো যতটা নির্বাচনমুখী আলাপে অভ্যস্ত, বিচার ও সংস্কার প্রশ্নে তাদের অবস্থান অতটা শক্ত নয়। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যের’।
‘গুম-খুনের হোতা’ আওয়ামী লীগ যেন পার না পায় এটাই এই দেশের মানুষের দাবি, এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল থেকে ওয়ারেন্ট ইস্যু করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে নাই। সবগুলো খুনের সঙ্গে যেই শেখ হাসিনা জড়িত সে ভারতে বসে উস্কানি দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের সরকার তাকে ফিরিয়ে আনার দাবিটিও ঠিকভাবে করতে পারে নাই’।
জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে দাবি হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিচারে দেশীয় যত ব্যবস্থা আছে তাতো কাজে লাগাতেই হবে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গিয়ে তার ও তার দোসরদের বিচার দাবিও করতে হবে। সরকার যদি অপারগতা প্রকাশ করে নাগরিকদের মধ্য থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যাওয়ার রাস্তা খুঁজে নিতে হবে’।
নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যার মত অপরাধে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তদন্ত পরিচালনা করে এবং বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে কারাদন্ড দেয়।
মৃত্যুদন্ডের সাজা দেওয়ার বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিচার ব্যবস্থার বিরোধ তুলে ধরে আখতার হোসেন বলেন, ‘গোটা দুনিয়াজুড়ে ডেথ পেনাল্টির বিষয়ে অনেকগুলো কথা আছে, বিতর্কের জায়গা আছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, হেলিকপ্টার থেকে গুলি, বাসার ভেতরে ঢুকে গুলি, এতো বিভৎসতা যারা দেখেছে তারা এটাই বিশ্বাস করে, এই অপরাধের শাস্তি নিছক কোনো জেল জরিমানা হতে পারে না। তাদের বাংলাদেশের আইনের সর্বোচ্চ শাস্তিই হওয়া দরকার’।
আন্তর্জাতিক মানদন্ডগুলোর দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষের যে আকাঙ্খা সেটাকে আমরা ইগনোর করতে পারি না। আন্তর্জাতিক যতগুলো ফোরাম আছে, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সব ফোরামে বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্খার জায়গাগুলো তুলে ধরা হোক’।
জাতিসংঘের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, মানবতাবিরোধী অপরাধ এখানে ঘটেছে। গণহত্যা, নির্যাতন হয়েছে ব্যাপক এবং সেটা পদ্ধতিগতভাবে হয়েছে। তবে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ পেয়েছেন এ কথা জাতিসংঘ বলছে না। তারা দাবিও করছে না। এই ধরনের প্রতিবেদনে এমন দাবি করাও হয় না। সেই জন্যই তো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বা বিদেশের আদালতে যাওয়া প্রয়োজন’।
বাংলাদেশের অপরাধের সঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধের মিলও তুলে ধরেন তিনি।
জুলাই-আগস্টের দিকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় জাতিসংঘের তদন্তের কথা বলেছিল তুলে ধরে সারা হোসেন বলেন, ‘তৎকালীন সরকারও জাতিসংঘের কাছে তদন্ত চেয়েছিল। এখন ক্ষমতা হারানোর পর সমালোচনা করছে’।
তিনি বলেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আগস্টের ৫ তারিখের পরও অপরাধ হওয়ার কথা বলা হয়েছে এবং সেগুলোর তদন্তের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়েছে। আহমদিয়া, হিন্দু, আদিবাসীদের ওপর আক্রমণ হওয়ার কথা তুলে ধরে তদন্তের কথাও বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের দ্বন্দ্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুদন্ডের বিষয়টা সেখানে থাকলে তারা কো-অপারেট করতে পারবে না। মৃত্যুদন্ড রাখলে তাদের সহযোগিতা পাবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে মৃত্যুদন্ডের বিপক্ষে’।
বিদেশের মাটিতেও এসব অপরাধের বিচার সম্ভব তুলে ধরে এই আইনজীবী আর্জেন্টিনায় মিয়ানমারের একটা মামলা চলার উদাহরণ টানেন। তিনি বলেন, ‘এই সুযোগগুলো এখন আমাদের সামনে আছে’।